সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং রায়েরবাজারে চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের কবর জিয়ারত করে দলীয় কার্যক্রম শুরু করলো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। মঙ্গলবার (৪ মার্চ ২০২৫) এনসিপির শীর্ষ নেতারা সকাল ৮টার দিকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা এবং সকাল ১০টায় দিকে রায়েরবাজারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ ও মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা সারমিন ও আরিফুল আবীদ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও নাহিদা নিভাসহ নতুন দলটির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
রাজধানীর রায়েরবাজারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত ও দোয়া শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এনসিপির নেতারা ডান-বামের বিভাজনের মধ্যে না গিয়ে মধ্যপন্থি রাজনীতি সূচনার অঙ্গীকারের কথা জানান।
আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুনি হাসিনার দৃশ্যমান বিচার দেখতে চাই। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের প্রতি কিছুটা সুবিচার সম্ভব হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে রাজনৈতিক ফায়সালা দরকার। তিনি আরও বলেন, নতুন প্রজাতন্ত্র গড়তে একটি নতুন সংবিধান দরকার। এর মাধ্যমেই কেবল শাসন কাঠামো ও পুরনো সংবিধান পরিবর্তন করে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে পারবো। এসময় দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ডান-বামের বিভাজনের মধ্যে না গিয়ে মধ্যপন্থি রাজনীতির সূচনা করার অঙ্গীকারের কথা জানান।
গণপরিষদ নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন একইসাথে করা যেতে পারে : নাহিদ ইসলাম
চলতি বছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন হলে গণপরিষদ নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন একইসাথে করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন নাহিদ ইসলাম। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের কবর জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
গণপরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, “বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের, এনসিপি’র, প্রস্তাবনা হাজির করেছি। আমরা মনে করি, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন একটি সংবিধান, একটি প্রকৃত গণতন্ত্রে উত্তরণ হতে আমাদের সহায়তা করবে। সেই জায়গায় আমাদের দাবি আমরা বলেছি। আমাদের যে জাতীয় নির্বাচন, সেটি গণপরিষদ নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন আকারে করা যেতে পারে।” তিনি মনে করেন, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরতে পারে।
তিনি তার বক্তব্যের শুরুতে জানান যে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরুর উদ্দেশ্যে এর আগে এনসিপি জাতীয় স্মৃতিসৌধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিয়েছে। এসময় তাকে প্রশ্ন করা হয়, তারা একাত্তরকে কম গুরুত্ব দিয়ে চব্বিশকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে কি না, উত্তরে তিনি বলেন, “এই ভূখণ্ডের যে লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে, ‘৪৭ সাল থেকে ‘৭১ এবং পরবর্তীতে ‘২৪ সাল, সেই সকল লড়াইকেই আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করছি।”
“২০২৪ সালের জুলাই মাসে স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিলো, তাতে বাংলাদেশের নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ জীবন দিয়েছেন” উল্লেখ করে মি. ইসলাম বলেন, “পুরো পৃথিবী জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার সাক্ষী…আমরা অবিলম্বে তার বিচার কার্যক্রম দেখতে চাই।”
“পুরো বাংলাদেশে না কেবল, পৃথিবীতেই কোনও স্বৈরাচারি, কোনও জালেম যাতে এই ধরনের কার্যক্রম করার আগে, গণহত্যা করার আগে একবার ভেবে নেয়, এইরকম কঠোরতম বিচার হওয়া উচিত। এটা নির্দশন হিসাবে থাকা উচিত পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে,” যোগ করেন তিনি।
শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের কথা যেন মুখেও না আনে : সারজিস আলম
অভ্যুত্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত ও দোয়া শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিচার হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের কথা যেন কেউ মুখেও না নেয়। খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে না দেখা পর্যন্ত এই বাংলাদেশে কোনও নির্বাচন হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রাজপথে ছিলাম। আমার যে ভাইয়েরা রাজপথে জীবন দিয়েছে, যে মায়েদের চোখ দিয়ে এখনও কান্না ঝরছে, পানি পড়ছে আমরা যেন মরার আগে অন্তত খুনি হাসিনার বিচারটা দেখে মরতে পারি। আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ। আমরা আমাদের জায়গা থেকে মায়েদের পাশে থাকার সর্বোচ্চটুকু চেষ্টা করবো। খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে, সে বিচারের মঞ্চে দাঁড়াবে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াবে।’
‘পুরোনো সংবিধান ও শাসন কাঠামো রেখে নতুন বাংলাদেশ গঠন সম্ভব নয়’
সকাল ৮টার দিকে এনসিপির নেতারা সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান। এর আগে সকাল ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে গাড়ি বহর নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। এসময় একাত্তরের বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন তারা।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নাহিদ বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রথম কর্মসূচি হিসেবে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে এসেছি। আজ থেকে আমাদের আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি শুরু হলো। জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে সারাদেশের মানুষকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
আমাদের এই ভূখণ্ডে জনপদে লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে আজাদি লড়াই থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। এসব লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেই আমরা নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণ করব এবং সেই লক্ষ্যেই এনসিপি কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বলেছি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলেও, আমাদের সার্বভৌমত্ব তা বার বার হুমকির মুখে পড়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টাগুলো বার বার ভেঙে পড়েছে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান গড়ে তুলতে পারিনি। একটি এক দলীয় সংবিধানের মাধ্যমে ফ্যাসিজম এবং স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করা হয়েছিল। আমরা বলেছি, আমাদের একটি নতুন প্রজাতন্ত্র গড়তে হবে। তার জন্য একটি নতুন সংবিধান এবং গণপরিষদ নির্বাচনের প্রয়োজন। সেই জায়গা থেকে আমরা সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলেছি এবং সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।
এসময় নাহিদ ইসলাম দলের কার্যক্রম নিয়ে বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম বিস্তৃতি করা। তৃণমূলে সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তৃত করা এবং নিবন্ধন নিতে যে ধরনের শর্ত পূরণ করতে হয় সেগুলো পূরণ করা। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা পূরণ করে আমরা নিবন্ধন কার্যক্রমে এগোবো। এই মাসের মধ্যে আমরা গঠনতন্ত্রের প্রণয়নের কাজটি শুরু করব।
জুলাইয়ে গণহত্যাকারীদের বিচার চেয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে গণহত্যা হয়েছে, আমরা সেই গণহত্যার বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যেই কার্যকর দেখতে চাই এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির ফয়সালা এই বাংলার মাটিতে করতে হবে। এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং গত ১৫ বছর জুলুম করেছে তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হতে হবে।
অর্ন্তবর্তী সরকারকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যেই এই বিচার বাংলার মানুষ দেখতে চায় এবং বিচারের পরে সংস্কার কার্যক্রম জাতীয় ঐকমতের যে কমিশন রয়েছে তা দ্রুত সংলাপে গিয়ে আমাদের জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণাপত্র দ্রুত বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই।