ঢাকা ১১:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে আরও ৩০ দেশের নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা খাঁচা থেকে বের হওয়া সিংহী আড়াই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী!

একটি লাশের দাফন ও ছাত্রলীগের ‘ওরা ৪১ জন’

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০৫:৩৯:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুন ২০২০
  • / 3116
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

“কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার কুরুইন গ্রামের অহিদুর রহমানের লাশটি কবরে নামাতে আমাদের একটি দাফনের কাপড়ের দরকার পড়লো। তার পরিবারের কাছে চাইলে,কেউই দিতে এগিয়ে আসেনি!অহিদ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে, তাই এতো ভয়।
শেষে কেউ একজন এক মহিলার একটি পুরনো ওড়না দিলেন! অহিদের শেষ বিদায়ে এই পুরাতন ময়লাযুক্ত ওড়না ব্যবহার করতে বিবেক সায় দিচ্ছিলো না,অহিদের লাশটি বুকে জড়িয়ে কবরে নামালাম।”

করোনা বিপর্যয়ে লাশ দাফনের বর্ণনায় এভাবেই হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতা জানান কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আবু কাউসার অনিক।

কুমিল্লায় হ্যালো ছাত্রলীগ “ওরা ৪১ জন লাশ দাফনটিম” নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যেখানে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতের খবর পাচ্ছেন সেখানেই ছুঁটে বেড়াচ্ছেন জেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

গত মঙ্গলবার অহিদের লাশ দাফনের গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন-
“রাত তখন ৯টা পেরিয়ে গেছে। অহিদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমরা কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগ ‘ওরা ৪১জনে’র টীম লাশ দাফনের জন্য তার বাড়িতে ছুটে গেলাম। অহিদের বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা ভুলতে পারবো না!”

অহিদের বাড়ির সামনে একটি এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। আশে পাশে খোঁজ করে কাউকে পেলাম না। ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম, লাশ কোথায়? ড্রাইভার ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। অহিদের নিঁথর দেহ এম্বুলেন্সে পলিথিন মোড়ানো কাগজে পড়ে আছে। আমরা এম্বুলেন্স থেকে লাশ ধরাধরি করে নামালাম। লাশের মালিক খোঁজতে গিয়ে কিছু দূর দেখলাম অন্ধকারে এক মহিলা বসে কাঁদছেন। জানতে পারলাম তিনি মৃত অহিদের স্ত্রী।স্বামী করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় তাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।অহিদের ভাইদের খোঁজ নিয়ে জানলাম ওরা অদৃশ্য।

মা,বোনদের কোন আলামত পেলাম না। ভয়ে কেউ লাশের পাশে আসছেন না। প্রতিবেশী সবার দরজা বন্ধ। ইউপি মেম্বার,চেয়ারম্যানকে খোঁজ করেও পাওয়া গেল না।স্থানীয় একজন প্রভাবশালী নেতা এসে তার বক্তব্য শুনালেন যে,গ্রামের নির্দিষ্ট কবরস্থানে অহিদ কে দাফন করা যাবে না।এমনকি তাদের স্বাভাবিক চলাচলের পথ দিয়ে লাশটি নিয়ে যাওয়া যাবে না।এভাবে হুঁশিয়ার করেই তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন।”

তিনি বলেন,”আমি মনে মনে অহিদের বাবার খোঁজ করলাম। জানতে পারলাম তিনি নিরাপদে বাড়িতেই আছেন!”

অনিক বলেন,”শুণেছিলাম,’পিতার কাঁধে নাকি সন্তানের লাশ পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বোঝা”
সে ভার অহিদের বাবা কেন নিতে চাইলেন না,তার জানা নেই! নীরবে চোখের পানি ছেড়ে এমন ভাবনা গুলো নিয়েই দাফন টিমকে নিয়ে অহিদের শেষ গোছল সমাপ্ত করে তার গ্রামবাসী ও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়গুলো ছাড়াই অহিদের জানাজা শেষ করেন।

তিনি বাকরুদ্ধ বর্ণনায় বলেন,”নেতার হুঁমকির কারনে অহিদের লাশ নিয়ে চললাম কৃষি জমি হয়ে কখনো কাঁদা পানি, কখনো প্রায় হাঁটো পানির পথে, পুকুর পাড় বেয়ে, কখনো বাঁশমুড়ার সরু পথ কাটিয়ে।অহিদের নিঁথর দেহ নিয়ে চলছি আমরা! ছাত্রলীগের ভাইদের কেউ জিকির পড়ছে, কেউ আমার মতো স্তব্দ। অহিদের লাশের পালকি আমার কাঁধে। ঠোঁট ফেঁটে চিৎকার বের হচ্ছে না! দু’চোখ বেয়ে অঝোর পানি ঝরছে।”

অহিদের স্ত্রী নুসরাত জানান,তার স্বামী একটি ঔষধ কোম্পানিতে চাকুরী করতেন।৩ সন্তান নিয়ে থাকতেন কুমিল্লা শহরের রেসকোর্স।৫ দিন ধরে স্বামীর জ্বর ও করোনা উপসর্গ নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ধর্ণা দিয়েও করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে পারেনি।অবস্থার অবনতি হলে মঙ্গলবার দুপুর ১ টায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।দপুর ২ টায় অহিদ মৃত্যুরণ করলে বিকেলে স্বামীর লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেলে করোনার ভয়ে শশুর বাড়ির কেউ অহিদের লাশ দাফনে এগিয়ে আসেনি।এমনকি তাকে বাড়িতে বসতে একটি চেয়ারও দেয়নি কেউ।বাধ্য হয়ে এম্বুল্যান্সেই মৃত স্বামীর লাশের পাশে সন্তানদের নিয়ে বসেছিলেন।

পরে ছাত্রলীগ খবর পেয়ে মানবিকতার ডাকে সেখানে গিয়ে দাফন সম্পন্ন করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

একটি লাশের দাফন ও ছাত্রলীগের ‘ওরা ৪১ জন’

আপডেট সময় : ০৫:৩৯:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুন ২০২০

“কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার কুরুইন গ্রামের অহিদুর রহমানের লাশটি কবরে নামাতে আমাদের একটি দাফনের কাপড়ের দরকার পড়লো। তার পরিবারের কাছে চাইলে,কেউই দিতে এগিয়ে আসেনি!অহিদ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে, তাই এতো ভয়।
শেষে কেউ একজন এক মহিলার একটি পুরনো ওড়না দিলেন! অহিদের শেষ বিদায়ে এই পুরাতন ময়লাযুক্ত ওড়না ব্যবহার করতে বিবেক সায় দিচ্ছিলো না,অহিদের লাশটি বুকে জড়িয়ে কবরে নামালাম।”

করোনা বিপর্যয়ে লাশ দাফনের বর্ণনায় এভাবেই হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতা জানান কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আবু কাউসার অনিক।

কুমিল্লায় হ্যালো ছাত্রলীগ “ওরা ৪১ জন লাশ দাফনটিম” নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যেখানে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতের খবর পাচ্ছেন সেখানেই ছুঁটে বেড়াচ্ছেন জেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

গত মঙ্গলবার অহিদের লাশ দাফনের গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন-
“রাত তখন ৯টা পেরিয়ে গেছে। অহিদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমরা কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগ ‘ওরা ৪১জনে’র টীম লাশ দাফনের জন্য তার বাড়িতে ছুটে গেলাম। অহিদের বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা ভুলতে পারবো না!”

অহিদের বাড়ির সামনে একটি এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। আশে পাশে খোঁজ করে কাউকে পেলাম না। ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম, লাশ কোথায়? ড্রাইভার ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। অহিদের নিঁথর দেহ এম্বুলেন্সে পলিথিন মোড়ানো কাগজে পড়ে আছে। আমরা এম্বুলেন্স থেকে লাশ ধরাধরি করে নামালাম। লাশের মালিক খোঁজতে গিয়ে কিছু দূর দেখলাম অন্ধকারে এক মহিলা বসে কাঁদছেন। জানতে পারলাম তিনি মৃত অহিদের স্ত্রী।স্বামী করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় তাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।অহিদের ভাইদের খোঁজ নিয়ে জানলাম ওরা অদৃশ্য।

মা,বোনদের কোন আলামত পেলাম না। ভয়ে কেউ লাশের পাশে আসছেন না। প্রতিবেশী সবার দরজা বন্ধ। ইউপি মেম্বার,চেয়ারম্যানকে খোঁজ করেও পাওয়া গেল না।স্থানীয় একজন প্রভাবশালী নেতা এসে তার বক্তব্য শুনালেন যে,গ্রামের নির্দিষ্ট কবরস্থানে অহিদ কে দাফন করা যাবে না।এমনকি তাদের স্বাভাবিক চলাচলের পথ দিয়ে লাশটি নিয়ে যাওয়া যাবে না।এভাবে হুঁশিয়ার করেই তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন।”

তিনি বলেন,”আমি মনে মনে অহিদের বাবার খোঁজ করলাম। জানতে পারলাম তিনি নিরাপদে বাড়িতেই আছেন!”

অনিক বলেন,”শুণেছিলাম,’পিতার কাঁধে নাকি সন্তানের লাশ পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বোঝা”
সে ভার অহিদের বাবা কেন নিতে চাইলেন না,তার জানা নেই! নীরবে চোখের পানি ছেড়ে এমন ভাবনা গুলো নিয়েই দাফন টিমকে নিয়ে অহিদের শেষ গোছল সমাপ্ত করে তার গ্রামবাসী ও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়গুলো ছাড়াই অহিদের জানাজা শেষ করেন।

তিনি বাকরুদ্ধ বর্ণনায় বলেন,”নেতার হুঁমকির কারনে অহিদের লাশ নিয়ে চললাম কৃষি জমি হয়ে কখনো কাঁদা পানি, কখনো প্রায় হাঁটো পানির পথে, পুকুর পাড় বেয়ে, কখনো বাঁশমুড়ার সরু পথ কাটিয়ে।অহিদের নিঁথর দেহ নিয়ে চলছি আমরা! ছাত্রলীগের ভাইদের কেউ জিকির পড়ছে, কেউ আমার মতো স্তব্দ। অহিদের লাশের পালকি আমার কাঁধে। ঠোঁট ফেঁটে চিৎকার বের হচ্ছে না! দু’চোখ বেয়ে অঝোর পানি ঝরছে।”

অহিদের স্ত্রী নুসরাত জানান,তার স্বামী একটি ঔষধ কোম্পানিতে চাকুরী করতেন।৩ সন্তান নিয়ে থাকতেন কুমিল্লা শহরের রেসকোর্স।৫ দিন ধরে স্বামীর জ্বর ও করোনা উপসর্গ নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ধর্ণা দিয়েও করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে পারেনি।অবস্থার অবনতি হলে মঙ্গলবার দুপুর ১ টায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।দপুর ২ টায় অহিদ মৃত্যুরণ করলে বিকেলে স্বামীর লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেলে করোনার ভয়ে শশুর বাড়ির কেউ অহিদের লাশ দাফনে এগিয়ে আসেনি।এমনকি তাকে বাড়িতে বসতে একটি চেয়ারও দেয়নি কেউ।বাধ্য হয়ে এম্বুল্যান্সেই মৃত স্বামীর লাশের পাশে সন্তানদের নিয়ে বসেছিলেন।

পরে ছাত্রলীগ খবর পেয়ে মানবিকতার ডাকে সেখানে গিয়ে দাফন সম্পন্ন করেন।