­
­
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উদ্বেগ কেন?  » «   আওয়ামী লীগ নিয়ে খবর প্রকাশ বা সোশাল মিডিয়ায় লেখাও কি নিষেধ?  » «   জুলাইয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে, জেনোসাইড হয়নি: চিফ প্রসিকিউটর  » «   ভুয়া ‘জুলাই যোদ্ধা’র হাতে সরকারি অনুদানের চেক  » «   কে জিতল—ভারত, না পাকিস্তান?  » «   আওয়ামী লীগের ‘কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা’র মানে কী?  » «   বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের আমদানি বাড়বে, কমবে শুল্ক  » «   আওয়ামী লীগ নিষেধাজ্ঞার ফল কী? জামায়াতের বিচার নিয়ে প্রশ্ন  » «   পা দিয়ে লিখেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় মানিক  » «   এখন লড়াই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে: ফরহাদ মজহার  » «   ইতালিতে ‘জিহাদি উসকানি’র অভিযোগে দুই বাংলাদেশি যুবক আটক  » «   ভারত-পাকিস্তান সংঘাত থামলো কীভাবে, টিকবে কতদিন  » «   আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত, ৭১-এর পর দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হলো  » «   ট্রাম্পের ঘোষণার পর যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করল ভারত ও পাকিস্তান  » «   সিলেট সীমান্তে ভারতের রাত্রিকালীন কারফিউ  » «  

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতার কবি দাউদ হায়দার আর নেই



‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’- পংক্তিমালার কবি দাউদ হায়দার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৭৩ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শনিবার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে তিনি মারা যান। খবরটি নিশ্চিত করেছেন তার দুই অনুজ কবি জাহিদ হায়দার ও আরিফ হায়দার।

১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে দাউদ হায়দার নামক এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। তখন ভাইভা বোর্ডে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়:
— বল তো, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ — এটা কার কবিতা?
তিনি হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন:
— আমারই লেখা।
বোর্ডের শিক্ষকরা প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, কারণ এমন একটি কবিতা এর রকম কোনো যুবক লিখতে পারেন তা তাদের ধারণায় ছিল না। কিন্তু পরে যখন তারা তার আগের কিছু লেখা দেখেন এবং তার প্রতিভা বুঝতে পারেন, তখন দাউদ হায়দারকে মেধার জন্য বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেন। নথিপত্র অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া কবির বয়স তখন ছিল মাত্র ১৭ বছর!
আলোচিত কবিতাটির ক’টি লাইন:
‘আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’

দাউদ হায়দার দেশের প্রথম কবি যাকে কবিতা লেখার জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। দৈনিক সংবাদ এর সাহিত্য পাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই কবিতায় হযরত মোহাম্মদ [স.], যিশুখ্রিস্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। [সংস্‌ অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সঙ্কলিত থাকতে পারে।] প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
১৯৭৩ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে ভারতের কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ)। কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’
কবি দাউদ হায়দারের কবিতা ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ বেশ কিছু বিতর্কিত বক্তব্য থাকলেও অসাধারণ কিছু লাইনও আছে:
‘আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আরে কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।
আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা
বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি
একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)।’

কলকাতা ছিল দাউদ হায়দারের কাছে একদম অচেনা বিদেশ, যেখানে কাউকেই চিনতেন না। তিনি দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে কাঁদছিলেন। সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ এর কাছে প্রথম আশ্রয় পান। একমাসের মতো ছিলেন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে নিজ বাড়ীতে আশ্রয় দেন। লেখালেখি শুরু করেন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্যের’ ভর্তি হন।

বাংলাদেশের কোনো সরকারই তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল না। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন ছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামল। ভারত সরকার তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।”
নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে এসে পুরো ঘটনা শুনে ফিরে গিয়ে জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ জুলাই ১৯৮৭ থেকে তিনি জার্মানীর বার্লিন শহরে অবস্থান করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেও বিফল হন। বার্লিন যাত্রায় তিনি পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেন। পরে এই জাতিসংঘের ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানীতে সাংবাদিক হিসেবে চাকুরী করেন।

দাউদ হায়দার প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। দাউদ হায়দারের কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা, নির্বাসনের কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতা-চেতনা, দ্রোহ এবং মানবতাবাদী চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে।

দাউদ হায়দার ছিলেন এক রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান। তাঁর সব ভাই-ই বিখ্যাত। জিয়া হায়দার নাটকের লোক। রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক, গবেষক। বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অসাধারণসব বই প্রকাশ করেছেন। মাকিদ হায়দার কবি। এরা সবাই প্রয়াত। আছেন দুই ভাই জাহিদ হয়াদার ও আরিফ হায়দার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার শিক্ষক।

দাউদ হায়দার শনিবার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে তিনি মারা যান। দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। লাইভসাপোর্ট তুলে নিলে তিনি অনন্তের পথে যাত্রা করেন।

দেশে ফেরার প্রবল আকুতি ছিল তাঁর। স্বপ্ন দেখেছেন একদিন সময় হবে পদ্মা ইচ্ছামতির গাঙ্গ শালিকের দেশে ফেরার। সময় কি আর হবে? হলেও তো মাতৃভূমি শায়িত হওয়ার বাসনা তার পূরণ হবে না। বিদায় দাউদ হায়দার।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন