সিরাজ উদ্দিন আহমদ : আলোকিত সমাজ নির্মাণের অগ্রদূত
ছরওয়ার আহমদ
- আপডেট সময় : ০২:৫৫:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
- / 942

সিরাজ উদ্দিন আহমদ এমনই একজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব।পেশাগত জীবনে একজন প্রকৌশলী হলেও মহান মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক, প্রশাসক, শিক্ষানুরাগী ও সংগঠক হিসাবে তিনি অধিক পরিচিত।
সিরাজ উদ্দিন আহমদের বাড়ী সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার মোল্লাপুর ইউনিয়নের মোল্লাপুর গ্রামে। জন্ম ৪ এপ্রিল ১৯৩৫ সালে ‘আব্দুল বাকী’ গোত্রে। পিতা হাজী মো: ফরজমন্দ আলী, মাতা গুলজাহান বিবি। দাদা মুফিজ আলী, দাদি পরিজা বিবি।
তাঁর নানা বাড়ি মোল্লাপুর গ্রামের ‘মজম খাঁ’ গোষ্ঠী। নানা ইউছুফ আলী, নানি ফরমুজা বিবি। ৭ ভাই-বোন হলেন যথাক্রমে ছরকুম আলী, মো: নিমার আলী, মিম্বর আলী, সিরাজ উদ্দিন আহমদ, ডাক্তার আলাউদ্দিন আহমদ, ছুফিয়া খানম কুসুম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাদ উদ্দিন আহমদ।
তাঁর পিতা বৃটিশ জাহাজে চাকুরী করতেন বিধায় তিনি মূলত মায়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেছেন। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন মোল্লাপুর জামে মসজিদ থেকে। প্রাথমিক শিক্ষা মোল্লাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এর অধীনে ১৯৫৪ সালে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন।এবং সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেন।
উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে জন্য ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে পপলার টেকনিক্যাল কলেজ(বর্তমান পপলার ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি) থেকে ডিগ্রি অর্জন করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এবং পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যোগদান করেন।
খ.
১৯৬৭ সালে মৌলভীবাজার জেলার সদর পৌরসভাধীন ‘কালিমাবাদ’ এর মো আব্দুর রাজ্জাক (সাবেক শিক্ষক, মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ও আসরাফুন নেছা ( সাবেক শিক্ষক, মডেল প্রাইমারি স্কুল উমরপুর) এর কন্যা রোকেয়া বেগম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার সহধর্মিণী রোকেয়া বেগম ওসমানী মেডিকেল উচ্চ বিদ্যালয় সিলেট এর সাবেক প্রধান শিক্ষক।
বিবাহ পরবর্তী সিরাজ উদ্দিন আহমদ তার কর্মস্থলে যোগদান করেন ও সস্ত্রীক পাবনায় বসবাস করেন। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি জান্তার অবৈধ চাপিয়ে দেয়া শাসন ব্যবস্থা ও নির্বিচারে বাংলার মানুষকে হত্যার বিরুদ্ধে অসহযোগ প্রতিবাদ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দেশপ্রেমিক পেশাজীবীদের মত তিনিও সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে স্ত্রী সন্তান সহ সিলেট চলে আসেন।
তখন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হওয়াতে যাত্রাপথ ছিল অত্যন্ত দুর্বিসহ। দীর্ঘতম যাত্রায় পায়ে হাটা ও মালামাল পরিবহণের ভ্যান ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। এভাবে পায়ে হেটে ও ভ্যানের সহযোগিতায় সিলেট পৌঁছতে তাঁদের প্রায় দুই মাস সময় লেগেছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও আল-বদরদের চোখ ফাঁকি দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ চলছিল বিধায় এ যাত্রা একাধারে হয়নি। চলার পথে বিভিন্ন জায়গায় অপরিচিত মানুষ তাদের বিনে পয়সায় থাকা,খাওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। এই স্বাধীনতা প্রেমী মহতী মানুষদের কথা আজও তিনি কৃতজ্ঞতা ও গর্বচিত্তে স্বরণ করেন।মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় মুক্তিকামী দেশপ্রেমিক মানুষদের কথা বলতে তাদের উদাহরণ সর্বাগ্রে দেন।
গ.
সিলেটে এক আত্মীয়ের বাসায় স্ত্রী ও সন্তান রেখে তিনি নিজ গ্রামে চলে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ তরান্বিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে অবিরাম কাজ করতে থাকেন। তাঁর বড় ভাই মিম্বর আলী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। ভারতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাণ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালীদের দেয়া আর্থিক অনুদান সহ অন্যান্য সহযোগিতা দিতে যুক্তরাজ্য থেকে যে পাঁচ জন প্রতিনিধি প্রথম ভারতে যান, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সিরাজ উদ্দিন আহমদের বড় ভাই মিম্বর আলী।
তাঁর ছোট ভাই ছাদ উদ্দিন আহমদ ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা ও বীরমুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তার পরিবারের ভূমিকা ও পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থক হওয়ার অপরাধে ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল তাদের সিলেট শহরে শাহী ঈদগাহ অবস্থিত বাসাটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। তখন গ্রামের বাড়ীও তাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। তাই গ্রামে থাকা মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন। বাড়িতে পার্শ্ববর্তী ঘরে থাকেন শুধু চাচাতো ভাইদের পরিবার। সিরাজ উদ্দিন আহমদ ও তাঁর বড় ভাই নিমার আলী বিভিন্ন জায়গায় আত্নগোপনে থাকলেও মাঝে মধ্যে রাত্রিবেলা বাড়ীতে আসতেন ভারত থেকে পরিচালিত জয় বাংলা রেডিওতে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতার সংবাদ শুনতে। জয় বাংলা রেডিওতে প্রতিদিন রাত সাতটায় সংবাদ প্রচারিত হতো।
২২ জুলাই সংবাদ শুনতে বাড়ী আসলে সেদিন সংবাদ যথারীতি রাত সাতটায় শুরু না হয়ে সাড়ে সাত টায় শুরু হয়। সংবাদ শুনতে আসেন পাশের বাড়ীর মস্তুফা উদ্দিন। সংবাদ শেষ পরবর্তী ঘর থেকে বের হয়ে সিরাজ উদ্দিন আহমদ ও তার ভাই মো: নিমার আলী বাড়ির ডানদিকে নূর উদ্দিন ( সম্পর্কে মামা) এর বাড়ী যাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন এবং মস্তুফা উদ্দিন বাম দিকে নিজ বাড়িতে রওয়ানা দিতে গিয়ে তার পাশে লাইটের আলো দেখতে পেলে তিনি আর্মি বা রাজাকার সন্দেহে কোনো শব্দ না করে মাটিতে শুয়ে পড়েন। পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকাররা ডান-বাম কোনদিকে না চেয়ে সরাসরি বাড়ীর ভিতরে ঢুকে পড়ে। তাই সেদিন তারা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
বাড়ীর ভিতরে তাদের চাচাতো ভাই হারিছ আলীকে পেয়ে পাকিস্তানি আর্মি তাদের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তারা তাদের সিলেটের বাসায় থাকেন।‘‘ সিলেটের বাসা ইতিপূর্বে পোড়ানো হয়েছে এই তথ্য পাকিস্তানি আর্মির কাছে থাকায়- মিথ্যা বলছেন অপরাধে হারিছ আলীকে শারীরিক নির্যাতন করে এবং পরদিন বিয়ানীবাজার উপজেলার ডাক বাংলোতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে যায়। পরদিন হারিছ আলী বিয়ানীবাজার ডাক বাংলোয় উপস্থিত হওয়ার পূর্বে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার বাড়ীতে উপস্থিত হয়। তখন জুম্মার নামাজের আজান চলছিল।ঠিক এই অবস্থায় আর্মি ও রাজাকাররা বসত ঘরে আগুন লাগিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।
আর্মি যখন চলে যায় তখন গ্রামের মানুষ আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও ইতিপূর্বে ঘরে থাকা সবকিছু ছাই হয়ে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই দীর্ঘ নয় মাস তাদের পুরো পরিবারকে দুর্বিসহ কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশের প্রশাসনিক কাঠামো বলতে কিছুই ছিল না। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মনোনীত লোক দিয়ে প্রশাসন সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। সেই হিসেবে বিয়ানীবাজার থানায় প্রশাসনিক কোনো কর্মকর্তা না থাকায় সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সিরাজ উদ্দিন আহমদকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তখন বেশিরভাগ মামলা ছিল পাকিস্তানি এদেশীয় দালাল, রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক ধৃত দালালদের মামলাগুলো লিখে অপরাধীর অপরাধ বিবেচনায় কাউকে সিলেট জেলে পাঠানো হতো। আবার কম অপরাধীর বেলায় মামলা লিপিবদ্ধ করে সপ্তাহে একদিন অথবা প্রতিদিন থানায় নির্দিষ্ট সময়ে হাজিরা দেয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়া হতো। এই কাজের পাশাপাশি তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দিন রাত তিনি সদ্য স্বাধীন মাতৃভূমির মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন।
ঘ.
সিরাজ উদ্দিন আহমদের নিজ গ্রাম মুল্লাপুরে কোনো মাধ্যমিক স্কুল না থাকায় গ্রাম ও আশপাশের লোকদের সমন্বয়ে মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে লক্ষ্যে মোল্লাপুর ইউনিয়ন অফিস সম্মুখে ১৯৭২ সালের দুই জানুয়ারী রবিবার তার বড় ভাই নিমার আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় গ্রামে মোল্লাপুর ইউনিয়ন এর নামে একটি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। এবং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি সাংগঠনিক কমিটি করা হয়। সেই কমিটিতে সিরাজ উদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব দেয়া হয়। সাংগঠনিক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন- সভাপতি ইউছুফ আলী ( মোল্লাপুর মোল্লাগুষ্টি), সাধারণ সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন আহমদ, সদস্য (১) মস্তফা উদ্দিন আহমদ (২) মাসুক মিয়া (৩) আবুল হোসেন বাঙালী (৪) বদরুল হক (৫) আক্তার হোসেন (৬) প্রধান শিক্ষক (৭) মৌলানা ফজলুল হক (৮) আব্দুল হক ( ৯) ইশাদ আলী।
এই সভা থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য সাংগঠনিক কমিটিকে অনুরোধ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি গ্রামের পরিত্যক্ত এম.এন প্রাইমারি স্কুলে সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি -ইউছুফ আলীর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক সিরিজ উদ্দিন আহমদ এর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারী তারিখের সভার কার্য বিবরণীকে অনুমোদন করা হয়। এবং সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় পরিত্যক্ত এম এন প্রাইমারী স্কুলে অস্থায়ীভাবে স্কুলের কর্যক্রম শুরু করা। প্রসঙ্গত বর্তমান মোল্লাপুর- নিদনপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এর পূর্বের নাম ছিল এমএন প্রাইমারী স্কুল।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন আহমদকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ।এবং স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চাঁদা আদায়ের জন্য সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ইউছুফ আলী, নিমার আলী, মস্তফা উদ্দিন আহমদ ও মাসুক মিয়া কে দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ইউছুফ আলীর সভাপতিত্বে সভায় অস্থায়ী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কর্যক্রম শুরু করার জন্য সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষকবৃন্দ,স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন এর পাশাপাশি স্কুলের ভূমি দাতা- নিমার আলী (মোল্লাপুর-বিজি), মৌলানা ফজলুল হক ( মোল্লাপুর -এমজি), মো আব্দুর রহমান আসুক মিয়া (মোল্লাপুর-ইউজি), মছদ্দর আলী (মোল্লাপুর-এমকে), সিরাজ উদ্দিন (মোল্লাপুর-নিয়ামত খা, বর্তমান যুক্তরাজ্য প্রবাসী), উল্লেখিত সবাই প্রায় এক একর ভূমি দান করেন, যার মূল্য এগারো হাজার টাকা। উক্ত দাতাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়।
১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি তারিখের সভায় মোল্লাপুর ইউনিয়ন অফিস সংলগ্ন দক্ষিণের টিলাকে স্কুলের স্থান নির্বাচনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়।
সভায় স্কুলের ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে টিলার মাটি কাটার জন্য নিমার আলী, মস্তফা উদ্দিন আহমদ, ইউছুফ আলী ও মাসুক মিয়াকে দায়িত্ব দেয়া হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্নে যেসব শিক্ষকবৃন্দকে নিয়োগ দেয়া হয় তারা হলেন- প্রধান শিক্ষক শ্রী সুবর্ণ দাস (বিএ) ,সহকারী শিক্ষক মৌলানা মাহমুদুর রহমান খান (এমএম), রোকেয়া বেগম (এইচএসসি)।
২৯ শে নভেম্বর ১৯৭২ স্কুলটি অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে স্কুলের জন্য নির্ধারিত ভূমিতে নির্মিত টিন শেডের ঘরে স্থানান্তরিত হয়। এবং বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর উপস্থিতিতে উদ্বোধনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত করার জন্য প্রধান ভূমিকা রাখেন মোল্লাপুর গ্রামের গর্ব তৎকালীন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম।
স্কুল নিবন্ধন ও এমপিও ভুক্ত করতে যেসব ডকুমেন্ট প্রয়োজন সেই কাগজপত্র তৈরি করে দিতে সহায়ত করেন বিয়ানীবাজার উপজেলার দেউলগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় এর সাবেক প্রধান শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন আহমদ এর একসময়ের ব্যবসায়ী পার্টনার খলিলুর রহমান (পিতা: মৌলানা আব্দুল আলী, গ্রাম: ঘুঙ্গাদিয়া, উপজেলা: বিয়ানীবাজার)।
তখন স্কুলের নিবন্ধন ও এমপিওভূক্তির কাজ চট্টগ্রাম ডাইরেক্টর অফিস থেকে করতে হতো। তাই নিবন্ধন ও এমপিও ভোক্তিক প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র নিয়ে সিরাজ উদ্দিন আহমদ চট্টগ্রাম যান। সেখানে তাঁর বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার হুমায়ুন খোরশেদ আলম চৌধুরী( বাড়ি কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম) এর স্বরণাপন্ন হন। হুমায়ুন খোরশেদ আলম চৌধুরীর এক মামা চট্টগ্রাম ডাইরেক্টর অফিসে কাজ করতেন। তাই খোরশেদ আলমের সহযোগিতায় তার মামার মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে স্কুল নিবন্ধন ও এমপিওভূক্ত করা সম্ভব হয়।
স্কুল নিবন্ধন এর ক্ষেত্রে জেলা শিক্ষা অফিসারের স্কুল পরিদর্শন পরবর্তী যে ইতিবাচক রিপোর্টের প্রয়োজন হয় তা করে দেন তৎকালীন জেলা শিক্ষা অফিসার আলী মাহমুদ খান। মৌলভীবাজার জেলার কনকপুর গ্রামের সন্তান আলী মাহমুদ খান সম্পর্কে সিরাজ উদ্দিন আহমদের তালই। স্কুল এর প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক সিরাজ উদ্দিন আহমদ এর স্ত্রী রোকেয়া বেগম স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা রয়েছেন।
আজ মোল্লাপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠালগ্নে উল্লেখিত ব্যক্তি ব্যতীত নিজ গ্রামের মানুষ সহ আশপাশ গ্রামের লোকজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা স্বেচ্ছাশ্রম, বুদ্ধি ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সেজন্য তিনি শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ঙ.
মুল্লাপুর গ্রামের চারদিকে যেসব মাধ্যমিক স্কুল আছে- এগুলোর প্রতিটির দূরত্ব প্রায় দু থেকে তিন মাইল।ফলে সেসময় অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার অভাবে বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত। সেকারণে অতীতে মুল্লাপুর গ্রামে উচ্চ শিক্ষার হার ছিল কম। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়া রোধ হয়। অভিবাবকদের মধ্যেও ব্যাপকহারে সচেতনতা ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে মুল্লাপুর গ্রামের শিক্ষার হার এখন বিয়ানীবাজার উপজেলার মধ্যে যেমন অন্যতম। তেমনি বর্তমানে মোল্লাপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসাবেও স্বীকৃত।
সিরাজ উদ্দিন আহমদ মোল্লাপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা দাতা সদস্য। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন সময় তিনি স্কুলের উন্নয়নের লক্ষ্যে স্কুল ফান্ডে পনের হাজার টাকা দান করেন। শিক্ষার উন্নয়নে শুধু মোল্লাপুর স্কুলে তার ভূমিকা সীমাবদ্ধ নেই। তিনি দীর্ঘ দিন সিলেট কাজী জালাল উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত থেকে স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রেখেছেন।
শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত নিজ অঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেয়ার এই মহতী কাজটি সম্পাদন করার সুযোগ পেয়ে তাঁর জীবন সার্থক হয়েছে মনে করেন তিনি।
শিক্ষাব্রতী সিরাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘এই মহতী কাজটি সম্ভব হয়েছে এলাকাবাসীর আন্তরিক সহযোগিতায়। মুল্লাপুর ইউনিয়ন তথা বিয়ানীবাজারবাসীর শিক্ষা ,সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চর্চা ও বিকাশে মোল্লাপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় অন্যন্য ভূমিকা রাখছে। ১৯৭২ সালের দুই জানুয়ারীর উদ্যোগে আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের যে স্বপ্নবীজ বপন করা হয়, তা ধীরে ধীরে ফলবতি বৃক্ষ থেকে মহীরুহে পরিণত হতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটির কর্মকতা সহ এলাকাবাসীর নিরলস সহযোগিতা অসীম। তাদের প্রতি আমি গর্বচিত্তে শ্রদ্ধা , কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও দোয়া করি ।’’
চ.
সিরাজ উদ্দিন আহমদ স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৩ সালে সিলেট জেলায় প্রথম হোন্ডা মোটর বাইক এর ডিলারশিপ এনে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। এছাড়া বেবিফুড এর এক্সপোর্ট – ইমপোর্ট ব্যবসায় জড়িত হন। এছাড়াও সিলেটে তাঁর ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা ছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায় ছিলেন। ১৯৯৩ সাল পরবর্তী তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে সস্ত্রীক সিলেট শহরের আখালিয়ায় বসবাস করছেন।
তাঁর বিদেশ ভ্রমণের দেশগুলো হলো- ভারত, নেপাল,কানাডা, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরব। ১৯৯৩ সালে তিনি হজ্জ করতে সৌদি আরব যান।
সিরাজ উদ্দিন আহমদ একজন দেশপ্রেমিক, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবীর পাশাপাশি একজন সফল পিতা। তিনি ২ছেলে ও ১ মেয়ের গর্বিত পিতা। তার বড় ছেলে আহমদ সাব্বির মুন গ্রাজুয়েশন পরবর্তী বৃটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের পাশাপাশি একজন সফল ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় ছেলে আহমদ নাছিম সাইদী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর সাবেক সহকারী অধ্যাপক ( অর্থনীতি বিভাগ)। আহমদ নাছিম সাইদী কানাডায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন পরবর্তী কানাডার কর্মসংস্থান ও সামাজিক উন্নয়ন বিভাগে ডাইরেক্টর হিসেবে বর্তমানে কর্মরত। একমাত্র কন্যা জাফরিন আহমদ লিজা সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ( নৃবিজ্ঞান বিভাগ) এর সহযোগী অধ্যাপক। বর্তমানে পিএইচডি অধ্যায়নরত।
সিরাজ উদ্দিন আহমদ বয়সের ভারে কিছুটা দুর্বল হলেও তারুণ্য মন নিয়ে এখনও মানুষ ও সামাজিক কাজ ভালোবাসেন। প্রাতিষ্ঠানিক কাজে অবসর নিলেও দেশপ্রেম, ভালো কাজ ও মানুষের ভালোবাসা তাকে বৃদ্ধ বয়সেও আন্দোলিত করে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নির্মাণের অন্যতম সংগঠক এর যেন একটাই পরম চাওয়া – বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির বন্ধন যেন অটুট থাকে। মাতৃভূমির মানুষ চিরকাল যেন- দুধে ভাতে থাকে।
ছরওয়ার আহমদ : সাবেক ভিপি বিয়ানীবাজার সরকারী কলেজ, সিলেট। হেড অব কমিউনিটি অ্যাফেয়ার্স,৫২বাংলা টিভি ও কমিউনিটি সংগঠক।
আঠারো মে দুই হাজার পঁচিশ ,লন্ডন



















