৩২ নম্বর ভাঙার সময় নীরব ছিলেন কেন? ইউনূসকে লন্ডনের চ্যাথাম হাউজে প্রশ্ন
- আপডেট সময় : ০৬:৫৩:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
- / 266

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ছয় ঘণ্টা ধরে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় অন্তর্বর্তী সরকার নীরব ছিল কেন- যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে এক সাংবাদিকের কাছে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার (১১ জুন ২০২৫) লন্ডনের চ্যাথাম হাউজে এক আয়োজনে স্থানীয় সংবাদকর্মী সামিয়া আক্তার তাকে এই প্রশ্ন রাখেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার সরাসরি জবাব না দিয়ে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সরকারে আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা বাধা বিঘ্নের কথা বলেন। জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলি, মানুষের প্রাণহানির কথা বলেন। কিন্তু ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন ভাঙার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বললেন না।
সেই সংবাদ কর্মী ইউনূসের কাছে প্রশ্ন রাখেন, “যখন আপনি ৮ আগস্ট প্রথম ঢাকায় বিমানবন্দরে পৌঁছান, আপনি বলেছিলেন যে, আপনার প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে মানুষকে একতাবদ্ধ করা। আমরা যখন দেখলাম, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি ছয় ঘণ্টা ঘরে সিটি করপোরেশনের বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, আমরা দেখলাম প্রশাসন নীরব ছিল।”
ইউনূসের জবাব ছিল, “সহজ উত্তর হলো, অনেক প্রশ্ন অনেক বিষয়, সব একসঙ্গে ঘটে গেছে। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে সব সামাল দিতে পারিনি।
“এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি… এখন পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। শৃঙ্খলা আনাটাই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। কারণ, আমরা যে পুলিশ পেয়েছি, কাল যে পুলিশ শিশুদেরকে গুলি করেছে। আজ হঠাৎ করে তারা রাস্তা ফাঁকা করতে বললে, চলে যেতে বললে মানুষ প্রশ্ন করে, ‘আপনি কে?’
“তারা আপনাকে (পুলিশকে) পেটাবে। কারণ, ‘তুমি আমার ছেলেকে মেরেছ, তুমি আমার ভাইকে মেরেছ, আমার বোনকে মেরেছ। এখন তুমি আমাকে বলছ আমি কী করব?’।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “পুলিশ তারা রাস্তায় যেতে ভয় পেয়েছে। আমরা একটা ডেডলক সিচুয়েশনের মধ্যে ছিলাম। আমরা জানতাম না কীভাবে এটাকে সামাল দেব।”
যেভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিজাদুঘরে হামলা করে আগুন দেওয়া হয়। লুটপাটও চলে।
পরে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে সেই বাড়ি ভেঙে দেয় একদল মানুষ। সে সময় ঢাকা সিটি করপোরেশনের এক্সকেভেটর ব্যবহার করা হয়, আরও কয়েকশ মানুষ হাতুরি বাটাল নিয়ে আসে।
গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতে অবস্থান নেওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন বলে ঘোষণা আসে আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে।
এই ঘটনায় জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা ক্ষুব্ধ হয়। দেশের বাইরে থেকে কয়েকজন ইউটিউবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। তাদের দৃষ্টিতে এই বাড়িটি ‘ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর।’
এরপর বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটি-এনসিপির বেশ কয়েকজন নেতা ফেসবুকে ঘোষণা দেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নতুন ইতিহাস গড়ার কথা বলেন।
৫ ফেব্রুয়ারি রাতের পরে সেখানে জড়ো হয় একদল মানুষ। পরে আসে এক্সকেভেটর।
গত ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি এক্সকেভেটর ব্যবহার করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় সরকার নীরব ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত বাড়িটি ভেঙে দেওয়ার জন্য রাতে সেখানে জড়ো হওয়ার পর সেনা সদস্যরা গেলেও পরে দুয়োধ্বনীর মধ্যে তারা ফিরে আসে। টানা দুই দিন ধরে চলে ভাঙাভাঙির কাজ।
এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি আসে। এতে বলা হয়, “ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। পলাতক অবস্থায় ভারতে বসে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে জনমনে গভীর ক্রোধের সৃষ্টি হয়েছে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। গত ছয় মাসে ৩২ নম্বর বাড়িটিতে কোনো ধরনের আক্রমণ, ধংসযজ্ঞ হয়নি। গতকাল রাতে এটি ঘটেছে পলাতক শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে।”
‘ভাগ্য ভালো এটা এখন কমে এসেছে’
ইউনূস এই বাড়িটি ভাঙার বিষয়ে সরাসরি কিছু উক্তি না করলেও পরে বলেন, “আমরা সময় নিয়েছি, ভাগ্য ভালো এটা এখন কমে এসেছে। মানুষ এখন পুলিশকে গ্রহণ করেছে।”
পুলিশদের মধ্যে যারা অপরাধী তাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এবং যে ভয়ংকর ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে গেছে, অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেকের বিচার চলছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
“তুমি ওই মানুষকে চেন। এটা এমন না যে কিছু পুলিশ সদস্য। আমি চিনি কোন ব্যক্তি এটা করেছে, আমার সামনে আমি ভিডিও করেছি। ভিডিও দেখাতে পারব। বাংলাদেশে যে পুরো জিনিসটা ঘটেছে, তার ভিডিও আছে সব জায়গায়। সব রেকর্ড আছে।”
লন্ডনের চ্যাথাম হাউজে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের একাংশ।
২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এটা একটা অসাধারণ রকমের অভ্যুত্থান। প্রত্যেকটা ঘটনার রেকর্ড আছে। শুধু একটা কারও না, প্রত্যেকের হাতে ক্যামেরা। এসবগুলো এক জায়গায় করা হচ্ছে, সবাইকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমরা বলছি না আমাদের সরকার সব সমস্যা সমাধান করে ফেলেছে, আমাদের পুলিশ এখন আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।”
আপনি কি দেশের একাংশের মানুষের প্রধান উপদেষ্টা?
সংবাদকর্মী সামিয়া আক্তারের প্রশ্নের আরেকটি অংশ ছিল। তিনি ইউনূসকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি বিভাজন তৈরি করেছেন নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের সমর্থকদের বাদ দিয়ে। আপনি কীভাবে তাদেরকে বাদ দিয়ে ঐক্য গড়ে তুলবেন? আপনি কি শুধু নির্দিষ্ট দল ও তাদের সমর্থকদের বাদ দিয়ে বাকি অর্ধেক মানুষের প্রধান উপদেষ্টা?’’
এবারও প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য আমাদের এক নম্বর লক্ষ্য। আমরা সবার সাথে বসছি, জুলাই সনদ তৈরি হচ্ছে। এটা সহজ ব্যাপার ছিল না যে সব দল বসবে এবং বিতর্ক করবে।
“আমরা এগুলো করছি, আমি এখানে প্রতিজ্ঞা করছি, আমি আশা করছি এটা জুলাই মাসে দিতে পারব। আগামী মাসই জুলাই। সনদ ঘোষণা করা হবে সব রাজনৈতিক দলের সামনে।”
“ওইটা সবচেয়ে ভালো ঐক্য। আপনি একটি দেশের থেকে পাবেন বিপ্লবের এক বছরের মধ্যে”, বলেন তিনি।


















