জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রায় দশ লাখ প্রবাসীকে ভোটের আওতায় আনার উদ্যোগে ডাকযোগে ভোটের (পোস্টাল ভোটিং) বড় আয়োজন হলেও ফল মিলেছে অল্পই। অথচ দেশে থেকেও ভোটকেন্দ্রের বাইরে থেকে যায় ভোটারদের একটি বড় অংশ।
সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং কারাগারের কয়েদিরা এর মধ্যে পড়েন। তাদের সঠিক সংখ্যা নেই, তবে প্রতি নির্বাচনে ভোটের কাজেই নিয়োজিত থাকে আনুমানিক আট-দশ লাখ মানুষ।
প্রবাসীদের মতো তারাও চাইলে ডাকযোগে ভোট দিতে পারতেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জটিল প্রক্রিয়া মেনে আবেদন করতে হয় বলে এতদিন প্রায় কেউ আগ্রহ দেখাননি।
এবারের ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ডাকযোগে ভোট প্রক্রিয়াকে সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথমবারের মতো প্রযুক্তিনির্ভর পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি চালু হচ্ছে।
ইসি ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামে একটি অ্যাপ চালু করছে। শুধু প্রবাসীই নন, দেশের ভেতরে যারা নিজ নির্বাচনি এলাকার বাইরে থাকবেন, তারাও এই অ্যাপে নিবন্ধন করে ভোট দিতে পারবেন।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, সরকারি কর্মকর্তা যারা নিজ নির্বাচনি এলাকার বাইরে থাকবেন, তারা পোস্টাল ভোটের জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। প্রশাসন, পুলিশসহ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা এবং আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরাও এই সুযোগ পাবেন।
তিনি আরও জানান, প্রতীক বরাদ্দের পর অ্যাপে নিবন্ধন করা ভোটারদের কাছে প্রার্থীর প্রতীকের ছবিসহ ব্যালট পেপার ডাকযোগে পাঠানো হবে। ভোট দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খাম ফেরত পাঠালে রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোটের দিনে সেসব গণনায় অন্তর্ভুক্ত করবেন।
গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিয়েছিলেন। যদিও আগে এ নিয়ম থাকলেও প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে কেউ সাড়া দেননি। তবে এবার প্রযুক্তি-সহায়ক ব্যবস্থার কারণে শুধু নিবন্ধন করেই ব্যালট পাওয়া যাবে এবং ভোটাররা অনলাইনে খামের গতিপথও ট্র্যাক করতে পারবেন।
‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হওয়ার কথা। এর আগে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করবে এম এম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
পোস্টাল ভোটের জন্য আইন সংশোধনের প্রস্তাব ইতিমধ্যে সরকারকে পাঠানো হয়েছে। নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও ভোটিংয়ের নিয়ম ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, পাশাপাশি প্রবাসীদের কাছে প্রচারও শুরু হয়েছে।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি অ্যাপ চালু হবে। একই অ্যাপের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার, দেশের বাইরে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মী ও আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরা নিবন্ধন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, দেশের ভেতরে ও বাইরের প্রক্রিয়া একই থাকবে, শুধু সময়ের পার্থক্য হবে। প্রবাসীদের জন্য আগে, আর দেশের ভেতরে যারা থাকবেন তাদের জন্য কিছুটা পরে। নিবন্ধনের সময় এনআইডি দিয়ে তথ্য যাচাই করতে হবে। প্রবাসীরা প্রবাসের ঠিকানা দেবেন, আর দেশের ভেতরে যারা থাকবেন তারা নিজেদের স্থানীয় ঠিকানা দেবেন। কারাগারে থাকা ব্যক্তিদের নিবন্ধন ও সহযোগিতার বিষয়টি দেখবে কারা কর্তৃপক্ষ।
তবে দেশের ভেতরে কতজন পোস্টাল ভোটার থাকবেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে পারেনি ইসি। কারাগারের ৭১ প্রতিষ্ঠানে কয়জন ভোটার আছেন বা নির্বাচনের সময় কত সরকারি কর্মকর্তা নিজ নির্বাচনি এলাকার বাইরে থাকবেন, তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়।
ডাক বিভাগের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে ব্যালট পাঠানো হবে এবং খাম ফেরত আসবে। অন্য ভোটারদের ঠিকানায় খাম যাবে, যা নিকটস্থ ডাকঘরে জমা দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাতে হবে।
‘১০ মিনিটেই নিবন্ধন’
পোস্টাল ভোটিংয়ের অ্যাপে নিবন্ধনের জন্য সর্বোচ্চ ১০ মিনিট লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব।
তিনি বলেন, “মধ্য নভেম্বরে অ্যাপ চালু হবে। একজনের রেজিস্ট্রেশনে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট লাগবে। এনআইডি কার্ড দরকার হবে। যদি ১৫ মিনিটও লাগে, তাহলে ১৫ দিন সময়ের মধ্যে কতজন নিবন্ধন করবেন তা তখন দেখা যাবে।”
নিবন্ধন প্রক্রিয়া
-
অ্যাপ চালু করে মোবাইল নম্বর দিয়ে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
-
মোবাইলে পাঠানো ওটিপি দিয়ে নম্বর যাচাই করতে হবে।
-
ছবি তুলে ‘লাইভ ফেস ভেরিফিকেশন’ করতে হবে।
-
জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে সেলফি তুলতে হবে।
-
এনআইডির ছবি আপলোড করে যাচাই করতে হবে।
-
ঠিকানা দিতে হবে, যে ঠিকানায় ব্যালট পাঠানো হবে।
-
সব যাচাই শেষে নিবন্ধন সম্পন্ন হবে।
এরপর ভোটার ডাকযোগে ব্যালট পেয়ে নির্ধারিত নিয়মে ভোট দিতে পারবেন।
ভোট দেওয়ার নিয়ম
-
অ্যাপে দেওয়া ঠিকানায় ব্যালট পৌঁছাবে।
-
ভোটের নির্দেশনাবলী থাকবে।
-
মোবাইল নম্বর নিশ্চিত করতে হবে।
-
নিজের ছবি তুলতে হবে।
-
খামের কিউআর কোড স্ক্যান করতে হবে।
-
ব্যালটে ক্রস বা টিক চিহ্ন দিয়ে ভোট দিতে হবে।
-
খামের ভেতরে থাকা ঘোষণাপত্রে সই করতে হবে।
-
ব্যালট খামে ভরে নিকটস্থ ডাকঘরে জমা দিতে হবে।
কবে থেকে নিবন্ধন শুরু হবে এবং রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে খাম পাঠানোর শেষ সময় কী হবে, তা অ্যাপ চালুর পর জানাবে নির্বাচন কমিশন।
প্রবাসে যেখানেই থাকুন, ভোট দিয়ে ঐতিহাসিক যাত্রায় শামিল হোন: সিইসি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশিরা এবার আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাতে নির্বাচন কমিশনের ইউটিউব চ্যানেলে প্রবাসীদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, এ উদ্যোগ “দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক ঐতিহাসিক মাইলফলক” হিসেবে চিহ্নিত হবে।
প্রথমবারের মতো প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ তৈরি হওয়ায় তা ‘আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় অনেক সহজ ও কার্যকর হবে’ বলে আশ্বস্ত করেন সিইসি।
তিনি বলেন, “প্রবাস থেকে ভোট দিতে হলে আপনাকে অবশ্যই আউট অব কান্ট্রি ভোটিং-এ নিবন্ধন করতে হবে। এ জন্য খুব শিগগিরই আমরা ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করব।”
মোবাইল ফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করার পর সেখানে একটি ভিডিও থাকবে, যেখানে ধাপে ধাপে নিবন্ধন ও ভোট দেওয়ার নিয়ম দেখানো হবে।
‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপে নিবন্ধনের সময় ভোটারকে এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্টের তথ্য দিতে হবে, প্রবাসের ঠিকানা দিতে হবে। একই সঙ্গে করতে হবে ‘ফেস আইডেন্টিফিকেশন’ ও ‘লাইভনেস ডিটেকশন’।
সিইসি বলেন, “এই কাজগুলো শেষ করে নিবন্ধন সম্পন্ন হলে আপনার প্রবাসের ঠিকানায় আমাদের ব্যালট পেপার পৌঁছে যাবে। ব্যালট ফেরত পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় খামও একই ঠিকানায় পাঠানো হবে। ভোট দেওয়ার পর খামটি কেবল পোস্ট অফিসে জমা দিলেই যথাযথ ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশি হয়ে প্রবাসে থাকেন এবং ভোট দিতে আগ্রহী হন, তাহলে অবশ্যই নিবন্ধনের সুযোগটা নিতে হবে। আমরা আশা করব, সব প্রবাসী ভাই-বোন এ সুযোগ কাজে লাগাবেন।”
পোস্টাল ভোটিংয়ের বিস্তারিত তথ্য ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ ছাড়াও বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও ইসির ওয়েবসাইট থেকে জানা যাবে।
সিইসি বলেন, “একটা শিশু যখন প্রথম হাঁটতে শেখে, সেটাই তার প্রথম পদক্ষেপ। প্রবাসী ভোটের জন্য এটিই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ—একটি ঐতিহাসিক সূচনা। আমরা চাই প্রবাসী ভাইবোনেরা এই অভিযাত্রায় অংশ নেবেন এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে আমরা এটিকে আরও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারব।”
















