করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আছঁড়ে পড়েছে ইংল্যান্ড তথা ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। করোনার সমুদ্রের তলদেশ ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। বিশ্বব্যাপি হাজারো কোটি মানুষ অসহায়ত্বের জীবন-যাপন করছেন। এরইমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। দিন দিন এর সংক্রমণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় ব্রিটেনেও অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে অর্থনীতিতে, স্বাস্থ্যখাতে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে, এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে। চলতি বছরের জিসিএসই ও এ লেভেল পরীক্ষার ফলাফলে চরম মূল্য দিতে হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। সরকার সময়োচিত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী আশাতীত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। যেতে পারেনি তাদের পছন্দের কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে। গ্রেড ভালো না থাকায় অনেককে আগামী বছর আবারো পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে, অনেকেই পছন্দের সাবজেক্টে সুযোগ না পেয়ে একটি বছর নষ্ট হবার ভয়ে পড়ছে অন্য কোনো সাবজেক্ট নিয়ে । সংশ্লিষ্টদের ধারণা সরকার যদি সময় ক্ষেপন না করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতো, তাহলে পরীক্ষার ফলালফল নিয়ে এধরণের অরাজকতা এড়ানো যেতো। করোনার বর্তমান পরিস্থিতি যদি আরো ভয়ানক রূপ ধারণ করে আর এর ফলে যদি দেশব্যাপী আবারো পুরোপুরি লক্ডাউনের ঘোষণা আসে, তাহলে নির্ঘাত এর প্রভাব পড়বে ২০২১ সালের জিসিএসই ও এ লেভেল পরীক্ষার ওপর।
এরইমধ্যে আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য জিসিএসই ও এ লেভেল পরীক্ষা নিয়ে বিভিন্ন মহলে জল্পনা – কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মা, বাবা, অভিভাবক – সবাই কি ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে বেশ শংকিত। বিশেষ করে মা – বাবা, অভিভাবকরা চলতি বছরের রেজাল্ট ফিয়াস্কোর (Result fiasco) পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কথা চিন্তা করে সম্প্রতি বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলর সরকারকে অনুরোধ করেছেন যে, আগামী বছর পরীক্ষার আয়োজন না করে শিক্ষকদের অনুমানভিত্তিক গ্রেডকে বিবেচনায় এনে যেনো ফলাফল নির্ধারণ করা হয়।
বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, স্যার ডেভিড ইস্টউড ও শেফিল্ড হালাম ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, স্যার ক্রিস হাসব্যান্ডস আগামী বছরের এ লেভেল পরীক্ষা বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্ববান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন যে, পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে তা হবে সরকারের একটি “ভুল সিদ্ধান্ত”। তাদের মতে, পরীক্ষা হলে শিক্ষার্থীদের ওপর এক বিরাট মানসিক চাপ পড়বে। সরকার এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা “অফকল ” এর উচিত হবে শিক্ষকদের পাঠানো অনুমানভিত্তিক গ্রেডকে বিবেচনায় এনে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা। ফলে শিক্ষার্থীরা চাপ মুক্ত থাকবে। তারা আরো বলেছেন, চলতি বছরের শুরু থেকে করোনার কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে ও কলেজে যেতে পারেনি। ফলে তাদের শিক্ষা জীবন থেকে অনেকগুলো সপ্তাহ ও মাস ঝরে পড়েছে। তারা সিলেবাস সম্পন্ন করতে পারেনি তাই সরকারের উচিত হবে আগামী বছর পরীক্ষার ব্যাবস্থা না করে এসব শিক্ষার্থীদের আগামী জুলাই পর্যন্ত ক্লাসে গিয়ে লেখাপড়া করে প্রকৃতঅর্থে জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ করে দেয়া। এরইমধ্যে স্যার ইস্টউড ও স্যার হাসব্যান্ডস এর সুপারিশ এর প্রতি অন্যান্য ইউনিভার্সিটির ভাইস চান্সেলররা সমর্থন জানিয়েছেন।
এসব শিক্ষাবিদদের ধারণা, শিক্ষার্থীদের সারা বছরের স্কুলের কাজের মান, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফলাফল, লেখাপড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ ইত্যাদি নানান বিষয়কে আমলে এনে শিক্ষকরা অনুমানভিত্তিক গ্রেড নির্ধারণ করে এক্সাম বোর্ডে ফলাফল পাঠালে চলতি বছর ঘটে যাওয়া “এডুকেশন ফিয়াস্কো” কে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তাদের মতে, এ সংকটময় সময়ে আমাদের দায়িত্ব হবে শিক্ষার্থীদের গ্রেডকে প্রাধান্য না দিয়ে তাদের প্রকৃত শিক্ষাদানের মাধ্যমে জ্ঞানী করে গড়ে তোলা।
সম্প্রতি এক জরীপে দেখা গেছে যে, সেপ্টেম্বরে এদেশের সবগুলো সেকেন্ডারি স্কুল, ছাত্র – ছাত্রীদের জন্য পুরোপুরি খুলতে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এদের সংখ্যা শতকরা ৯২ ভাগ থেকে শতকরা ৮৪ ভাগে নেমে এসেছে। জরীপে আরো দেখানো হয়েছে যে, শিক্ষকদের মতে এ হূর্তে শতকরা ৫৩ ভাগ জিসিএসই ও এ লেভেল শিক্ষার্থী তাদের সামর্থ অনুযায়ী আশানুরূপ ফলাফল অর্জনে প্রস্তূত নয়। আর সুবিধাবঞ্চিত এলাকার চিত্র আরো ভয়াবহ। এ সংখ্যা শতকরা ৬৬ ভাগ। জরীপে বলা হয়েছে শতকরা ৮১ ভাগ হেডটিচার মনে করেন যে, আগামী বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে তার জন্য পরীক্ষার্থীদের সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে যে ধরনের সুযোগ সুবিধা তাদের দেয়া উচিত তা বাস্তবায়ন করার মতো আর্থিক সামর্থ (Funding) স্কুল বা কলেজগুলোর নেই।
এদিকে ভাইস চ্যান্সেলরদের অনুরোধকে উপেক্ষা করে এডুকেশন সেক্রেটারি গ্যাভিন উইলিয়ামসন এম.পি বলেছেন, আগামী বছর জিসিএসই ও এ লেভেল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষা কিছু দিনের জন্য পেছানো যায় কিনা এবং সিলেবাস থেকে কিছু কনটেন্ট (Content) কমিয়ে এনে প্রশ্ন – পত্র করা যায় কিনা সে ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। “অফকল” শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য এরইমধ্যে সরকারের কাছে তাদের পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করেছে। যার মধ্যে পরীক্ষার সময়সীমা পেছানোর, সিলেবাস থেকে কনটেন্ট কমানোর এবং প্রশ্ন – পত্র অপেক্ষাকৃত সহজ করার প্রস্তাব রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
এছাড়া ইংল্যান্ডের একটি এক্সাম বোর্ড – “এ কিউ এ” শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বাড়তি কাজের কথা চিন্তা করে এরইমধ্যে আগামী বছরের ল্যাংগুয়েজ / ভাষা (Languages exams)পরীক্ষায় পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছে। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী নিজ নিজ সেন্টারে শিক্ষকদের স্পিকিং পরীক্ষা(Speaking xam) নিতে হবে না। শুধু শিক্ষার্থীদের টার্গেট ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলার দক্ষতা অনুমান করে এবং এসেসমেন্ট ক্রাইটেরিয়ার(Assessment criteria) কথা খেয়াল রেখে শিক্ষার্থীদেরকে পাস, মেরিট এবং ডিস্টিংকশান (Pass, Merit, Distinction) দিতে হবে। রিডিং ও লিসনিং (Reading and Listening exams)পরীক্ষার প্রশ্ন পত্রে সিলেবাসের বাইরে থেকে কোনো শব্দ ব্যবহার করা যাবে না এবং যতখানি সম্ভব প্রশ্ন – পত্র কিছুটা সহজ করা হবে। রাইটিং পরীক্ষায় (Writing exam) অতিরিক্ত অপশান থাকবে। যেমন হাইয়ার রাইটিং পরীক্ষার প্রশ্ন- পত্রে আগে প্রশ্ন ১ ক আর প্রশ্ন ১খ ছিলো। তার সাথে যোগ করা হবে প্রশ্ন ১গ। অর্থাৎ পরীক্ষার্থীরা এ তিনটি থেকে যেকোনো একটি প্রশ্নের উত্তর লিখবে। তদ্রূপভাবে প্রশ্ন ২ ক ও প্রশ্ন ২খ এর সাথে এবার প্রশ্ন ২গ যোগ করা হবে। পরীক্ষার্থীরা এ তিনটি থেকে যেকোনো একটি প্রশ্নের উত্তর লিখবে। ন্যদিকে ফাউন্ডেশন রাইটিং পরীক্ষার প্রশ্ন – পত্রে – প্রশ্ন ৪ক ও ৪খ এর সাথে ৪গ যুক্ত করা হবে।অতিরিক্ত প্রশ্ন যোগ করার কারণে পরীক্ষার্থীদের অতিরিক্ত পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হবে প্রশ্ন পড়ার জন্য।
সম্প্রতি শিক্ষকদের সংগঠন “ন্যাশনাল এডুকেশন ইউনিয়ন” প্রধান মন্ত্রী বরিস জনসন বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর আঘাতে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা আইসোলেশান এ থাকার কারণে এবং স্থানীয় লক ডাউন এর কারণে বাড়িতে বন্দি আছে বা থাকবে। ফলে স্কুল কিংবা কলেজে তারা কিছু দিনের জন্য যেতে পারবে না। সিলেবাসের দিক থেকে তারা অন্যদের চেয়ে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়বে। তাই এসব কিছু বিবেচনায় এনে সরকার কি ধরণের বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছে তা পরিষ্কার করে অবহিত করার জন্য চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি শিক্ষকদের অনুমানভিত্তিক গ্রেড নিয়ে চলতি বছরের জিসিএসই ও এ লেভেল পরীক্ষায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী ফলাফল বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে। সেন্টার থেকেই অনেক শিক্ষক গ্রেডকে এক ধাপ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই ধাপ অবনমিত বা ডাউন গ্রেডেড করে এক্সাম বোর্ডের কাছে চূড়ান্ত ফলাফল পাঠিয়েছে। আগামী বছরের পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত যদি না হয়, শিক্ষাবিদদের প্রস্তাবিত অনুমান ভিত্তিক গ্রেড শিক্ষার্থীদের সামর্থের সাথে কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে তা বলা কঠিন। তাছাড়া সরকার যদি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক সিরিয়াস টাইপের শিক্ষার্থী ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যে লেখাপড়া থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে তা বলা বাহুল্য। ফলে পড়াশোনা করে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করার শিক্ষাবিদদের প্রস্তাব আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যাবে । এদিকে আগামী বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে এতো অল্প সময়ের মধ্যে বর্তমান ইয়ার ১১ ও ইয়ার ১৩ এর শিক্ষার্থীরা মা – বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে যে ধরনের মানসিক চাপের সম্মুখীন হবে তা মোটেও কাম্য নয়।মানসিক ও শারীরিক উভয় চাপ তাদের অক্টোপাসের মতো আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। দেখা যাক এ থেকে অব্যাহতি পেতে শেষ অবধি সরকার কি ধরণের বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নেয়!
সৈয়দ আফসার উদ্দিন : শিক্ষক, পরীক্ষক, সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী।
(লেখাটি সম্প্রতি ‘সাপ্তাহিক পত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়েছে)