ক.
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বন্ধু মুস্তাফিজ শফি’র ৫০তম শুভ জন্মদিন কে স্বরণীয় রাখার প্রয়াসে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সম্পাদনায় একটি স্বারক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগে ভীষণভাবে প্রাণীত হয়েছি।এবং সেই উপলক্ষে বন্ধুকে নিয়ে লেখার বিশেষ সুযোগটি সৃষ্টির জন্য স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের সাথে সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
কবিতা,ছড়া,প্রবন্ধ,সাংবাদিকতা,সংস্কৃতি, ও রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততা থাকলেও মুস্তাফিজ শফি’র প্রধান পরিচয় সাংবাদিক হিসেবে। তরুণ বয়স থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক – দৈনিক লাল সবুজ, আজকের কাগজ, প্রথম আলো, মানব জমিন, সমকাল ও কালের কণ্ঠ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে কাজ করে।এবং বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করে অগণিত পাঠকদের কাছ থেকে অনেক ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। তার অনেকগুলো অনুসন্ধানী রিপোর্ট গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং যা বিভিন্ন বিশ্ব বিদ্যালয়ে সহায়ক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হচ্ছে। এছাড়াও ইতিমধ্যে মুস্তাফিজ শফি’র গল্প, কবিতা,ছড়া,প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বই। সঙ্গত কারণে তাকে নিয়ে লেখার এবং মূল্যায়ন করার উদ্যোগে বিজ্ঞ ও বিদগ্ধজনদের লেখার মাধ্যমে আমরা অন্যরকম একজন মুস্তাফিজ শফিকে খুজে পাবো।
মুস্তাফিজ শফি, যার সাথে আমার কৈশোর ও যৌবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। রয়েছে অগুনতি অমৃত স্মৃতি। মুস্তাফিজ শফি ও আমার পাশাপাশি গ্রামে বসবাস। যদিও দুটি গ্রাম কিন্ত আমাদের অবস্থান ছিল কাছাকাছি। সেই সুবাদে বাল্যকাল থেকে তাঁকে আমি চিনতাম। তবে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল না।
হাইস্কুল জীবনে একই স্কুলে পড়ার সুবাদে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমরা দুজন জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। মুস্তাফিজ শফি ও আমার স্কুলে যাওয়া- আসার রাস্তা ছিল এক। তখন পায়ে হেঁটে প্রতিদিন আমাদের প্রধান সড়ক বিয়ানীবাজার-বারইগ্রাম রাস্তা দিয়ে আমাদেরকে স্কুলে যেতে হত। এক সাথে স্কুলে যাওয়া -আসার পাশাপাশি স্কুলে বিভিন্ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।
স্কুল বিষয়ক কর্মকান্ডের বাহিরেও তার সাথে স্কুলজীবন থেকে ছিল হার্দিক সম্পর্ক। পরিণত বয়সে এসে আমার মনে হয়েছে আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন ঘনিষ্টতার অনেক যৌক্তিক কারণও আছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে, স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠতার অন্যতম কারণ ছিল- আমরা দুজনেরই সবুজ ও ফুলের প্রতি গভীর প্রেম। ফুল ও সবুজকে আমরা অনেক ভালোবাসতাম এবং বলতে গেলে এই ভালোবাসা আজও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। আমরা ফুল ও সবুজ’কে এখনো আমাদের জীবনের অংশ ধরে নিয়েই যাপিত জীবন পার করছি । স্কুল জীবনে আমরা উভয়েরই বাড়ীতে নিজের করা ফুল বাগান ছিল। আমাদের মধ্যে বাগানের সৌন্দর্য বর্ধন করা বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছ সংগ্রহের প্রতিযোগীতা ছিল। আমরা কিছুদিন পরপর একে অন্যের বাগান দেখতে যেতাম। তার মূলকারণ ছিল – কার বাগানে কত জাত ফুলের সংগ্রহ রয়েছে । এ নিয়ে আমাদের ভিতরে ভিতরে এক ধরনের প্রতিযোগীতা ছিল। আমাদের এই প্রতিযোগীতায় আরও একজন সাথী ছিল- জলঢুপ আষ্টসাঙ্গনের আব্দুল মান্নান।
মুস্তাফিজ শফি এই সমস্ত কর্মকান্ডের বাহিরে স্কুল জীবন থেকে লেখা -লেখির সাথে সম্পৃক্ত হয়। ১৯৮৭ সালে আমাদের জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম দেয়ালিখা ‘হাতেখড়ি’ প্রকাশিত হয় তার সম্পাদনায়। প্রথম দেয়ালিখাটির সহ- সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিক আজিজুল পারভেজ। স্কুলজীবনের গন্ডি পেরিয়েই পাশাপাশি সময়ে মুস্তাফিজ শফি সম্পাদক ও আজিজুল পারভেজ সহ-সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে বিয়ানীবাজার থেকে প্রকাশিত হয় ‘উদ্দীপন’ নামের মাসিক ম্যাগাজিন। এর মাধ্যমে মুস্তাফিজ স্থানীয় ভাবে সকলের কাছে একজন লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তার এই ধারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে অব্যাহত রাখার মাধ্যমে সে আজ জাতীয় ভাবে সুনামধন্য লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে যা আমাদের জন্য গৌরবের।
কলেজ জীবনে পদার্পণের পর মোস্তাফিজ শফি’কে দেখেছি একজন সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী,কবি,ছড়াকার ও ছাত্র নেতা হিসেবে। এই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও ছাত্র রাজনীতিতে তার সাথে রয়েছে বহু স্মৃতি ।
রাজনীতি, সংস্কৃতি আর সাংবাদিকতা প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ছিল স্বচ্ছতার ছাপ। এই ধারা আজ অবধি অব্যাহত রাখতে পেরেছে বলেই জাতীয় পর্যায়ে লেখালেখির জগতে পাঠক-সমালোচকদের কাছে বিশ্বাসের একটি মজবুত স্থান করে নিতে পেরেছে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বর্তমানে আমাদের স্থানীয় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীনদের অদূরদর্শিতা ,নৈতিকস্খলন , অনিয়ম, ব্যক্তিস্বার্থ, পদলেহন, পক্ষাবলম্বন অথবা সাংবাদিকতার নামে যখন হয় হলুদ সাংবাদিকতার চর্চা , তখন বিভিন্ন আড্ডায়, সভায়, আলোচনায় বিয়ানীবাজারের সাংবাদিকতার স্বর্ণ যোগ হিসেবে মুস্তাফিজ শফিদের আগের এবং তাদের সময়কে ধরে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এবং খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে মুস্তাফিজ শফি সহ সে সময়ের অনেক অগ্রজ সহ প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিকদের নাম আলোচনায় আসে। স্থানীয়ভাবে কাজ করে যাবার ৩০ /৩২ বছর পরও যখন তার নাম বিভিন্ন আলোচনায় ইতিবাচক ভাবে উচ্চারিত হয়, তখন মনে হয় -এটাই সত্য, একজন সংবাদকর্মীর পেশাগত জীবনের বড় স্বার্থকতা ।