লেখার মধ্যে, বিশেষত, প্রবন্ধ-এর মধ্যে নৈঃশব্দ্য থাকাটা বাঞ্ছনীয়। খুঁটিনাটি সকল কথা-ই লেখক প্রবন্ধে বলে দিলে পাঠকের কোনও কাজ-ই আর থাকল না। বোদ্ধা পাঠকের অন্যতম কাজ হল, লেখাটি পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে লেখকের সঙ্গে দ্বিরালাপ সৃষ্টি করা। মতের অমিলটাও ক্ষেত্রবিশেষে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পাঠক একটি প্রবন্ধ পাঠের পাশাপাশি নিজস্ব একটি টেক্সট নির্মাণ করবেন, মনে মনে। লেখক যেখানে যেখানে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নৈঃশব্দ্য রেখে গেছেন, পাঠক সেইসব জায়গায় হস্তক্ষেপ করে নিজস্ব অনুভূতি, প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন।
নৈঃশব্দ্য না-থাকার দরুন বিভিন্ন লেখকের লেখা অতিকথনদোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে! ভালো পাঠকের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করে। ফলে, ক্রমে প্রবন্ধের পাঠকসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনও একটি ঘরোয়া আড্ডার কথা; কোনও একজন বক্তা যতই জ্ঞানী-গুণী হন না কেন, এক মুখে যদি আড্ডায় কথা বলতে থাকেন, বাকিদের বলার সুযোগ না-দিয়ে, তখন, বাকি অপেক্ষাকৃত কম গুণী ব্যক্তিরাও বিরক্তিবোধ করেন। প্রবন্ধে নৈঃশব্দ্য না-থাকলে টীকাকারের দরকার হত না। ভালো লেখক তাঁর লেখায় পাঠককে আমন্ত্রণ/প্রত্যাহ্বান করে থাকেন নৈঃশব্দ্যের মাধ্যমে। আর নৈঃশব্দ্য ক্ষেত্রবিশেষে শব্দের চেয়েও শক্তিশালী। মিসাইলের চেয়ে ভয়ঙ্কর। লক্ষ্যভেদে অব্যর্থ। এ-যেন, লাথি না-মেরে শুধু পা-টা দেখিয়ে পায়ের শক্তি কতটুকু, তা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়া। অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নৈঃশব্দ্যেরও ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নৈঃশব্দ্যও একটি মোক্ষম আয়ুধ। কিন্তু সেই অস্ত্রটি কতটুকু শানিত, কতটুকু অব্যর্থ, কতটুকু তার সীমা, তা একজন লেখক তাঁর নিবিড় পাঠের মাধ্যমে স্থির করবেন। ফলে, পাঠক তো বটেই, খোদ লেখককেও তাঁর লেখাটি একাধিক বার পাঠ করতে হয়। তবেই একটি লেখা, বিশেষত প্রবন্ধ ও কবিতা পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।
রক্তকরবী নাটকে কবিগুরু তিন তিন বার নাটকটির নাম পরিবর্তন করেছিলেন। প্রথমে তিনি লেখক, পরে নিজেই লেখাটির প্রথম পাঠক। শেষমেশ নিজেই সমালোচক। ১৯৯৩ সালে গুয়াহাটির এডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ কলেজে সাংবাদিকতার উপর একটি কর্মশালায় দিল্লি আইআইএমসির খ্যাতনামা অধ্যাপক মিঃ এম আর দুয়া বলেছিলেন, সংবাদ প্রতিবেদন রচনার সময় মনে রাখতে হবে, রিড, রিড এন্ড রিড। রাইট, রাইট এন্ড রাইট। একটি প্রতিবেদন যত বার পড়া হবে, ততবারই সংশোধন হবে। কথাটি সাহিত্যিক প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এক শ্রেণির সাংবাদিক যেমন অমিতাভ বচ্চনের মতো সেলিব্রেটিদের টয়লেটে যাওয়ার, হাঁচি দেয়ার খবর পরিবেশন করে নিজেরা কত বড়ো অনুসন্ধানী সাংবাদিক তার স্বাক্ষর রাখতে চান! গবেষকদের মধ্যেও এক শ্রেণির গবেষক আছেন, যাঁরা কবিগুরু কখন, কোথায়, কত সময় টয়লেটে কাটিয়েছিলেন, কত সময় প্রেম করেছিলেন, সে-সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, তথ্য পরিবেশনপূর্বক প্রবন্ধ সাহিত্যকে রসকষহীন করে প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রতি পাঠকের অরুচি ধরিয়ে দিয়েছেন! তাই, বেশিরভাগ পাঠক প্রবন্ধ পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন! প্রবন্ধের মননশীলতা বজায় থাকেনি অনেক ক্ষেত্রে।