ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারে ছোট্ট একটি ম্যাসেজ পেলাম, বিষয় – কিবরিয়া ভাইকে নিয়ে একটি স্বারক গ্রন্থ প্রকাশ হবে, তোমার স্মৃতিচারণমূলক লেখা চাই । ম্যাসেজটি পাঠিয়েছেন বন্ধু সাংবাদিক আজিজুল পারভেজ। পাশাপাশি আজিজুল পারভেজ তার ফেইসবুকেও স্বারক গ্রন্থের জন্য লেখা আহবান করেছেন, তাও দৃষ্টিগোচর হল । বিষয়টি জেনে অবাক হয়েছি, মনও ভালো হয়েছে এই ভেবে যে, মানুষের মৃত্যুর পূর্বে কর্মের স্বীকৃতি আমাদের সমাজে অন্তত শুরু হয়েছে ! সাধারণত কোনো মানুষের মৃত্যুর পূর্বে অথবা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থাকতে আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে মানুষের ভালো কাজের স্বীকৃতি দেয়া বা পাওয়া কে অনেকের কাছে যেন মনে হয় অন্যায় একটি কাজ।
মানুষের কাছ থেকে কিছু পেতে হলে তার কর্মের স্বীকৃতি দিতে হয়,তা আমরা খুব ভালো করে জানি । আমরা এটাও জানি, যেখানে গুণীজনের সম্মান নেই, সেখানে গুণীজন জন্মায় না। আমরা এইসব সুন্দর তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যকথা বিভিন্ন সভা সেমিনার,আলোচনায় বলতে ভালো পাই, কিন্তু বাস্তবে চর্চা করতে পারি না। মেনে নিতে কষ্ট হয়।
মানুষ সাধারণত যা দেখে তাই শিখে । আমাদের জাতীয় পর্যায়ে গুণীজনের সম্মাননার ক্ষেত্রে যা দেখছি তাই আমরা ধারণ করছি এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় তা প্রচলন করার চেষ্টা করছি। আমরা রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে গুণীজনের সম্মাননা ক্ষেত্রে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই, কোনো নিদৃষ্ট বিষয়ে সর্বোচ্চ অবদান রাখা ব্যক্তিটি যদি রাজনৈতিক ভাবে ‘ক’ দলের সমর্থক হন আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যদি ‘খ’ দল থাকে তাহলে, কম যোগ্যতা বা অবদান রাখা ‘খ’ দলের অনুসারী ব্যক্তিই রাষ্ট্রিয় সম্মাননা পেয়ে থাকেন। এর ফলে যোগ্য ব্যক্তিদের অবমূল্যায়ন হয়, এই অবমূল্যায়নে যোগ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে নতুন উদ্যোমে আরো ভালো কিছু পাওয়া থেকে আমরা বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি সমাজের অন্যরা ভালো কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
আবার অনেক সময় দেখা যায় আমাদের হীনমন্যতার কারণে সঠিক সময় সঠিক মানুষের মূল্যায়ন না করে তার মৃত্যুর পর তাকে ঘটা করে ‘মরণ উত্তর সম্মাননা’ প্রদান করা হচ্ছে। এ লোক দেখানো সম্মান যেমন সে অনুভব করতে পারে না, তেমনি সমাজও তার কাছ থেকে নতুন উদ্যোমে পাওয়ারও কিছু থাকে না।
আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়ার জীবদ্দশায় আজিজুল পারভেজের এরকম একটি উদ্যোগ গ্রহণ করায় তাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগকে উদাহরণ হিসেবে সামনে রেখে অন্যরাও সমাজে অবদান রাখা মানুষের জীবদ্দশায় মূল্যায়নে উদ্যোগী হবেন। যার মাধ্যমে সমাজ এবং সংস্কৃতির বন্ধন অটুট হয়ে সমাজকে আলোকিত করবে।
অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া এই নামটি সেই ছোট বেলা থেকেই জানতাম, যখন ক্লাস চতুর্থ অথবা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমার চাচাতো বোন ফজিলা আক্তার ডলি তখন বিয়ানীবাজার কলেজে লেখা পড়া করতেন। বিভিন্ন সময় ডলি আপা তার ক্লাসমেইট অথবা অন্যদের সাথে বাড়িতে কলেজ সংক্রান্ত বিভিন্ন আলাপ কালে কিবরিয়া ভাইয়ের নামটি উচ্চারিত হতো। তাদের আলাপের মধ্যে কিবরিয়া ভাইয়ের রাজনীতি এবং একজন সু-বক্তার প্রসঙ্গ আসতো।
রাজনীতি কী আর বক্তা কী তা বুঝার বয়স তখন ছিল না । কিন্তু বারবার আমার সামনে নামটি উচ্চারণ করাতে তা অন্তরে বিধে যায়। কিবরিয়াভাই – কে, তাকে দেখা বা জানার আমার সুযোগ ছিল না বা প্রয়োজনও ছিল না। লেখাপড়ার ধারাবাহিকতায় আমি যখন বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজে ভর্তি হই তখন আমাদের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে কিবরিয়াভাইকে পাই। কলেজের অন্যান্য শিক্ষকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলেও তাকে ‘কিবরিয়াভাই’ বলে সম্বোধন করতাম।
পূর্বে কিবরিয়াভাই ছাত্র রাজনীতি করতেন, সেই সূত্রে আমাদের সিনিয়ররা তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন, তাদের ধারাবাহিকতায় আমরাও ‘ভাই‘ বলতাম। আমাদের কাছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে ‘কিবরিয়াভাই’ সম্বোধনকে তিনি স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতেন। ‘স্যার’ এবং ’ভাই’ সম্বোধনে আমাদের মধ্যে কখনও কোন ভাবে বিন্দুমাত্র বিব্রত বা দ্বিমত প্রকাশ করেননি। বরং তার অভিব্যক্তি বলে দিত, আমরা তার আপনের চেয়েও আপন ।
আমাদের সময় কলেজের প্রত্যেক শিক্ষক- শিক্ষিকা পাঠদান ক্ষেত্রে অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তাদের ঋণ শোধ করার নয়। তবে যে দুজন শিক্ষকের কথা এখনও আমাদের আড্ডায় বারবার অত্যন্ত শ্রদ্ধায় উচ্চারিত ও আলোচিত হয়, তারা হলেন তৎকালীন কলেজের অধ্যক্ষ বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক মাহবুবুর রশীদ চৌধুরী ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রভাষক গোলাম কিবরিয়া। আমি বিশ্বাস করতে চাই , তাদের জ্ঞানলব্দ ও জাদু মিশ্রিত পাঠদান যারা শ্রবণ করেছে, তারা কোনো দিনই তাদের ভুলার নয়।
যে কোন বিষয় শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপনার জাদুকরী ভঙ্গি ছিল। তারা প্রকৃত অর্থেই জানতেন। তারা সামগ্রিক বিষয়ে জ্ঞান রাখতেন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে তাদের দূরত্ব ছিলনা। আমরা দেখেছি কলেজের অন্যান্য শিক্ষকের ক্লাস অনেকে ফাঁকি দিলেও এই দুই শিক্ষকের ক্লাস ফাঁকি দিত না। ক্লাসে থাকত পিন-পতন নিরবতা। কিবরিয়া ভাই যখন ক্লাসে আসতেন তখন একজন রাজনৈতিক নেতার মতো ডায়াসে দাঁড়িয়ে পাঠদান করতেন।
আমাদের গোলাম কিবরিয়া স্যার ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন।প্রগতিশীল ধারার ছাত্ররাজনীতিতে তার একটা সুপরিচিতি ছিল। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম একজন হিসাবে কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদিতে তিনি ছিলেন এই অঞ্চলের অগ্রগণ্য ছাত্র। দীর্ঘদেহী শারিরীক গঠন এবং চলনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্মার্ট ও ব্যক্তিত্ববোধের একজন। সুতরাং তার ভরাট কন্ঠে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাস কী রকম হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। স্যারের ক্লাসে পাঠদানের সময় পুরো ক্লাসে পিন -পতন নিরবতা থাকতো। স্যার কোন বিষয়ে যখন পাঠদান করতেন তখন, এতোই গভীরে ঢুকতেন যে, ৪৫ মিনিটের ক্লাস কখন শেষ হয়েছে বলাই যেত না। এমনও হয়েছে, অতিরিক্ত সময় স্যার ক্লাস করিয়েছেন নিজের অজান্তেই। কখন ঘন্টা বেজেছে তার খেয়ালেই ছিল না।
একটা বিষয় আমার কাছে অভাবনীয় ছিল,অনেক সময় গোলাম কিবরিয়া স্যার ক্লাস শেষে আমাদের সাথে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে গল্প করতেন, আমরাও তা আগ্রহের সাথে শুনতাম ।
খ.