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদের সাথে মুস্তাফিজ শফি ছিল সরব। তখন স্কুল কলেজের বাহিরে আমাদের উপজেলা সদরে তেমন কোন সাংস্কৃতিক চর্চা চোখে পড়ে নি। মাঝে মধ্যে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর দু-একটি অনুষ্ঠান দেখা গেলেও সে ক্ষেত্রে বিয়ানীবাজারের সামাজিক সংগঠন ‘কন্ঠকলি সংসদ’ ছিল সরব। মূলত এই সংগঠনটির পরিচালনা ও অর্থ যোগান দিতেন শতরূপা ফটোগ্রাফার্স এর সত্ত্বাধিকারী ‘কন্ঠকলি সংসদের’ প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মীর হোসেন আল মোহাম্মদী খোকন। মাঝেমধ্যে বড় অনুষ্ঠান হলে চাঁদা সংগ্রহ হত একান্ত পরিচিত দু-এক জনের কাছ থেকে। সংগঠন পরিচালনার ধরাবাহিকতার এক পর্যায়ে আমরাও খোকন ভাইর সহ যাত্রী হই। বিশেষ করে তখন আমাদের ১৭জনের একটি গ্রুপ ছিল, যারা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। যাদের ‘শতরূপা ফটোগ্রাফার্স ‘ কেন্দ্রিক আড্ডা ছিল। এখানে ১৭জনের বাহিরে আমাদের শুভকাঙ্খি ছাত্রলীগ সমর্থক অনেকেই আসত, যারা ছিল আমাদের সৃজনশীল কাজের প্রেরণার উৎস। তার মধ্যে মুস্তাফিজ শফি ও সাংবাদিক আজিজুল পারভেজ অন্যতম। এই ‘শতরূপা ফটোগ্রাফার্স ‘ কেন্দ্রিক আড্ডার সদস্যরা মিলেই মূলত এই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতাম। সে সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ বা পেন্ডেল আমরা নিজেরা তৈরী করতাম। মঞ্চের জন্য প্রয়োজন হত বাঁশের। এবং এই বাঁশগুলো প্রধানত আমরা বিয়ানীবাজার উপজেলা সদরের পাশের গ্রাম দাসগ্রামের লাল মোহন শর্মার বাড়ি থেকে বিনে পয়সায় সংগ্রহ করতাম। লাল মোহন শর্মা এবং তার পরিবার ছিলেন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক। বিনামূল্যে এবং যখন যতটি প্রয়োজন, সব বাঁশ আমাদের মূলত সহাস্যে নেবার অনুমতি দিতেন প্রয়াত লাল মোহন শর্মা ( বকুল বাবু ‘র) স্ত্রী শিক্ষিকা শীলা দেবী চৌধুরী।( শ্রদ্ধেয় এই চাচী, তৎকালীন গৌরী নাথ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শীলা দেবী চৌধুর ‘র ঋণ কোন দিন শোধ হবার নয়, তার ও পরিবারের প্রতি আমাদের সকলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি)।
আমরা তাদের বাড়ী থেকে নিজ হাতে বাশঁ কেটে, কাঁধে করে উপজেলার মেইনরোড দিয়ে বিয়ানীবাজারের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে এসে অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরী করতাম । এই কাজে আমাদের সাথে বেশিরভাগ সময় থাকতেন বন্ধু জাহেদ মাহমুদ আজিজ সুমন, মিছবাউর রশীদ খান কপিল , সাংবাদিক আজিজুল পারভেজ ও মাহমুদুর রহমান খান সুলতান। আজকের দিনে প্রায় মাইল দূর থেকে কাঁধে করে বাঁশ এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরী করবে একজন কলেজ ছাত্র – তা বোধকরি ভাবা-ই যায় না। এ ধরনের শিক্ষা আমরা পেয়েছি মূলত রাজনীতিতে আমরা যাদের অনুসারী ছিলাম তাদের কাছ থেকে।
পুরনো স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে আজ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমাদের অগ্রজ নেতাদের, যাদের অনুপ্রেরণা ও সাহসের বদৌলতে আমরা করতে পেরেছিলাম কিছু সৃজনশীল কাজ, তারা হলেন, বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজের সাবেক ভিপি নজমুল ইসলাম, জিএস আলাউদ্দিন, ভিপি শ্রী বিবেক আনন্দ দাস নান্টু, কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ, নূরুল আম্বিয়া ও ছাত্র লীগ নেতা মুজিবর রহমান ( সুনামগঞ্জ )। এছাড়াও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জাসদ নেতা ওয়েছুর রহমানের সহযোগিতাও আমরা পেয়েছি।
আমাদের সময় ইলেকট্রনিক প্রচার মাধ্যম বা বিনোদনের ক্ষেত্রে রেডিও ছিল মূল ভরসা । এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৈদ্যুতিক সুবিধা না থাকায় খুবই কম পরিবারে টেলিভিশন ছিল। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি সহ রেডিওতে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সিলেট বেতার কেন্দ্রের সহযোগিতায় আমরা গঠন করেছিলাম রেডিও শ্রোতা ক্লাব।
অন্তরা সঙ্গীত বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন সিলেট বেতারের নিয়মিত শিল্পী নুরুল ইসলাম সরকার । শিল্পী নুরুল ইসলাম সরকার ও শ্রোতা ক্লাব সূত্রে সিলেট বেতারের সাথে আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং পরবর্তীতে সিলেট বেতারের আহবানে আমরা বিয়ানীবাজার থেকে প্রথম আমাদের সংগঠন কন্ঠকলি সংসদ কর্তৃক পরিচালিত ‘অন্তরা সংগীত বিদ্যালয়র’ এর শিল্পীদের নিয়ে এক ঘন্টার একটি গানের অনুষ্ঠান করতে সমর্থ হই।
প্রসঙ্গত, তখন অন্যান্যদের পাশাপাশি আমি ও জাহেদ মাহমুদ আজিজ সুমন ছিলাম অন্তরা সংগীত বিদ্যালয়ের ছাত্র। এসব কাজে মুস্তাফিজ শফি সহ আমাদের গ্রুপের সকলের আন্তরিক সম্পৃক্ততা ছিল। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হয়, আমাদের এই ‘অন্তরা’ সংগীত বিদ্যালয় ২০০০ সালে বাংলাদেশের একমাত্র টেলিভিশন বিটিভি তে বৃহত্তর সিলেটের (বর্তমান সিলেট বিভাগের ) মধ্যে প্রথম এক ঘন্টার একটি আঞ্চলিক গানের অনুষ্ঠান ‘নিবেদন’ করতে সক্ষম হয়। তখন বেসরকারি টেলিভিশন ছিল এটিএন বাংলা, যা বাংলাদেশের অল্প কিছু অঞ্চলের মানুষ যাদের ডিস সম্প্রচার সুবিধা ছিল তারা এই টিভির অনুষ্ঠান দেখতে পারত।
খেলার ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধু বা নেতাদের ঝুঁক কম থাকলেও মীর হোসেন আল মোহাম্মদী খোকন ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে তার খেলার সরঞ্জামাদি দিয়ে বিয়ানীবাজার কলেজের পার্শ্ববর্তী পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ছোট মাঠের বন পরিস্কার করে আমরা বন্ধু -বান্ধব এবং আমাদের নেতারা মিলে ক্রিকেট খেলা শিখতাম খোকন ভাইয়ের কাছ থেকে। ১৯৮৮ সালের কথা, তখন এই খেলা বাংলাদেশে জনপ্রিয় ছিল না। এলাকার লোকদের কাছে খেলাটি অপরিচিত থাকায় তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। অনেকে আগ্রহ নিয়ে জিঙ্গেস করতেন এই খেলার নাম কি এবং খেলার পদ্ধতি কীরকম ? আজ সময়ের ব্যবধানে এই খেলাটি গোটা বাংলাদেশ সহ আমাদের অঞ্চলের সর্বত্র জনপ্রিয়।
ঙ.
সাংবাদিকতা, কবিতা ,সাহিত্য , সংস্কৃতিক চর্চা,খেলাধুলার পাশাপাশি মুস্তাফিজ শফি আমাদের সাথে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। তখন রাজনীতিতে ছিল অন্য ধরনের আবহ। ছাত্র সংগঠনগুলোর নিয়মিত সম্মেলন ও কমিটি গঠন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের কলেজে ছাত্র-সংসদ নির্বাচন হত ধারাবাহিক নিয়মে । ছাত্র-সংসদ থাকায় কলেজে খেলাধুলা সহ সংস্কৃতি চর্চার একটি সুন্দর পরিবেশ ছিল। আজকের মত তখনও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছিল সর্ববৃহৎ সংগঠন। কলেজের প্রতিটি ছাত্র -সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের ছিল একক আধিপত্য ।
১৯৮৯ সালে কলেজ ছাত্র-সংসদের বিতর্কিত একটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অংশ গ্রহণ নিয়ে নীতিগত ভাবে আমাদের সাথে দলের অন্যান্যদের মতপার্থক্য দেখা দেয়। এক পর্যায়ে নির্বাচনে দু-পক্ষের আলাদা দুটি প্যানেল জমা পড়ে। একটি ছিল আম্বিয়া-সুলতান পরিষদ। অন্যটি জাকির-হাছনাত।
আমরা ছিলাম আম্বিয়া-সুলতান পরিষদের পক্ষে। প্রতিপক্ষ নির্বাচনী প্রচারে আমাদেরকে বাধা প্রদান করলে আমরা রুখে দাড়াই। এতে কলেজ ক্যাম্পাসে সংঘাতে রূপ নেয়। এই প্রতিরোধ ছিল বিয়ানীবাজারের রাজনীতিতে আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রথম কোন প্রতিরোধ।
সেদিন আমাদের প্রতিপক্ষের অন্যায় আচরণ প্রতিরোধে আমাদের সাথে যারা ছিলেন তারা হলেন আব্দুল হামিদ, নূরুল আম্বিয়া,কামাল হোসেন,বদরুল হোসেন বদই, খয়রুল হক, শামীম আহমদ,ময়নুল ইসলাম লিটন,এনাম উদ্দিন, ছরওয়ার আহমদ,মাহমুদুর রহমান খাঁন সুলতান,জাহেদ মাহমুদ আজিজ সুমন,মিছবাউর রশীদ খাঁন কপিল, আজিজুল পারভেজ, মস্তাক আহমদ, বুরহান উদ্দিন , ওয়ালী মাহমুদ ও সাব্বির আহমদ হীরা ।
নির্বাচনটি অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হতে যাচ্ছিল বিধায় কলেজ ক্যাম্পাসে সক্রিয় সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল, জাসদ ছাত্রলীগ সহ আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একাংশ নির্বাচন বর্জন করি। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাতের আশংকা দেখা দিলে বিয়ানীবাজারের সুশীল সমাজ, উপজেলা প্রসাশন ও কলেজ প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে নির্বাচনের আগের দিন বিকালে নির্বাচন বর্জনকারী সকল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নিয়ে টিএনও অফিসে এক বৈঠকে – বিয়ানীবাজার কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন স্থগিদের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সার্বজনীন সিদ্ধান্ত অমান্য করে পরদিন কলেজ কলেজ প্রসাশন নির্বাচন করতে গেলে
সর্বদলীয়ভাবে নির্বাচন প্রতিহত করা হয়। এবং একপর্যায়ে কলেজ ক্যাম্পাসে সংঘাতে রূপ নেয় । এবং স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনও পন্ডুল হয়ে যায়। এতে দলের অন্যান্যদের সাথে আমাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয় । স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা মেধা, শ্রম ও কৌশল দিয়ে সংগঠনে আমাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সমর্থ হই। এবং মুস্তাফিজ শফি’কে বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত করি। মুস্তাফিজ শফি দক্ষতার সাথে তার সময়কাল অতিবাহিত করে। সংগঠন পরিচালনায় আমরা কখনো মিথ্যার সাথে আপোষ করিনি,বিধায় সময়ের ব্যবধানে আমাদের অনুসারীরা প্রায় সকলেই সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক পদে দায়িত্ব প্রাপ্ত হই এবং বলা যায় সকলেই যার যার অবস্থানে সকলের আস্থাভাজন হয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন।যা অদ্যাবদি বিয়ানীবাজারের সামগ্রিক ছাত্ররাজনীতিতে প্রসংশনীয় উদাহরণ হয়ে আছে।
ছাত্র রাজনীতি সহ অন্যান্য যে সব কর্মকান্ড আমরা তখন পরিচালনা করেছি তার পেছনে মূল শক্তি ছিল আমাদের সাথীদের একে অন্যের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। কারো কোনো সমস্যা হলে মনে হত এটা আমাদের সকলের সমস্যা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তা আমরা সকলে সমাধানের চেষ্টা করতাম। রাজনীতিতে তখন টাকার কোনো ছড়াছড়ি ছিল না । রাজনীতি ছিল আদর্শ ভিত্তিক ও বুদ্ধিভিত্তিক।
কোনো কারণে টাকার প্রয়োজন হলে তা আমাদের সকলের দৈনন্দিন পকেট খরচ থেকে সামান্য করে সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করতাম। আমরা ছোট -বড় যারা একসাথে ছিলাম সকলেই ছিলাম আড্ডাবাজ। ছোট বড় ভেদাভেদ বজায়, শ্রদ্ধা ও সৃজনশীলতা নিয়ে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম। সেই আড্ডায় সমস্ত দিন ঘটে যাওয়া রাজনীতি,সাংবাদিকতা,সংস্কৃতি,লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা হত।
শতরূপা ফটোগ্রাফার্স ছাড়াও পরবর্তী সময়ে আড্ডা বসত দক্ষিণ বিয়ানীবাজারে নিজাম উদ্দিন( মোল্লা ভাই’র) ‘ভাই ভাই কনফেকশনারী’র দোকানে। খোকন ভাই’র পাশাপাশি মোল্লা ভাইও ছিলেন আমাদের আরেক আস্থার ঠিকানা। তখন মোবাইল ফোন ছিল না, ল্যান্ডলাইন থাকলেও তা ছিল স্বল্প পরিসরে। তখন আমাদের বন্ধুমহলে মোল্লা ভাই’কে যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়া হত। কে বাজারে আসল, কে কলেজে গেল ইত্যাদি খবরাদি মোল্লাভাইকে সচেতনভাবেই বলে যাওয়া হত এবং তা তিনি অন্যকে বিশ্বস্থতার সাথে সরবরাহ করতেন। বলা যায় তিনি ছিলেন সেই সময়ের আমাদের বন্ধু বা রাজনৈতিক কর্মীদের একজন ‘বিশেষ দূত‘। এবং তার ‘ভাই ভাই কনফেকশনারী’ দোকানটি ছিল আমাদের অলিখিত অফিস। এখানে আমাদের খুঁজে প্রতিদিন অসংখ্য নেতাকর্মী এসে ভিড় জমালেও মোল্লা ভাই টু শব্দটি করতেন না। মোল্লা ভাই আমাদেরকে অনেক দিন তার দোকান থেকে অনেক কিছু খাইয়েছেন কিন্তু টাকা নেননি। সকলের শ্রদ্ধার প্রিয় মুল্লাভাই ইহ জগতে আর নেই। অনেক দিন হল তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমাদের ছাত্র ও ছাত্ররাজনীতির জীবনে যে দুজন মানুষের ঋণ কোনদিন শোধ করা যাবে না তারা হলেন মোল্লাভাই ও খোকনভাই। নিঃস্বার্থ ভাবে, বড়ভাই এর মতো এই দুই পরোপকারী ব্যক্তিত্ব আমাদের ভালোবাসা , স্নেহ মমতা যেমন দিয়েছেন তেমনি অভিবাবকের মতোও আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন সব সময়।
ছ.
শতরূপা ফটোগ্রাফার্স আর ভাই ভাই কনফেকশনারী’তে আড্ডা ছাড়াও কলেজ পরবর্তী প্রায় প্রতিদিন বিকেল বেলা আড্ডা বসত জলঢুপ বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড ২ এর পাশের বিভূ সেন এর বাড়ীর সামনে। আড্ডায় প্রায় সকলেই ছিল কলেজ ছাত্র এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সমর্থক। আমাদের আড্ডায় রাজনীতি নিয়ে কখনো বিবাদ দেখা দেয়নি। আজ মুস্তাফিজ শফি কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে মনের আয়নায় স্বচ্ছ ভাসছে সেইসব আড্ডা গুলোতে থাকা বন্ধুদের মুখ – তারা হলেন মুস্তাফিজ শফি , বিভূ সেন সহ আড্ডার নিয়মিত বন্ধুরা হল নজরুল ইসলাম চৌধুরী সেজু,জমিল,জাহাঙ্গীর, জয়দুল,লিয়াকত , জাফর ইকবাল প্রমূখ ।
এছাড়া কলেজ বন্ধ থাকলে, প্রায়ই সন্ধ্যার পর আড্ডা বসত জলঢুপস্থ বন্ধু জাফর ইকবালের বাড়ীতে। জাফর ইকবালের বাসায় রাতের আড্ডায় মুস্তাফিজ শফি,আজিজুল পারভেজ,বিভূ সেন, কয়েছ ,জয়দুল ও আমি উপস্থিত থাকতাম । আজ এই সবই এখন স্মৃতি। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে আসলে হারানোর বেদনা উকি যেমন দেয়। তার চেয়ে বেশী স্মৃতিগুলো আমাকে জাগরিত করে। মনে হয় জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় আমরা কাটিয়েছি। যেটা এই সময়ের তারুণ্যরা কোনভাবেই উপভোগ করছে না বা করার চিন্তাও হয়তো করে না।
আমাদের সময়টা জিজিটাল ছিল না। আমাদের সময় আজকের বিয়ানীবাজারের মতো ঐশ্বর্য, চাকচিক্য, সকল উপকরণ সহজলভ্য ছিল না। কিন্ত আমাদের সময়ের বন্ধু, সহপাঠি, রাজনৈতিক সহকর্মী ও অগ্রজদের মাঝে যে শ্রদ্ধা, সৃজনশীলতার চর্চা ও সাংস্কৃতিক মূলবোধ ছিল তা এই প্রযুক্তির যুগে কোনভাবেই নেই-এটা হলফ করে বলতে পারি।
পাশাপাশি আমাদের জন্য আত্ন তৃপ্তির জায়গা হল- আমরা নৈতিকমূল্যবোধের বিচারে কেউই পদচুত্য হইনি। কারো ব্যাপারে সমাজ বিরোধী কোনো অপবাদ নেই, যার জন্য আমাদের সমাজ, শিক্ষাগুরু, পরিবারের কাছে মাথা নিচু হবে। বরং আমরা সকলেই নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত।
ছাত্র জীবনে মুস্তাফিজ শফি লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে সিলেট শহরে চলে যায় এবং সাপ্তাহিক সিলেট কন্ঠ’র স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করে। কিছুদিন সেখানে কাজ করার পর ঢাকায় চলে যায় এবং বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সুনামের সাথে কাজ করতে থাকে।
২০০১ সালে আমি স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাসের উদ্দেশ্যে চলে আসার পূর্ব পর্যন্ত তার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও প্রবাসজীবনের কর্মব্যস্ততার এবং ভৌগলিক সময়ের ব্যবধানে যোগাযোগ কিছুটা ভাটা পড়ে। এরপরও বিভিন্ন সামাজিক,শিক্ষামূলক ও মানবিক ইস্যুতে আমরা এক হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ২০১৫ সালে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলঢুপ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আমরা সমন্ধিতভাবে কাজ করেছি। আমি ছিলাম জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় ৮০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি যুক্তরাজ্য শাখার আহবায়ক এবং মুস্তাফিজ শফি ও আজিজুল পারভেজ ছিল ম্যাগাজিন সম্পাদনার দায়িত্বে। এছাড়াও অন্যান্য দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের সকলের সমন্ধিত প্রচেষ্টায় বিয়ানীবাজারে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অনুকরণীয় সুন্দর অনুষ্ঠান করতে সমর্থ হয়েছিলাম।
এছাড়াও ২০২০ সালে করোনা মহামারীতে দেশের মানুষ যখন অসহায় তখন মুস্তাফিজ শফি নিজ উদ্যোগে অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে ‘করোনা হারবে মানবিকতা হারবে না’ এই শ্লোগান নিয়ে এগিয়ে আসলে তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে ছিলাম। বন্ধু মুস্তাফিজ শফির মানবিক এই উদ্যোগটি অনেকের মতো আমাকেও মুগ্ধ করেছ। ব্রিটেনে থাকা সহপাঠি,পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগ করে যুক্তরাজ্য থেকে পরিচালিত অনলাইন টিভি ও নিউজ পোটাল ৫২বাংলা র যৌথ উদ্যোগে আমরা তহবিল সংগ্রহ করে করোনা সময়ে তার মানবিক কাজের সাথে যুক্ত থাকার আন্তরিক চেষ্টা করেছি।
ঝ.
পঞ্চাশে পা দেয়া মুস্তাফিজ শফির জীবন মূলত অনুপ্রেরণার। শফি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগঠন সব শাখাতে মেধা ও শ্রম বিলিয়েছে আন্তরিকভাবে । সামাজিকভাবে যদি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বাটখারায় সহপাঠি ও বন্ধু হিসাবে তুলে দেখি, তাহলে তাকে নিয়ে আমি পরম তৃপ্তি অনুভব এবং গর্ববোধ করি।
শুভ জন্মদিন মুস্তাফিজ শফি। যতদিন বাচো মুক্ত হয়েই বাচো- প্রার্থনা।
৫ ডিসেম্বর ২০২০ সাল।
ছরওয়ার আহমদ
সাবেক ভিপি ১৯৯৫-৯৬ সাল , বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ, সিলেট । সংগঠক, স্যোসাল একটিভিস্ট।
লন্ডন ,যুক্তরাজ্য ।
আরও পড়ুন: