ঢাকা ০৫:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
আরও পেছাল খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা ইসলামে পারিবারিক নির্যাতনের কোনো স্থান নেই-শায়খ আব্দুল কাইয়ুম লিবিয়া থেকে ৩১০ বাংলাদেশি দেশে ফিরলেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে আরও ৩০ দেশের নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা খাঁচা থেকে বের হওয়া সিংহী আড়াই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না

এক যুগ পর নিবন্ধন ফিরে পাচ্ছে জামায়াত

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০১:৩৪:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫
  • / 232
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের যে রায় হাই কোর্ট দিয়েছিল, এক যুগ পরে সেটি বাতিল করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, এখন নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আপিলের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারকের বেঞ্চ রোববার (১ জুন ২০২৫) এ রায় দেয়।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই রায় এসেছে। ফলে, ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপির সঙ্গে সরকারে থাকা জামায়াতে ইসলামী এখন দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে।
রায়ের পর এক ফেইসবুক পোস্টে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান শুকরিয়া জানান। একইসাথে নির্বাচন কমিশন যেন দ্রুত নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়, সে জন্য আল্লাহর ‘সাহায্য’ চেয়েছেন তিনি।
এই মামলায় জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এহসান আব্দুল্লাহ সিদ্দিক ও মোহাম্মদ শিশির মনির। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে শুনানিতে ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম।
রায়ের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শিশির মনির বলেন, “দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময়ের আইনি লড়াইয়ের সফল অবসান হল। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী আজকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তার নিবন্ধন ফিরে পেল।”

এক নজরে জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামীর যাত্রা শুরু ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, উপমহাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে। তখন এটি ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াত রাজনীতিতে ফেরে।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং বিএনপিকে সমর্থন করে। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটিতে দাঁড়ায়, তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা মন্ত্রী হন।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল জামায়াত, তখন তারা দুটি আসন পায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযমকে ট্রাইব্যুনাল টানা ৯০ বছরের বা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। আপিল নিষ্পত্তির আগেই তিনি কারাগারে মারা যান।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয় আওয়ামী লীগের সময়ে।
এক রিট মামলায় ২০১৩ সালে হাই কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়, ফলে দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
আপিল করেও সে সময় জামায়াত পক্ষে রায় পায়নি। তবে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় বাতিল করায় এখন আবার দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে ফেরার সুযোগ তৈরি হল।

যেভাবে বাতিল হয়েছিল
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হয়।
৩৮টি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, এমন শর্ত জারি হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে হাই কোর্টে রিট করেন তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন।
তারা অভিযোগ তোলেন- জামায়াতের চারটি কারণে নিবন্ধন বাতিল করা উচিত:
প্রথমত, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে ক্ষমতার উৎস মনে করে না এবং জনপ্রতিনিধিদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে স্বীকার করে না।
দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না, অথচ জামায়াত কার্যত সাম্প্রদায়িক।
তৃতীয়ত, নিবন্ধিত দলের উচিত ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গে বৈষম্য না করা, কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে নারী বা অমুসলিম স্থান পান না।
চতুর্থত, কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা থাকা যাবে না, অথচ জামায়াত নিজেই বলে যে তাদের জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে শাখা রয়েছে।
এই রিটের পর ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট রুল জারি করে জানতে চায়, জামায়াতের নিবন্ধন কেন আইনবহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১)(বি)(২) ও ৯০(সি) লঙ্ঘন- তা ব্যাখ্যা করতে।
এরপর নিবন্ধন রক্ষায় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জামায়াত। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার জায়গায় ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার উল্লেখ আনে।
শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের বেঞ্চ রায় দেন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করা হয়।
এই রায়ের ওপর জামায়াতের স্থগিতাদেশ চাওয়ার আবেদনও ৫ অগাস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত খারিজ করে দেয়।
২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে শুধু সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে থাকবে। নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে ২০১৭ সালের ৮ মার্চ গেজেটে জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাতিল করে।
হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর জামায়াত আপিল করে। তবে প্রধান আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বেঞ্চ সেই আপিল খারিজ করে দেয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াত আবার আপিল পুনরুজ্জীবনের আবেদন করে, যা সর্বোচ্চ আদালত ২৪ অগাস্ট পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেয়।
শিশির মনিরের আবেদনের পর গত মে মাসে আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও আদালতের পর্যবেক্ষণ চাওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত রোববার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয়। বিষয়টি এখন নির্বাচন কমিশনে যাবে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।
হাই কোর্টের রায় থাকায় জামায়াত দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার অভিযোগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।

‘অংশগ্রহণমূলক সংসদ নিশ্চিত’
জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ের আইনি লড়াইয়ের সফল অবসান হলো। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী আজকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তার নিবন্ধন ফিরে পেল।
“পলিটিক্যালি মোটিভেটেড পিআইএল বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত মামলার মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আজকের এই রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক এবং অংশগ্রহণমূলক সংসদ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো।”
তিনি বলেন, “আমরা আশা করি, এই রায়ের পরে বাংলাদেশে সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত সংসদ গঠিত হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকলেই তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে বেছে নেবেন- এটা আমরা প্রত্যাশা করি।
“এবং আমরা এটাও প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশের আগামী সংসদে ইন্টারেস্টিং এবং কনস্ট্রাকটিভ বিতর্ক হবে, যার মাধ্যমে ডেমোক্রেসি একটি স্থায়ী রূপ লাভ করবে।”
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শিশির মনির বলেন, “আজকে মাননীয় আপিল বিভাগ- হাই কোর্টের যে রায় ছিল, এই রায়কে বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং ইলেকশন কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছেন- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দ্রুত নিবন্ধন এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত অন্য যেসব ইস্যু আছে, সেগুলো নিষ্পত্তি করতে।
“এরই মাধ্যমে আজকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফিরে পেল এবং প্রতীকের ব্যাপারটিও ইলেকশন কমিশনের কাছে রেফার করা হলো- আদার ইস্যু হিসাবে। এইজন্য আমরা মামলার শর্ট অর্ডার চেয়েছি, আমরা আশা করি- আগামীকালকের মধ্যেই মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ আমরা হাতে পাব।
“এই সংক্ষিপ্ত আদেশ আমরা ইলেকশন কমিশনের কাছে অ্যাপ্রোচ করব, বাকিটা ইলেকশন কমিশন আইন অনুযায়ী অতি দ্রুত জামায়াতের নিবন্ধন এবং জামায়াতের প্রতীক বুঝিয়ে দেবেন- এইটা আমরা প্রত্যাশা করি।”
এক প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, “আজকের ডাইরেকশনে আপিল বিভাগ বলেছেন- জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি ইলেকশন কমিশনের সামনে থাকে, তাহলে ইলেকশন কমিশন যেন এটা নিষ্পত্তি করে।
“এই অন্য কোনো ইস্যু বলতে আমরা বোঝাচ্ছি- এটি হলো প্রতীক সংক্রান্ত ইস্যু। আমরা আশা করি, ইলেকশন কমিশন নিবন্ধনের ইস্যুও নিষ্পত্তি করবেন, একইসাথে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের ব্যাপারটিও নিষ্পত্তি করবেন।”

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

এক যুগ পর নিবন্ধন ফিরে পাচ্ছে জামায়াত

আপডেট সময় : ০১:৩৪:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের যে রায় হাই কোর্ট দিয়েছিল, এক যুগ পরে সেটি বাতিল করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, এখন নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীকের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আপিলের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারকের বেঞ্চ রোববার (১ জুন ২০২৫) এ রায় দেয়।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই রায় এসেছে। ফলে, ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপির সঙ্গে সরকারে থাকা জামায়াতে ইসলামী এখন দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে।
রায়ের পর এক ফেইসবুক পোস্টে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান শুকরিয়া জানান। একইসাথে নির্বাচন কমিশন যেন দ্রুত নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়, সে জন্য আল্লাহর ‘সাহায্য’ চেয়েছেন তিনি।
এই মামলায় জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এহসান আব্দুল্লাহ সিদ্দিক ও মোহাম্মদ শিশির মনির। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে শুনানিতে ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম।
রায়ের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শিশির মনির বলেন, “দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময়ের আইনি লড়াইয়ের সফল অবসান হল। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী আজকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তার নিবন্ধন ফিরে পেল।”

এক নজরে জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামীর যাত্রা শুরু ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, উপমহাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে। তখন এটি ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াত রাজনীতিতে ফেরে।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং বিএনপিকে সমর্থন করে। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটিতে দাঁড়ায়, তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা মন্ত্রী হন।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল জামায়াত, তখন তারা দুটি আসন পায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর উদ্যোগ নেয়। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযমকে ট্রাইব্যুনাল টানা ৯০ বছরের বা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। আপিল নিষ্পত্তির আগেই তিনি কারাগারে মারা যান।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয় আওয়ামী লীগের সময়ে।
এক রিট মামলায় ২০১৩ সালে হাই কোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়, ফলে দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
আপিল করেও সে সময় জামায়াত পক্ষে রায় পায়নি। তবে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় বাতিল করায় এখন আবার দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে ফেরার সুযোগ তৈরি হল।

যেভাবে বাতিল হয়েছিল
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হয়।
৩৮টি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, এমন শর্ত জারি হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে হাই কোর্টে রিট করেন তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন।
তারা অভিযোগ তোলেন- জামায়াতের চারটি কারণে নিবন্ধন বাতিল করা উচিত:
প্রথমত, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে ক্ষমতার উৎস মনে করে না এবং জনপ্রতিনিধিদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে স্বীকার করে না।
দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না, অথচ জামায়াত কার্যত সাম্প্রদায়িক।
তৃতীয়ত, নিবন্ধিত দলের উচিত ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গে বৈষম্য না করা, কিন্তু জামায়াতের শীর্ষপদে নারী বা অমুসলিম স্থান পান না।
চতুর্থত, কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে শাখা থাকা যাবে না, অথচ জামায়াত নিজেই বলে যে তাদের জন্ম ভারতে, বিশ্বজুড়ে শাখা রয়েছে।
এই রিটের পর ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট রুল জারি করে জানতে চায়, জামায়াতের নিবন্ধন কেন আইনবহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১)(বি)(২) ও ৯০(সি) লঙ্ঘন- তা ব্যাখ্যা করতে।
এরপর নিবন্ধন রক্ষায় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জামায়াত। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার জায়গায় ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার উল্লেখ আনে।
শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের বেঞ্চ রায় দেন, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করা হয়।
এই রায়ের ওপর জামায়াতের স্থগিতাদেশ চাওয়ার আবেদনও ৫ অগাস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত খারিজ করে দেয়।
২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে শুধু সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে থাকবে। নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে ২০১৭ সালের ৮ মার্চ গেজেটে জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাতিল করে।
হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর জামায়াত আপিল করে। তবে প্রধান আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বেঞ্চ সেই আপিল খারিজ করে দেয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াত আবার আপিল পুনরুজ্জীবনের আবেদন করে, যা সর্বোচ্চ আদালত ২৪ অগাস্ট পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেয়।
শিশির মনিরের আবেদনের পর গত মে মাসে আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও আদালতের পর্যবেক্ষণ চাওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত রোববার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় বাতিলের সিদ্ধান্ত দেয়। বিষয়টি এখন নির্বাচন কমিশনে যাবে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।
হাই কোর্টের রায় থাকায় জামায়াত দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার অভিযোগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।

‘অংশগ্রহণমূলক সংসদ নিশ্চিত’
জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ের আইনি লড়াইয়ের সফল অবসান হলো। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী আজকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তার নিবন্ধন ফিরে পেল।
“পলিটিক্যালি মোটিভেটেড পিআইএল বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত মামলার মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আজকের এই রায়ের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক এবং অংশগ্রহণমূলক সংসদ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো।”
তিনি বলেন, “আমরা আশা করি, এই রায়ের পরে বাংলাদেশে সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত সংসদ গঠিত হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকলেই তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে বেছে নেবেন- এটা আমরা প্রত্যাশা করি।
“এবং আমরা এটাও প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশের আগামী সংসদে ইন্টারেস্টিং এবং কনস্ট্রাকটিভ বিতর্ক হবে, যার মাধ্যমে ডেমোক্রেসি একটি স্থায়ী রূপ লাভ করবে।”
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শিশির মনির বলেন, “আজকে মাননীয় আপিল বিভাগ- হাই কোর্টের যে রায় ছিল, এই রায়কে বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং ইলেকশন কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছেন- বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দ্রুত নিবন্ধন এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত অন্য যেসব ইস্যু আছে, সেগুলো নিষ্পত্তি করতে।
“এরই মাধ্যমে আজকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফিরে পেল এবং প্রতীকের ব্যাপারটিও ইলেকশন কমিশনের কাছে রেফার করা হলো- আদার ইস্যু হিসাবে। এইজন্য আমরা মামলার শর্ট অর্ডার চেয়েছি, আমরা আশা করি- আগামীকালকের মধ্যেই মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ আমরা হাতে পাব।
“এই সংক্ষিপ্ত আদেশ আমরা ইলেকশন কমিশনের কাছে অ্যাপ্রোচ করব, বাকিটা ইলেকশন কমিশন আইন অনুযায়ী অতি দ্রুত জামায়াতের নিবন্ধন এবং জামায়াতের প্রতীক বুঝিয়ে দেবেন- এইটা আমরা প্রত্যাশা করি।”
এক প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, “আজকের ডাইরেকশনে আপিল বিভাগ বলেছেন- জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন এবং অন্য কোনো ইস্যু যদি ইলেকশন কমিশনের সামনে থাকে, তাহলে ইলেকশন কমিশন যেন এটা নিষ্পত্তি করে।
“এই অন্য কোনো ইস্যু বলতে আমরা বোঝাচ্ছি- এটি হলো প্রতীক সংক্রান্ত ইস্যু। আমরা আশা করি, ইলেকশন কমিশন নিবন্ধনের ইস্যুও নিষ্পত্তি করবেন, একইসাথে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের ব্যাপারটিও নিষ্পত্তি করবেন।”