একজন শিক্ষকের বাহিরে অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া কে দেখেছি একজন সার্বজনীন মানুষ হিসেবে। তিনি সকল স্তরের মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারতেন এবং মিশতেন । তাঁকে সাংস্কৃতিক ক্লাবে তাঁর চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠের সাথে খেলতে যেমন দেখেছি তেমনি গোলাবিয়া লাইব্রেরীতে তার জুনিয়রদের সাথে আড্ডা মারতেও দেখেছি। বাজারে গ্রামের সাধারণ মানুষের সাথে সহজ ভাষায় তাদের মতো হয়ে যেমন কথা বলতে দেখেছি, তেমনি হাটে -ঘাটে যেখানেই তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের পেয়েছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে তাদের খোঁজ -খবর নিতে দেখেছি। মানুষের সাথে সহজে মিশার এই অসাধারণ গুণটি তাঁর মধ্যে অনুকরণীয় হয়ে আছে।
কিবরিয়াভাইর সাথে সামাজিক একটি কাজে আমার স্মৃতি রয়েছে, তা হল বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রে। ১৯৯৪ সালে আমরা যখন এই কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখন দক্ষিণ বিয়ানীবাজার ও সোনাই নদী বেষ্টিত বড়লেখা উপজেলার এই অঞ্চলের ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের সহযোগিতা পাবার আশ্বাস রেখেই কলেজের প্রাথমিক কাজ শুরু করি। যদিও সমস্ত বিয়ানীবাজার উপজেলা তথা সকল এলাকার মানুষের সহযোগিতা পাবার আশা ছিল এবং পেয়েছিও । দক্ষিণ বিয়ানীবাজারের সীমারেখা ছিল মোল্লাপুর ইউনিয়ন, লাউতা ইউনিয়ন ও মুড়িয়া ইউনিয়নের পূর্ব অংশ অর্থাৎ পূর্ব মুড়িয়া। এই বিশাল অঞ্চলের প্রায় ৩৮ জন সমাজ সচেতন লোকের তালিকা করে তাদেরকে নিমন্ত্রণ করার মাধ্যমে আমাদের এ যাত্রা শুরু করি। কিবরিয়াভাই ব্যস্ত থাকায় প্রথম পর্যায়ের চার -পাঁচটি সভায় উপস্থিত না থাকলেও পরবর্তীতে অনেক সভায় উপস্থিত থেকে সহযোগিতা করেছেন। আমরা যখন এই কলেজের কাজ শুরু করি তখন, কলেজের নাম “বিয়ানীবাজার মহিলা কলেজ” নির্ধারণ করি এবং সেই অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা করি। কিবরিয়াভাই যে সভায় প্রথম উপস্থিত হন সেই সভায় এলাকার সাধারণ মানুষদেরকেও উপস্থিত থাকার আহবান করা হয়েছিল বিধায় অন্যান্য সভা থেকে এই সভায় লোক সমাগম বেশি হয়।তারিখটা ছিল ২৩ মার্চ ১৯৯৪ সাল। সকলের অবগতির জন্য তাদের সামনে প্রস্তাবিত কলেজের নাম “বিয়ানীবাজার মহিলা কলেজ” নির্ধারণ করে আমরা এর কার্যক্রম শুরু করছি, তাতে উপস্থিত কারও দ্বিমত আছে জানতে চাইলে উপস্থিত সবাই এই নামের পক্ষে সমর্থন করে।
তবে কিবরিয়াভাই সমর্থন করে বল্লেন ইতিপূর্বে বিয়ানীবাজারে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাদের প্রস্তাবিত নাম ছিল “বিয়ানীবাজার মহিলা কলেজ “। তারা প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও তাদের প্রস্তাবিত নাম থেকে একটু পরিবর্তন করে নাম রাখাটা ভালো দেখায়। তিনি প্রস্তাবিত নামের সাথে ‘আদর্শ’ শব্দটি যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। উপস্থিত সকলে কিবরিয়া ভাইয়ের প্রস্তাবে একমত হন এবং আমাদের প্রস্তাবিত নামের সাথে ‘আদর্শ’ শব্দটি যুক্ত করে নাম রাখা হয় ” বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজ “। কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা সহ সামাজিক অসংখ্য কাজে তার অবদান রয়েছে।
অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া হচ্ছেন কালের নবদ্বীপের অন্যতম ‘একজন সাংস্কৃতিক দূত’। বিয়ানীবাজারে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের একজন কর্মী হিসাবে দেখেছি তার সাহিত্য সংস্কৃতি র প্রতি অগাধ প্রেম এবং তা তরুণ-তরুণীদের মাঝে ছড়িয়ে দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টা। বিয়ানীবাজারে আমাদের সময়ে প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ এবং বিশেষ করে বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার চারণ ক্ষেত্র ছিল বলে বিশ্বাস করি। এই কলেজের একজন ছাত্র এবং পরবর্তি পর্যায়ে ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- অধ্যক্ষ মাহবুবুর রশীদ স্যার এবং গোলাম কিবরিয়া স্যারের মতো সাহিত্য সংস্কৃতি মনস্ক স্যারদের সরাসরি অংশগ্রহন, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমরা কলেজের ইতিহাসে স্বর্ণালী দিনগুলো প্রগতিশীল ও বুদ্ধি বিত্তিক চিন্তা ও চর্চায় পার করেছি।
একটা বিষয় লক্ষণীয় আমার কাছে, এই দুই স্যারের সংস্পর্শে থাকা শিক্ষার্থীরা দেশে বিদেশে কোন না কোন ভাবে আলোকিত হয়েছেন। অর্থাৎ সাহিত্য সংস্কৃতির বলয়ে থাকায় তারা আর যাই হোক একটা গ্রগতিশীল চিন্তার ক্ষেত্র এবং এর অসীম আনন্দের উপকরণ জেনেই বড় হয়েছেন। অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া আমাদের বিয়ানীবাজার তথা সিলেটের একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেও অমর হয়ে থাকবেন এই বিশ্বাস আমাদের বদ্ধমূল আছে।
এ সমস্ত কাজের বাহিরেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সাথে রয়েছে বড় একটি স্মৃতি।আমার ঠিক স্বরণ নেই,সম্ভব কিবরিয়া ভাই ১৯৯৪ অথবা ১৯৯৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। এই সময় বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কমিটিগুলো ছিল গতিশীল । উপজেলা সহ ইউনিয়ন পর্যায়ের সকল শাখা কমিটিও ছিল অত্যন্ত সু-সংগঠিত। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিয়ানীবাজার শাখাতে ছিল একঝাঁক বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক কর্মী। বলা হয়ে থাকে, সে সময়ে-ই ছিল বিয়ানীবাজার উপজেলার সবচেয়ে সু- শৃঙ্খল একটি আদর্শিক সংগঠন।
বিয়ানীবাজারে তখন অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও ছাত্রলীগের তুলনায় তা ছিল নগন্য। সেই সময় বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে একটি পদে কোনো একটি কারণে মতপার্থক্য দেখা দিলে ঐ একটি পদে তিনজন ছাত্রলীগ কর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং নিজেদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রথম এবং দ্বিতীয়ত স্থান অধিকার করেন। এই ছিল তখন বাংলাদেশ ছাত্র লীগের সাংগঠনিক অবস্থা।
নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব তখন গণফোরামের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন এবং দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান।তার সাথে বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী,যুবলীগ ও ছাত্রলীগের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে একে অন্যের সাথে জানা-শোনার কথা থাকলেও নুরুল ইসলাম নাহিদ এর বেলায় তা ছিল না। কারণ তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনো এলাকার কোনো বিষয়ে ভূমিকা রাখেন নি। তিনি যে একজন রাজনৈতিক নেতা বা এই এলাকার সন্তান- তা সকলে জানতে পেরেছে ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধিন আট দলীয় জোটের শরিক দল কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আসলে মানুষজন তখনই জানতে পারে তিনি এই এলাকার সন্তান।
নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব আওয়ামী লীগে যোগদান সিলেট জেলা ও বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগ আন্তরিক ভাবে মেনে নিতে পারে নি। যেহেতু গণ সংগঠন আওয়ামীলীগ আন্তরিকভাবে তাকে মেনে নেয়নি, স্বাভাবিক ভাবে এর প্রভাব পড়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উপর। এভাবে অনেক দিন চলে যায়। বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের উপজেলা অথবা ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো সভাতে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয় নি।
দুঃখ জনক হলেও সত্য নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব একজন কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এলাকায় আসলে একা একা চলতে হত। নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের এই অবস্থা নিরসনে এগিয়ে আসেন কিবরিয়াভাই। তিনি টারগেট করেন ছাত্রলীগকে। সেই হিসেবে আমাদের উপজেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন আহ্বায়ক আব্দুল বারী ও বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জি এস এনাম উদ্দিনের সাথে বিষয়টি নিরসন কল্পে প্রাথমিক আলাপ করেন। এই দুই নেতা আমরা যারা সংগঠনের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের ছিলাম তাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তখন কয়েক মাস পর ছিল আমাদের কলেজ ছাত্র-সংসদ নির্বাচন। আমি ছিলাম নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য ভিপি পদপ্রার্থী। আমাদের সামনে যখন ছাত্র-সংসদ নির্বাচন তখন নির্বাচনকে মূল কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয় এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় কলেজে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রায় সময় চিহ্নিত কিছু মানুষ অন্যায় আবদার করে যে সমস্যা সৃষ্টি করে তাদের ব্যাপারে সামান্য হলেও নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের কিছু করার আছে, তা যদি তিনি করতে পারেন তাহলে আমরা ছাত্র-সংসদ নির্বাচন হওয়ার পর ছাত্রলীগের সর্ব শক্তি নিয়ে তার পক্ষে কাজ করব। আমাদের এই সিদ্ধান্তটি আব্দুল বারী ও এনাম উদ্দিনের মাধ্যমে কিবরিয়া ভাইকে জানিয়ে দেয়া হয়। কিবরিয়া ভাই নাহিদ সাহেবের সাথে আলোচনা করে তাদের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বলে আমাদেরকে জানিয়ে দেন। কলেজ ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের পেনেলে আমাদের চিন্তার প্রতিফলন সহ সকল প্রার্থী বিজয়ী হলে, কিবরিয়াভাইকে দেয়া আমাদের কথা রক্ষা করি। তখন ছাত্রলীগের তত্বাবধানে বিয়ানীবাজার উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নাহিদ সাহেবকে নিয়ে সভা সমাবেশ শুরু হয়। যা ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে বিজয়ী করা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই বিজয় ছিল নাহিদ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের টার্নিং পয়েন্ট । বিজয়ী না হলে তাকে রাজনীতির এই পর্যায় থেকে বিদায় নিতে হত। কারণ ইতিপূর্বে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করে গণফোরামে যোগদান করেন। এবং পরে, গণফোরাম ছেড়ে আওয়ামীলীগে যোগদানের মাধ্যমে আদর্শ চ্যুতির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই সময়ের এদতঅঞ্চলের ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের অনেক বর্ষীয়ান নেতাদের মতো আমরাও বিশ্বাস করি, নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের আজকের এই রাজনৈতিক অবস্থানের পিছনে অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া সাহেবের অবদান অনস্বীকার্য।
অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়ার এবং আমাদের অনেকের শ্রদ্ধেয় কিবরিয়াভাই অবসর জীবনে আছেন। জটিল রোগে তিনি আক্রান্তের খবরটি তার অগণিত শিক্ষার্থী, সহকর্মী, কর্মকর্তা ও স্বজনদের মর্মাহত করেছে। দোয়া করছি তিনি সুস্থতা নিয়ে অনেক দিন আমাদের মাঝে বেচে থাকুন। মহান আল্লাহ তাকে আগের মতো শারিরীক ও মানষিক শক্তি দান করুন যাতে তিনি আলোকিত সামাজিক কাজের মাধ্যমে সমাজে আরও আলো ছড়াতে পারেন। এই সমাজে অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়ার মতো মানুষের খুব প্রয়োজন।
২৪ অক্টোবর ২০২০
ছরওয়ার আহমদ :সাবেক ভিপি ১৯৯৫-৯৬ সাল , বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ, সিলেট । সংগঠক, স্যোসাল একটিভিস্ট।
লন্ডন ,যুক্তরাজ্য ।
আরও পড়ুন: