ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। গাজায় চলমান গণহত্যা অবিলম্বে বন্ধের দাবিতে কয়েকটি জায়গায় মানববন্ধন করে এবং কোথাও কোথাও মিছিল বের করা হয়েছে। সোমবারের (৭ এপ্রিল ২০২৫) কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে ধর্মঘট এবং রাজধানীসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ। বিশ্বব্যাপী ডাকা এই কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচি পালন করা হয়।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এদিন পাঠদান ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস বন্ধ রাখা হয়েছিল বলে জনসংযোগ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকজানিয়েছেন। স্বাধীন ফিলিস্তিন ও গণহত্যা বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ এমনকি শিশুরাও টিএসসির সামনে জড়ো হয়ে ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। তারা ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। অনেকের হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা ছিল। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া একজন বলেন, ‘বিশ্ব নেতারা ফিলিস্তিনের জনগণকে ভুলে যাওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি। আমরা ফিলিস্তিনিদের মুক্তি চাই, যুদ্ধাপরাধের জন্য ইসরায়েলি নেতাদের বিচার চাই।’ সহিংসতা বন্ধে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস একযোগে বন্ধ করে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি অ্যাক্টিভিস্টরা। তাদের ডাকে সাড়া দিয়েই বাংলাদেশে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল সারাদেশে শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এই কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানায়।
অবরুদ্ধ ভূ-খণ্ড গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ও পরীক্ষা বর্জন, অফিস আদালত বন্ধ রাখার জন্য আহ্বান জানায় ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ছাত্র শিবিরসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এই কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি জানান।
অনেককে মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যেতে দেখা গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ (ঢামেক) বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সেখানে বিক্ষোভ করছেন। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এ সময় মিছিল অংশ নেওয়াদের হাতে ছিল ‘শো ইসরায়েল দ্য রেড কার্ড’ লেখা প্ল্যাকার্ড। বিজয় নগর এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদ। ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা, ফিলিস্তিনের নাগরিকদের উপর চালানো গণহত্যার প্রতিবাদ ও স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি উঠে আসে তাদের স্লোগানে।
বাড্ডায় পথে নামে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা দ্রুত ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে স্লোগান তোলেন। নর্থসাউথ ও ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও নিজ নিজ ক্যাম্পাস এলাকায় বিক্ষোভ করছেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, গাজার জনগণের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে রাস্তায় নেমেছি। কারণ সেখানে ফিলিস্তিনিদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও ভাটারায় বিক্ষোভ করেছেন কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। সেই সময় তারা ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। বসিলা ও উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে বিক্ষোভ করেছেন বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও।
এদিকে বিক্ষোভ ঘিরে গুলশান ও বারিধারা এলাকায় কূটনৈতিক জোনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। দূতাবাসের সামনে অবস্থান নিতে দেখা গেছে সেনা বাহিনীর সদস্যদেরও। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে পথ চলতি মানুষদের তল্লাশি করা হয়। ফুটপাতে বা রাস্তায় কাউকে দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গুলশানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এলাকায় মিছিল বের করে একদল শিক্ষার্থী। নতুন বাজরের কাছে মার্কিন দূতাবাসের সামনে মহাসড়কে অবস্থান নেন তারা। সেখানে ঘণ্টাখানেক অবস্থানের পরে নতুন বাজারের মূল সড়কের একপাশ খুলে দেওয়া হয়।
এদিকে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করা ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ হাজার ৬৯৫ ফিলিস্তিনি নিহত ও এক লাখ ১৫ হাজার ৩৩৮ জন আহত হয়েছেন। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার প্রায় ৬৯ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফিলিস্তিনের সরকারি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও অপরাধের প্রতিবাদে আজকের এই কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে।
জেলায় জেলায় বিক্ষোভ
গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা চলছেই। থামার কোনও নামগন্ধ নেই। প্রতিদিনই ঝরছে শত শত প্রাণ। বাদ যাচ্ছে না নারী-শিশুরাও। ওই দিকে বিশ্বমোড়লরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাদের ‘ঘুম ভাঙাতে’ বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ফুঁসে উঠেছে জনতা। দিচ্ছেন ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক।
যশোর : সোমবার (৭ এপ্রিল) বেলা ১১টায় যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা ভৈরব শহীদ চত্বরে সমাবেশ করে ‘যশোরের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা’। ‘লাখো শহীদের রক্তের ঋণ, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’ স্লোগানে স্লোগানে যশোর শহরের রাজপথ প্রকম্পিত করে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল ও সমাবেশ করা হয়েছে। সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘জায়নবাদী ইসরায়েল মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি শিশু, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।’ সমাবেশ থেকে ইসরায়েলের সব ধরনের পণ্য বয়কটের আহ্বান জানানো হয়।
নরসিংদী : বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন নরসিংদীর ছাত্র-জনতা। সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা অবধি শহরের প্রায় ১০ হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন। সকাল থেকেই শহরের শিক্ষাচত্বর মোড়ে জড়ো হতে শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক ও অন্যান্য পেশাজীবীদের সমন্বয়ে বিক্ষোভ মিছিলটি নরসিংদী প্রেসক্লাব এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের জেলখানার মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। পরে বেলা সোয়া ১১টা থেকে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। এ সময় ইসরায়েলি পণ্য বর্জন, হামলার বিচার দাবিসহ অন্যান্য স্লোগানে মুখরিত হয় বিক্ষোভস্থল। গাজাকে রক্ষার পাশাপাশি দাবি ওঠে ইসরাইলের বিচারের। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মহাসড়ক ছেড়ে যায় বিক্ষোভকারীরা।
ময়মনসিংহ : গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে ময়মনসিংহে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকালে ময়মনসিংহের সর্বস্তরের জনগণের উদ্যোগে নগরীর টাউন হল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় ইসরায়েলি বর্বরতার বিপক্ষে লেখা নানা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। পরে সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে রেলওয়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। তারা বলেন, ‘অনতিবিলম্বে এই হত্যা বন্ধ করতে হবে।’ এ সময় বাংলাদেশ সরকারকে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
রাজবাড়ী : সোমবার সকাল ১০টার দিকে গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডের ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে গোয়ালন্দ সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে শত শত ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিলটি মহাসড়ক হয়ে উপজেলা কোর্টচত্বর মাঠে গিয়ে শেষ হয়। পরে ফিলিস্তিনের নিহত ও আহতের স্মরণে দোয়া মোনাজাত করা হয়।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা জানান, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর জুলুম অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ শুরু করা উচিত। তা ছাড়া ফিলিস্তিনের গাজা ও রাফায় মুসলমানদের ওপর নারকীয় হত্যা বন্ধ করতে বিশ্ব মুসলিমদের একতাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প কিছু নেই। জীবনবাজি রেখে মুসলমানদের রক্ষায় যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিক্ষোভকারীরা আরও জানান, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে নিরীহ গাজাবাসীর উপর সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েল কর্তৃক বর্বরোচিত হামলা, গণহত্যা এবং ভারতে মুসলিমদের শ্লীলতাহানি ও হত্যার প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশের মতো রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের রাজপথে বিক্ষোভে নেমে এসেছে। এরপর থেকে যদি বিশ্বের কোনও মুসলমানের ওপর হামলা করা হয় তাহলে বিশ্বের মুসলিমও বসে থাকবে না। মহান আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে তাই বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
কুড়িগ্রাম : সারা দেশের মতো আজ কুড়িগ্রাম জেলা শহরের শাপলাচত্বরেও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। ইসরায়েলি বর্বরতায় ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে হাজারো মুসলিম জনতা ও শিক্ষার্থী প্রতিবাদী স্লোগান নিয়ে মিছিলে অংশ নেয়। ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’ ব্যানারে আয়োজিত এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে নির্বিচারে মানুষ হত্যার জন্য ইসরাইলের প্রতি ধিক্কার জানানো হয়। একই সঙ্গে নজিরবিহীন এই হত্যাযজ্ঞ ও আগ্রাসন বন্ধ করতে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানানো হয়। একই দাবিতে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। পরে তারা জেলা শহরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেন।
খাগড়াছড়ি : ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা বন্ধের দাবিতে খাগড়াছড়ির জেলার নয় উপজেলায় বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন ইসলামি দল ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ। জেলার সদর উপজেলা, মাটিরাংগা, মানিকছড়ি, মহালছড়ি, দিঘিনালা, পানছড়ি, গুইমারা, রামগড়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ সমাবেশ বক্তারা ইসরায়েলি হামলা বন্ধ, ফিলিস্তিন ভূমি দখলের আগ্রাসন বন্ধ করার দাবির পাশাপাশি ইসরায়েলের পণ্য বয়কটের দাবি জানান।