যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অচিরেই সাক্ষাৎ হতে পারে—এমন খবর গত কয়েকদিন ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঘুরছিল। তবে বুধবার (২৩ অক্টোবর) বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের সম্ভাব্য শীর্ষ বৈঠকের খবরটি সম্ভবত অতিরঞ্জিত ছিল।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে “দুই সপ্তাহের মধ্যেই” বুদাপেস্টে দেখা করবেন বলে ট্রাম্প ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই সেই বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রাথমিক বৈঠকও বাতিল হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকেলে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, “আমি একটা অকারণ বৈঠক চাই না। আমি সময় নষ্ট করতে চাই না, দেখা যাক কী হয়।”
এই “হবে–হচ্ছে না” বৈঠকই ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার সর্বশেষ অধ্যায়। গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তির চুক্তি করানোর পর ইউক্রেন ইস্যুটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকারে উঠে এসেছে।
গত সপ্তাহে মিশরে গাজা যুদ্ধবিরতি উদ্যাপন উপলক্ষে বক্তব্য দেওয়ার সময় ট্রাম্প তার প্রধান কূটনৈতিক আলোচক স্টিভ উইটকফের দিকে ফিরে বলেন, “আমাদের এখন রাশিয়াকে শেষ করতে হবে।”
তবে উইটকফ ও তার দলের জন্য গাজা সংকটে যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা ইউক্রেনের চার বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পুনরায় তৈরি করা কঠিন।
প্রভাব কমেছে
উইটকফের মতে, গাজা চুক্তি বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি ছিল ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত—কাতারে হামাস আলোচকদের ওপর হামলা করা। এতে আমেরিকার আরব মিত্ররা ক্ষুব্ধ হয়েছিল, কিন্তু এর ফলে ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে চুক্তির জন্য চাপ দিতে সক্ষম হন।
প্রথম মেয়াদ থেকেই ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্পের অবিচল সমর্থনের দীর্ঘ রেকর্ড রয়েছে—যেমন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর, পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি বসতি বৈধ করা এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে সমর্থন দেওয়া।
বাস্তবে ট্রাম্প ইসরায়েলিদের মধ্যে নেতানিয়াহুর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়, যা তাকে ইসরায়েলি নেতার ওপর অতিরিক্ত প্রভাবশালী করে তুলেছে।
আরব অঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকায় তার হাতে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের অনেক সুযোগ ছিল।
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতা তার অনেক কম। গত নয় মাসে তিনি পুতিন ও জেলেনস্কি দুজনকেই কখনও চাপে রাখার, আবার কখনও আপসের পথে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন—কিন্তু কোনও ফল আসেনি।
ট্রাম্প রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও ইউক্রেনকে দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র সরবরাহের হুমকি দিয়েছিলেন। তবে তিনি বুঝতে পারেন, এসব পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করতে পারে এবং যুদ্ধ আরও তীব্র করতে পারে।
এদিকে তিনি প্রকাশ্যে জেলেনস্কিকে সমালোচনা করেছেন, কিছু সময়ের জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করেছেন, অস্ত্র পাঠানো স্থগিত করেছেন—যা পরে ইউরোপীয় মিত্রদের চাপের মুখে পুনরায় চালু করতে হয়েছে। কারণ ইউক্রেনের পতন গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে।
ট্রাম্প নিজেকে এক দক্ষ আলোচক হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসেন, যিনি মুখোমুখি বৈঠকে চুক্তি চূড়ান্ত করতে পারেন। কিন্তু পুতিন ও জেলেনস্কি উভয়ের সঙ্গেই তার বৈঠকগুলো এখন পর্যন্ত যুদ্ধের সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
বরং পুতিন সম্ভবত ট্রাম্পের “চুক্তির আগ্রহ” ও “সরাসরি আলোচনার বিশ্বাস”কে নিজের কূটনৈতিক কৌশলে ব্যবহার করছেন।
গত জুলাইয়ে পুতিন আলাস্কায় এক শীর্ষ বৈঠকে রাজি হন, যখন ট্রাম্প কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সমর্থিত নিষেধাজ্ঞা বিলটিতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছিলেন। পরে বিলটি আটকে যায়।
গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস থেকে খবর আসে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে টমাহক ক্রুজ মিসাইল ও প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি-এয়ার ব্যাটারি পাঠানোর কথা ভাবছে। তখনই পুতিন ট্রাম্পকে ফোন করেন। এরপর ট্রাম্প বুদাপেস্টে সম্ভাব্য বৈঠকের ঘোষণা দেন।
পরের দিন হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সঙ্গে তার বৈঠক হয়, যা কথিতভাবে ছিল উত্তপ্ত ও ফলহীন।
পরে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি পুতিনের ফাঁদে পড়েননি—“জানো, আমি জীবনে অনেক বড় বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমিই জিতেছি।”
তবে ইউক্রেনীয় নেতা পরে ইঙ্গিত করে বলেন, “যখনই আমাদের জন্য দীর্ঘপাল্লার অস্ত্রের সম্ভাবনা কিছুটা দূরে সরে যায়, তখনই রাশিয়ার কূটনীতিতে আগ্রহ প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যায়।”
অর্থাৎ কয়েক দিনের মধ্যেই ট্রাম্প ইউক্রেনে মিসাইল পাঠানোর চিন্তা থেকে পুতিনের সঙ্গে বুদাপেস্ট বৈঠকের পরিকল্পনা এবং জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল হস্তান্তরের চাপ দিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি বর্তমান যুদ্ধরেখার ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান, যদিও রাশিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
গত বছর নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি “কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন।” কিন্তু এখন তিনি স্বীকার করেছেন—যুদ্ধ শেষ করা তার ধারণার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।
এটি তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা ও শান্তির কাঠামো তৈরির কঠিন বাস্তবতার এক বিরল স্বীকারোক্তি। কারণ দুই পক্ষের কেউই এখনো যুদ্ধ থামাতে বা হার মানতে প্রস্তুত নয়।