হঠাৎ করেই শিশুরা সে সকল সবুজ মাঠ হতে, ঘর হতে হারিয়ে গেল। থেমে গেল তাদের কলকাকলী। যেন অদৃশ্য কোনো দৈত্য এসে তাদের ধরে নিয়ে গেছে। নিয়ে কোথাও বন্দী করে রেখেছে।
সত্যই পৃথিবীতে হঠাৎ করেই এক দৈত্যকূল ছড়িয়ে পড়েছে। গল্পের দৈত্য বিরাটকার হলেও এ প্রাণঘাতি দৈত্যকূল আনুবিক্ষণিক। তাদের চোখে দেখা যায় না। কিন্তু তারা আততায়ী। এ অদৃশ্য দৈত্য, আততায়ীর নাম- করোনা। এ আততায়ীই যেন মাঠের শিশুদের, স্কুলের কলরবরত সে সকল স্বর্গীয় দূতদের তাড়িয়ে নিয়ে গেছে কোথাও। তারা হয়ত জগৎ থেকে হারায়নি। কিন্তু তাদের যেখানে সময় কাটানোর কথা আগামী দিনের প্রস্তুতির জন্য, বেড়ে ওঠার জন্য সে সকল স্থান থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গিয়ে ঘরে আটকা পড়েছে। কেউ কেউ সে পরিচিত ঘরও হারিয়েছে।
হঠাৎ করেই এ ভয়াবহ নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশে দেশে শিশুদের স্কুল কলেজগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষত বাংলাদেশে বিরাট একটা অংশের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হয়ে গেছে বা চাকুরি হারিয়েছেন। বড় অংশের অভিভাবকদেরও আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে, চাকুরি হারিয়েছেন। সংবাদপত্র বলছে- গত কয়েকমাসে পঞ্চাশ হাজার অভিভাবককে ঢাকা শহর ছাড়তে হয়েছে। সাথে এ পরিবারগুলোর শিশুরাও তাদের স্কুল থেকে হারিয়ে গেছে। তারা কি আবার তাদের স্কুলে ফিরে আসতে পারবে? মহামারি উত্তর অর্থনৈতিক মন্দার যে আশংকা করা হচ্ছে তাতে
যদি সে অভিভাবকদের আয়ের উৎস শহরে আবার চালু না হয়- তাহলে এ শিশুগুলো একদম নতুন শিখনপবিবেশের মুখোমুখি হবে।
আমাদের একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আমরা একদম আদিম মানুষের মত গুহাদশায় চলে গেছি। গুহার বাইরের শত্রুকে মোকাবেলা করার কোনো অস্ত্রই আমাদের হাতে নেই। সাহস করে বড়দের কেউ কেউ গুহা থেকে বেরিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। আক্রান্ত হয়ে তারা মারাও পড়ছেন। স্কুলগামী শিশুরা একদমই গুহায় আটকে পড়েছে। স্কুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সময় তো বসে নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শিশুদের সে বাস্তব পরিস্থিতির উপযোগী হতে হবে। জীবনের প্রস্তুতি নিতে হবে। সে শিক্ষার ব্যবস্থা কই? কবে তারা স্কুলে ফিরতে পারবে? কবে ফিরবে?
আপদকালীন একটা ব্যবস্থা হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে অনলাইন এডুকেশনকে। কিন্তু বাংলাদেশে কি সে উপযোগী ব্যবস্থা আছে? সবার জন্য সকল স্থানের জন্য সমানভাবে আছে?
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সন্তানকে অনলাইন ক্লাশের উপযোগী ডিভাইস কিনে দিতে না পারার অক্ষমতায় পিতা আত্মহত্যা করেছেন- এ রকম একটি সংবাদ গত কয়দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। সংবাদটি সত্য মিথ্যা যাই হোক- এটা এক করুণ নতুন বাস্তবতা।
সহজ করে বললে, অনলাইন শিক্ষার একদম প্রাথমিক দুটো বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- উপযোগী ডিভাইস আর নেট। প্রথাগত পড়ালেখার জন্য যেমন স্কুল আর বইপত্র।
আমাদের শিক্ষার্থীদের এক বিপুল অংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। অনলাইন ক্লাশ করার মত স্মার্টফোন তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আছে কিনা সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। ১৮ বৎসরের নীচের শিশুদের হাতে নেট সংযোগসহ ডিভাইস তুলে দেয়ার অন্যান্য সুবিধা- অসুবিধা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
আর সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় নেট। নেটের গতি আর ডাটার দিক ভাবতে হবে। সব জায়গায় থ্রি জি গতিই নেই। আর একটি প্রতিষ্ঠান যদি প্রতিদিন ৫/৬ টিও ক্লাশ অনলাইনে নেয় তাহলে এই ৪/৫ ঘণ্টার ভিডিও স্ট্রিমিং দেখতে প্রতিদিন কত ডাটা এবং মাসে কী বিপুল পরিমান ডাটা লাগতে পারে বিবেচনায় নিতে হবে।
অনেক স্কুলে যেখানে বেতনের টাকা দেয়াই অভিভাবকদের জন্য কষ্টকর সেখানে বেতনের বাইরেও এই বিপুল ডাটার বিল যোগানো কঠিন হবে।
ফলে সামর্থ্যবান পরিবারের শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ থাকলেও প্রান্তিকদের বঞ্চিত হওয়ার আশংকা থেকে যাবে। একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চালু হবে। তাই বলে কি আমরা বসে থাকবো? না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে-
-শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে দোয়েলের মত ডিভাইস সুদবিহীন কিস্তিতে দেয়া যেতে পারে। দেশে সংযোজিত কম দামের
স্মার্টফোনও হতে পারে।
– শিক্ষার্থীদের টেলিটকের মাধ্যমে কম বা বিনামূল্যে মোবাইল সংযোগ দেয়া যেতে পারে। সার্চ কাস্টমাইজড করা যেতে পারে, যাতে পড়ালেখার বাইরে শিশুরা অনাকাঙ্ক্ষিত সাইটে প্রবেশ করতে না পারে।
বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর বিনামূল্যে বই বিতরণ বাবদই হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে থাকেন। নতুন
এ বিনিয়োগ অযৌক্তিক হবে না। করোনার অদৃশ্য দৈত্য চলে গেলেও এ বিনিয়োগ কাজ দেবে। শিক্ষাদান পদ্ধতির বহুমুখীকরণ ঘটবে।
কিন্তু শেষ অবধি আমরা অপেক্ষা করছি শিশুগুলো সত্যিকার স্কুলে ফিরে আসবে কবে? কবে আবার ভরে উঠবে তাদের কলকাকলীতে স্কুলের সবুজ মাঠ, ঘর?
কবে?
ড. শোয়াইব জিবরান: কবি, লেখক। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের সাবেক শিক্ষা পরামর্শক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।