ঢাকা ০৬:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

ভারত থেকে ‘পুশ ইন’ এক হাজার ছাড়াল

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০২:০৩:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
  • / 374
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার সোনাইপুল এলাকায় নদীর তীর থেকে গত ২২ মে উমেদ আলী (৪৭), তার স্ত্রী সেলিনা বেগম (৪১) এবং তাদের তিন কন্যাকে উদ্ধার করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উমেদ, সেলিনা ও তাদের সন্তান রুমি খাতুন (১৬), রুম্পা খাতুন (১৫) এবং ছয় বছরের সুমাইয়া খাতুনের শরীর ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। প্রথমে তাদের দেখতে পান স্থানীয় বাসিন্দা রানা। তিনি বলেন, “তারা হতবিহ্বল অবস্থায় ছিল। শিশুরা ভীত, আর তাদের দেখে মনে হচ্ছিল ঠান্ডায় জমে গেছে। আমরা দ্রুত বিজিবিকে ফোন করে জানাই।”

উদ্ধারের পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহামুনী ক্যাম্পের সদস্যরা পরিবারটিকে নিজেদের হেফাজতে নেন। সেলিনা জানান, পানিতে যেন ভেসে থাকতে পারেন, এজন্য তার এবং মেয়েদের শরীরে অনেকগুলো খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমরা সারা রাত পানিতে ভেসে ছিলাম। আমাদের কেউ সাঁতার জানি না।”

পরিবারটির ভাষ্য অনুযায়ী, তারা হরিয়ানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা কেড়ে নেয় এবং সীমান্তের কাছাকাছি এনে ফেনী নদীতে ফেলে দেয়। উমেদ আলী বলেন, “তারা কোনো করুণাও দেখায়নি, এমনকি আমাদের সঙ্গে শিশুরা রয়েছে— সেটাও তারা উপেক্ষা করেছে।”

এটি কোনো একক ঘটনা নয়। গত তিন সপ্তাহ ধরে ভারত থেকে অনেককেই নির্যাতনের পর জোরপূর্বক সীমান্তে এনে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গত ১০ মে দিল্লি পুলিশ এক দম্পতিকে আটক করে এবং আরও ৪৬ জনসহ থানায় নিয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪৫ বছর বয়সী এক নারী বলেন, তারা গত ১০ বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন। “পুলিশ আমাদের হেফাজতে নেয়। তিন দিন আমাদের কোনো খাবার বা পানি দেওয়া হয়নি। এরপর গভীর রাতে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়,” জানান তিনি।

গত মঙ্গলবার লালমনিরহাট সীমান্তের শূন্যরেখায় এক বছর বয়সী মেয়ে মরিয়াম আক্তারকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন মানিকজান বেগম। এক পা এগোলেই নতুন জীবনের দোরগোড়া, কিন্তু সেই জীবন ঘেরা অনিশ্চয়তায়। অসংখ্য নারী ও শিশুকে এইভাবে জোর করে সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়ার চিত্রগুলো অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।

বিজিবির সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মে থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মোট ১,০৫৩ জনকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হয়েছে।

বিজিবির হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা বিভিন্ন সীমান্তভেদে নিম্নরূপ: খাগড়াছড়ি দিয়ে ১১১ জন, কুড়িগ্রাম ৮৪, সিলেট ১০৩, মৌলভীবাজার ৩৩১, হবিগঞ্জ ১৯, সুনামগঞ্জ ১৬, দিনাজপুর ২, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৭, ঠাকুরগাঁও ১৯, পঞ্চগড় ৩২, লালমনিরহাট ৭৫, চুয়াডাঙ্গা ১৯, ঝিনাইদহ ৪২, কুমিল্লা ১৩, ফেনী ৩৯, সাতক্ষীরা ২৩ এবং মেহেরপুর দিয়ে ৩০ জন।

এ ছাড়া সুন্দরবনের দুর্গম মণ্ডারবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে আরও ৭৮ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে।

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, “পতাকা বৈঠক ও কূটনৈতিক চ্যানেলে বারবার প্রতিবাদ জানানোর পরও বিএসএফ ও ভারতের অন্যান্য সংস্থা এ ধরনের ‘পুশ ইন’ অব্যাহত রেখেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।”

তিনি বলেন, “বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে এবং স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকাগুলোতে টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনার দায় স্বীকার করছে না, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি মিথ্যাচারের শামিল।”

তার ভাষায়, “পুশ ইন করা অনেকেই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি হলেও তারা বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন। তাদের সন্তানদের কেউ কেউ ভারতেই জন্ম নিয়েছে এবং তাদের ভারতের বৈধ কাগজপত্রও ছিল। কিন্তু জোর করে সেসব কাগজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, এ ধরনের একতরফা পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও স্বীকৃত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার লঙ্ঘন। স্বচ্ছ ও সম্মতিপূর্ণ প্রক্রিয়াই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ।”

একটি সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২২ মে হরিয়ানার বাসিন্দা পাঁচ বাংলাদেশি নারী ও শিশুকে ফেনী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

এছাড়া ৭ মে ভারতের ইউএনএইচসিআর-নিবন্ধিত পাঁচ রোহিঙ্গাকে কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, “এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। অনেকেই শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। বিজিবি প্রতিটি ঘটনার তথ্য, ছবি ও সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে যথাযথ কূটনৈতিক চ্যানেলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে।”

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ভারত থেকে ‘পুশ ইন’ এক হাজার ছাড়াল

আপডেট সময় : ০২:০৩:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার সোনাইপুল এলাকায় নদীর তীর থেকে গত ২২ মে উমেদ আলী (৪৭), তার স্ত্রী সেলিনা বেগম (৪১) এবং তাদের তিন কন্যাকে উদ্ধার করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উমেদ, সেলিনা ও তাদের সন্তান রুমি খাতুন (১৬), রুম্পা খাতুন (১৫) এবং ছয় বছরের সুমাইয়া খাতুনের শরীর ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। প্রথমে তাদের দেখতে পান স্থানীয় বাসিন্দা রানা। তিনি বলেন, “তারা হতবিহ্বল অবস্থায় ছিল। শিশুরা ভীত, আর তাদের দেখে মনে হচ্ছিল ঠান্ডায় জমে গেছে। আমরা দ্রুত বিজিবিকে ফোন করে জানাই।”

উদ্ধারের পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহামুনী ক্যাম্পের সদস্যরা পরিবারটিকে নিজেদের হেফাজতে নেন। সেলিনা জানান, পানিতে যেন ভেসে থাকতে পারেন, এজন্য তার এবং মেয়েদের শরীরে অনেকগুলো খালি প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমরা সারা রাত পানিতে ভেসে ছিলাম। আমাদের কেউ সাঁতার জানি না।”

পরিবারটির ভাষ্য অনুযায়ী, তারা হরিয়ানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে মোবাইল ফোন ও টাকা-পয়সা কেড়ে নেয় এবং সীমান্তের কাছাকাছি এনে ফেনী নদীতে ফেলে দেয়। উমেদ আলী বলেন, “তারা কোনো করুণাও দেখায়নি, এমনকি আমাদের সঙ্গে শিশুরা রয়েছে— সেটাও তারা উপেক্ষা করেছে।”

এটি কোনো একক ঘটনা নয়। গত তিন সপ্তাহ ধরে ভারত থেকে অনেককেই নির্যাতনের পর জোরপূর্বক সীমান্তে এনে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গত ১০ মে দিল্লি পুলিশ এক দম্পতিকে আটক করে এবং আরও ৪৬ জনসহ থানায় নিয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৪৫ বছর বয়সী এক নারী বলেন, তারা গত ১০ বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন। “পুলিশ আমাদের হেফাজতে নেয়। তিন দিন আমাদের কোনো খাবার বা পানি দেওয়া হয়নি। এরপর গভীর রাতে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়,” জানান তিনি।

গত মঙ্গলবার লালমনিরহাট সীমান্তের শূন্যরেখায় এক বছর বয়সী মেয়ে মরিয়াম আক্তারকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন মানিকজান বেগম। এক পা এগোলেই নতুন জীবনের দোরগোড়া, কিন্তু সেই জীবন ঘেরা অনিশ্চয়তায়। অসংখ্য নারী ও শিশুকে এইভাবে জোর করে সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়ার চিত্রগুলো অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।

বিজিবির সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মে থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে মোট ১,০৫৩ জনকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হয়েছে।

বিজিবির হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা বিভিন্ন সীমান্তভেদে নিম্নরূপ: খাগড়াছড়ি দিয়ে ১১১ জন, কুড়িগ্রাম ৮৪, সিলেট ১০৩, মৌলভীবাজার ৩৩১, হবিগঞ্জ ১৯, সুনামগঞ্জ ১৬, দিনাজপুর ২, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৭, ঠাকুরগাঁও ১৯, পঞ্চগড় ৩২, লালমনিরহাট ৭৫, চুয়াডাঙ্গা ১৯, ঝিনাইদহ ৪২, কুমিল্লা ১৩, ফেনী ৩৯, সাতক্ষীরা ২৩ এবং মেহেরপুর দিয়ে ৩০ জন।

এ ছাড়া সুন্দরবনের দুর্গম মণ্ডারবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে আরও ৭৮ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে।

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, “পতাকা বৈঠক ও কূটনৈতিক চ্যানেলে বারবার প্রতিবাদ জানানোর পরও বিএসএফ ও ভারতের অন্যান্য সংস্থা এ ধরনের ‘পুশ ইন’ অব্যাহত রেখেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।”

তিনি বলেন, “বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে এবং স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকাগুলোতে টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনার দায় স্বীকার করছে না, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি মিথ্যাচারের শামিল।”

তার ভাষায়, “পুশ ইন করা অনেকেই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি হলেও তারা বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করছিলেন। তাদের সন্তানদের কেউ কেউ ভারতেই জন্ম নিয়েছে এবং তাদের ভারতের বৈধ কাগজপত্রও ছিল। কিন্তু জোর করে সেসব কাগজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, এ ধরনের একতরফা পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও স্বীকৃত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার লঙ্ঘন। স্বচ্ছ ও সম্মতিপূর্ণ প্রক্রিয়াই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ।”

একটি সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২২ মে হরিয়ানার বাসিন্দা পাঁচ বাংলাদেশি নারী ও শিশুকে ফেনী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

এছাড়া ৭ মে ভারতের ইউএনএইচসিআর-নিবন্ধিত পাঁচ রোহিঙ্গাকে কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, “এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। অনেকেই শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। বিজিবি প্রতিটি ঘটনার তথ্য, ছবি ও সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে যথাযথ কূটনৈতিক চ্যানেলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে।”