প্রবাসীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জুলাই থেকে পাঁচ বছরের পরিবর্তে ১০ বছর মেয়াদি ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট (ই-পাসপোর্ট) দেয়া হবে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বুধবার (১৫ মে) জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চতুর্থ বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়।
কমিটির সভাপতি ফারুক খানের সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আব্দুল মজিদ খান, নাহিম রাজ্জাক এবং নিজাম উদ্দিন জলিল (জন) অংশ নেন।
আগামী ১ জুলাই থেকে অত্যাধুনিক ই-পাসপোর্ট পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিকরা। যে পাসপোর্টের ডাটা থাকবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ডাটা বেইসেও। এই উদ্যোগ ২০১৭ সালে নেওয়া হলেও বিভিন্ন কারণে তা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অবশেষে আগামী জুনের মধ্যে সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করে জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকেই নাগরিকদের হাতে ই-পাসপোর্ট তুলে দিতে কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পৃথিবীতে ১১৯টি দেশের নাগরিকরা ই-পাসপোর্ট ব্যবহার করে। বাংলাদেশও ওই দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে। ই-পাসপোর্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। পাঁচ ও ১০ বছর মেয়াদি হতে পারে এই পাসপোর্ট। মেয়াদ ও ফি নির্ধারণ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একের পর এক বৈঠক করছে। মন্ত্রণালয় থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, চলমান ফির তুলনায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ই-পাসপোর্টের ফি দ্বিগুণ হতে পারে। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
ফি নির্ধারণ কমিটির প্রস্তাবে সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ছয় হাজার (২১ দিন), এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য ১২ হাজার (সাত দিন) ও সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য ১৫ হাজার টাকা (এক দিন) প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া দুই ক্যাটাগরির পাসপোর্ট থাকছে। একটি ৪৮ পৃষ্ঠার, আরেকটি ৭২ পৃষ্ঠার। যারা ৭২ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট নেবে তাদের ক্ষেত্রে ফিও বেশি হবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব মুনিম হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী ১ জুলাই থেকে যাতে নাগরিকরা ই-পাসপোর্ট পেতে পারে, সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’
প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান খান বলেন, ‘নাগরিকরা যাতে দ্রুতই ই-পাসপোর্ট পায়, সেভাবেই কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শুরুতে ২০ লাখ ই-পাসপোর্ট জার্মানি থেকে প্রিন্ট করে এনে সরবরাহ করা হবে। এরপর আরো দুই কোটি ৮০ লাখ পাসপোর্ট বাংলাদেশে প্রিন্ট করা হবে। সে জন্য উত্তরায় কারখানা স্থাপন করা হবে। পরবর্তী সময়ে ওই কারখানায়ই পাসপোর্ট ছাপা হবে।
বর্তমানের যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্টের মতোই ই-পাসপোর্টেও একই ধরনের বই থাকবে। তবে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্টের বইয়ের শুরুতে ব্যক্তির তথ্যসংবলিত যে দুটি পাতা আছে, তা ই-পাসপোর্টে থাকছে না। সেখানে থাকবে পালিমারের তৈরি একটি কার্ড। এই কার্ডে সংরক্ষিত চিপে পাসপোর্ট বাহকের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ই-পাসপোর্টে ৩৮ ধরনের নিরাপত্তা ফিচার থাকবে। বর্তমানে এমআরপি ডেটা বেইসে যেসব তথ্য আছে, তা ই-পাসপোর্টে স্থানান্তর করা হবে। পাসপোর্টের মেয়াদ হবে বয়সভেদে পাঁচ ও ১০ বছর। ই-পাসপোর্ট চালু হলেই এমআরপি পাসপোর্ট বাতিল হবে না। তবে নতুন করে কাউকে এমআরপি পাসপোর্ট দেওয়া হবে না। যাদের এমআরপির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তারা রিনিউ করতে গেলে ই-পাসপোর্ট নিতে হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে এমআরপি পাসপোর্ট তুলে নেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল পাসপোর্ট সেবা সপ্তাহ উদ্বোধনের সময় ই-পাসপোর্ট চালুর বিষয়ে ঘোষণা দেন। ২০১৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানির সরকারি প্রতিষ্ঠান ভেরিডোস জেএমবিএইচের সঙ্গে ই-পাসপোর্ট চালুর বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটির কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকগুলোতে জার্মানির রাষ্ট্রদূত ও উপরাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বলা হয়েছিল, ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ই-পাসপোর্ট চালু হবে। এরপর গত বছরের মার্চ মাসের মধ্যে ই-পাসপোর্ট চালু হবে, এমন কথা বলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি। অবশেষে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ই-পাসপোর্ট চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ৩০ জুনের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করে ১ জুলাই থেকে ই-পাসপোর্টের আবেদন নেওয়া হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অত্যাধুনিক এই ই-পাসপোর্ট একটি বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট। এতে একটি এমবেডেড ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর চিপ থাকবে। এই চিপে পাসপোর্টধারীর বায়োগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক (ছবি, আঙুলের ছাপ ও চোখের মণি) তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। আর ই-পাসপোর্টের সব তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত থাকবে পিকেডিতে (পাবলিক কি ডাইরেক্টরি)। আন্তর্জাতিক এই তথ্যভাণ্ডার পরিচালনা করে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও)। ইন্টারপোলসহ বিশ্বের সব বিমান ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এই তথ্যভাণ্ডারে ঢুকে তথ্য যাচাই করতে পারবে। এর ফলে পাসপোর্ট নিয়ে জালিয়াতি কঠিন হবে। সে সুবাদে জনভোগান্তি কমে আসবে।