ঢাকা ১১:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে আরও ৩০ দেশের নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা খাঁচা থেকে বের হওয়া সিংহী আড়াই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী!

ইসরায়েলে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ, কিন্তু কেন?

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ১০:৫১:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫
  • / 269
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

অস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের ভেতরে এম দৃশ্য এক সপ্তাহ আগেও ছিল অকল্পনীয়। দেশটির হোলন শহরে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এমন ধ্বংসাত্মক দৃশ্য কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হোলন শহরে সেই দুর্বিষহ বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে।

ইরান পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করার আগপর্যন্ত ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী নিজেকে এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছিল, যার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্ভেদ্য মনে করা হতো।

কিন্তু প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূর থেকে পারস্য উপদ্বীপের দেশ ইরানের ধারাবাহিক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে প্রকাশ পেয়েছে, ইসরায়েলের সেই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আসলে ফাঁপা।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরও বড় বড় যুদ্ধে জড়িয়েছে। তবু এবারের মতো এমন ব্যাপকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ সে আগে কখনও দেখেনি। সাম্প্রতিক দশকের অন্যান্য বড় সংঘাতের তুলনায় ২০২৫ সালের এই ইরানি আক্রমণ নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন।

১৩ জুন শুরু হওয়া সংঘাতে যত সময় গড়াচ্ছে, ততই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানছে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে, বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি।

তেল আবিব, ইসরায়েলের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র, কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। স্কুল বন্ধ, অপ্রয়োজনীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থগিত, গণপরিবহন সীমিত, আর সেনাবাহিনী জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে।

প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের এই শহরের অনেকে আত্মীয়দের বাড়িতে চলে গেছেন। যাঁরা শহরে রয়েছেন, তাঁরা প্রতিরাতে বাঙ্কারে আশ্রয় নিচ্ছেন—কারণ বেশিরভাগ আক্রমণই হচ্ছে রাতের আঁধারে।

একজন নার্স, এল্লা কারেন, তাঁর দুই কন্যাসহ পার্কে রাত কাটানোর সময় ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, “এই অনিশ্চয়তা, কখন মাথার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র পড়বে—এই ভয়াবহ অবস্থায় বেঁচে থাকা একপ্রকার পাগলামি।”
তিনি আরও বলেন, “চরম ভয়ের মধ্যে থাকি। যদি আমি মারা যাই, তাহলে আমার মেয়েদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।”

একযোগে ছোড়া শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন তেল আবিব, হাইফা, আশকেলন, বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।

এর ফলে সোরোকা হাসপাতালসহ বেশ কিছু সামরিক ও বেসামরিক ভবন ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছেন ২০ জনেরও বেশি, আহত হয়েছেন ৮০০ জনের বেশি।

একযোগে এতো শহর আক্রান্ত হওয়া এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর এমন চাপ—এর আগে ইসরায়েল কখনও অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। অর্থনীতিতে ধস নেমেছে, পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে।

সামরিক বিশ্লেষকরাও একবাক্যে একে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিস্তৃত সামরিক ধাক্কা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

গাজাবাসীর মতোই চোখের জল
বছরের পর বছর ইসরায়েলি আক্রমণে গাজা কিংবা অন্যান্য ফিলিস্তিনি শহরের বাড়িঘর ধ্বংস হতে দেখে এসেছে বিশ্ব। সমালোচনায় কান দেয়নি তেল আবিব। এবার সেই একই পরিস্থিতি নিজের ঘাড়ে আসতেই ইসরায়েলি দিক থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসছে।

সরকার হোম ফ্রন্ট কমান্ডের নির্দেশনা মানতে জনগণকে অনুরোধ করছে। কিন্তু পেতাহ তিকভা শহরে এক আবাসিক ভবনের দুটি নিরাপদ কক্ষের মাঝখানে ক্ষেপণাস্ত্র পড়লে চারজন নিহত হন।

হাইফার একটি তেল শোধনাগারে হামলায় নিহত হন তিনজন। তেল আবিবের কাছে বনে ব্রাক শহরে এক বৃদ্ধের বাড়ি ধসে তিনি মারা যান।

তেল আবিবের স্টার্টআপকর্মী ডানা আভেসার ও তাঁর স্বামী পালিয়ে গেছেন দক্ষিণ ইসরায়েলের গ্রামে।
তিনি বলেন, “এই হামলা আবারও দেখিয়ে দিল, কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থাই শতভাগ নিরাপদ নয়।”

তিনি এখন পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে বিধ্বস্ত হওয়া তাঁর ভবনের খোঁজ নেননি।
“জানতে ভয় লাগে,” তিনি বলেন।
“আমি ঘুমাতে চাই না, কারণ আবার কিছু ঘটতে পারে। তবে, মনে হচ্ছে ইরানের সঙ্গে এই উত্তেজনা হয়তো বড় কোনো পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিতে পারে—দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার সম্ভাবনা।”

আরও বড় ক্ষতির আশঙ্কা
গাজা থেকে ছোড়া রকেট ঠেকাতে আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৯০% সফল—এমন দাবি করত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কিন্তু ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আরও আধুনিক ও শক্তিশালী। ভারী ওয়ারহেড যুক্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আবাসিক ভবনে সরাসরি আঘাত হানছে।

থিয়েটার শিক্ষক ও পিলাটিস প্রশিক্ষক ইদো তাল মোর বলেন, “প্রতিবারই মনে হয় আগের চেয়ে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি। সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে গেছে।”

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বুধবার জানায়, ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘অ্যারো’র ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ কমে এসেছে। এতে ইরানের বিপক্ষে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এদিকে, ইরানি হামলার মাত্রা বেড়েই চলেছে। প্রাথমিকভাবে রাতেই হামলা হলেও বৃহস্পতিবার থেকে দিনের বেলাতেও আঘাত হানছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

পূর্ববর্তী সংঘর্ষগুলোতে যা ঘটেছিল
২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ৩৪ দিনের যুদ্ধে কিছুটা ক্ষতি হলেও বড় শহরগুলো অক্ষত ছিল।
২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধেও কিছু রকেট হামলা হলেও ইসরায়েল বড় ক্ষতির মুখে পড়েনি।
২০২১ সালে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে ১২ জন ইসরায়েলি নিহত হয়, কিন্তু আয়রন ডোম সফলভাবে আক্রমণ ঠেকায়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হঠাৎ আক্রমণের পর গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েল।
এর মধ্যেই ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা, এবং এপ্রিল মাসে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে আঘাত হানে। এর পাল্টা জবাবেই ইরান ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে আক্রমণ করে।

এবারের বিপর্যয়ের পেছনে কারণ কী?
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েকটি কৌশলগত, প্রযুক্তিগত ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।

১. ইরান একযোগে ব্যালিস্টিক, ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন ও সাইবার হামলা চালায়—এতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চাপের মুখে পড়ে।

২. রাডার স্টেশন, প্রতিরক্ষা ইউনিট, বাসাবাড়ি, হাসপাতালসহ সব জায়গায় হামলা হয়—আইডিএফের কমান্ড ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়।

৩. সাইবার আক্রমণে জিপিএস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে—জনগণকে সরিয়ে নেওয়ায় বিলম্ব হয়।

৪. গোয়েন্দা বিভাগ ইরানের পরিকল্পনার ব্যাপ্তি সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেনি—প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল।

৫. আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাব ছিল—যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দ্রুত সমর্থন আসেনি। ফলে ইসরায়েলকে এককভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে।

ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া আরও ক্ষোভপূর্ণ
বৃহস্পতিবার সকালে ইসরায়েল ইরানের আরাক হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টরে হামলা চালায়। এর পাল্টায় ইরানও ডজনখানেক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানান, দক্ষিণ ইসরায়েলের সোরোকা হাসপাতালসহ বেসামরিক স্থাপনাতেও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।

ইসরায়েল এই হামলার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছে—যদিও গত অক্টোবরে গাজায় নিজেদের অভিযান চলাকালে একের পর এক হাসপাতালে হামলা করেছে তারাই।

প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “তেহরানের স্বৈরাচারীদের কাছ থেকে আমরা এর পূর্ণ মূল্য আদায় করব।”

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল ক্যাটজ বলেন, “ভীতু ইরানি শাসক নিরাপদ বাংকারে বসে ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকায় হামলা চালাচ্ছেন। এটাই যুদ্ধাপরাধের জঘন্যতম উদাহরণ। খামেনি এর দায় এড়াতে পারবেন না।”

তবে ইরান দাবি করেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি কোনো হাসপাতালে আঘাত করেনি। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানায়, বিস্ফোরণের তরঙ্গ গিয়ে হাসপাতালে আঘাত করেছে, ক্ষেপণাস্ত্র নয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ইসরায়েলে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ, কিন্তু কেন?

আপডেট সময় : ১০:৫১:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫

অস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের ভেতরে এম দৃশ্য এক সপ্তাহ আগেও ছিল অকল্পনীয়। দেশটির হোলন শহরে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে এমন ধ্বংসাত্মক দৃশ্য কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হোলন শহরে সেই দুর্বিষহ বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে।

ইরান পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করার আগপর্যন্ত ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী নিজেকে এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরেছিল, যার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্ভেদ্য মনে করা হতো।

কিন্তু প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূর থেকে পারস্য উপদ্বীপের দেশ ইরানের ধারাবাহিক ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে প্রকাশ পেয়েছে, ইসরায়েলের সেই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আসলে ফাঁপা।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরও বড় বড় যুদ্ধে জড়িয়েছে। তবু এবারের মতো এমন ব্যাপকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ সে আগে কখনও দেখেনি। সাম্প্রতিক দশকের অন্যান্য বড় সংঘাতের তুলনায় ২০২৫ সালের এই ইরানি আক্রমণ নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন।

১৩ জুন শুরু হওয়া সংঘাতে যত সময় গড়াচ্ছে, ততই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানছে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে, বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি।

তেল আবিব, ইসরায়েলের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র, কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। স্কুল বন্ধ, অপ্রয়োজনীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থগিত, গণপরিবহন সীমিত, আর সেনাবাহিনী জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে।

প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের এই শহরের অনেকে আত্মীয়দের বাড়িতে চলে গেছেন। যাঁরা শহরে রয়েছেন, তাঁরা প্রতিরাতে বাঙ্কারে আশ্রয় নিচ্ছেন—কারণ বেশিরভাগ আক্রমণই হচ্ছে রাতের আঁধারে।

একজন নার্স, এল্লা কারেন, তাঁর দুই কন্যাসহ পার্কে রাত কাটানোর সময় ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, “এই অনিশ্চয়তা, কখন মাথার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র পড়বে—এই ভয়াবহ অবস্থায় বেঁচে থাকা একপ্রকার পাগলামি।”
তিনি আরও বলেন, “চরম ভয়ের মধ্যে থাকি। যদি আমি মারা যাই, তাহলে আমার মেয়েদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।”

একযোগে ছোড়া শতাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন তেল আবিব, হাইফা, আশকেলন, বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।

এর ফলে সোরোকা হাসপাতালসহ বেশ কিছু সামরিক ও বেসামরিক ভবন ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছেন ২০ জনেরও বেশি, আহত হয়েছেন ৮০০ জনের বেশি।

একযোগে এতো শহর আক্রান্ত হওয়া এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর এমন চাপ—এর আগে ইসরায়েল কখনও অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। অর্থনীতিতে ধস নেমেছে, পুঁজিবাজারে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে।

সামরিক বিশ্লেষকরাও একবাক্যে একে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিস্তৃত সামরিক ধাক্কা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

গাজাবাসীর মতোই চোখের জল
বছরের পর বছর ইসরায়েলি আক্রমণে গাজা কিংবা অন্যান্য ফিলিস্তিনি শহরের বাড়িঘর ধ্বংস হতে দেখে এসেছে বিশ্ব। সমালোচনায় কান দেয়নি তেল আবিব। এবার সেই একই পরিস্থিতি নিজের ঘাড়ে আসতেই ইসরায়েলি দিক থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসছে।

সরকার হোম ফ্রন্ট কমান্ডের নির্দেশনা মানতে জনগণকে অনুরোধ করছে। কিন্তু পেতাহ তিকভা শহরে এক আবাসিক ভবনের দুটি নিরাপদ কক্ষের মাঝখানে ক্ষেপণাস্ত্র পড়লে চারজন নিহত হন।

হাইফার একটি তেল শোধনাগারে হামলায় নিহত হন তিনজন। তেল আবিবের কাছে বনে ব্রাক শহরে এক বৃদ্ধের বাড়ি ধসে তিনি মারা যান।

তেল আবিবের স্টার্টআপকর্মী ডানা আভেসার ও তাঁর স্বামী পালিয়ে গেছেন দক্ষিণ ইসরায়েলের গ্রামে।
তিনি বলেন, “এই হামলা আবারও দেখিয়ে দিল, কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থাই শতভাগ নিরাপদ নয়।”

তিনি এখন পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে বিধ্বস্ত হওয়া তাঁর ভবনের খোঁজ নেননি।
“জানতে ভয় লাগে,” তিনি বলেন।
“আমি ঘুমাতে চাই না, কারণ আবার কিছু ঘটতে পারে। তবে, মনে হচ্ছে ইরানের সঙ্গে এই উত্তেজনা হয়তো বড় কোনো পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিতে পারে—দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার সম্ভাবনা।”

আরও বড় ক্ষতির আশঙ্কা
গাজা থেকে ছোড়া রকেট ঠেকাতে আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৯০% সফল—এমন দাবি করত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কিন্তু ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আরও আধুনিক ও শক্তিশালী। ভারী ওয়ারহেড যুক্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আবাসিক ভবনে সরাসরি আঘাত হানছে।

থিয়েটার শিক্ষক ও পিলাটিস প্রশিক্ষক ইদো তাল মোর বলেন, “প্রতিবারই মনে হয় আগের চেয়ে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি। সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে গেছে।”

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বুধবার জানায়, ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘অ্যারো’র ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ কমে এসেছে। এতে ইরানের বিপক্ষে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এদিকে, ইরানি হামলার মাত্রা বেড়েই চলেছে। প্রাথমিকভাবে রাতেই হামলা হলেও বৃহস্পতিবার থেকে দিনের বেলাতেও আঘাত হানছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

পূর্ববর্তী সংঘর্ষগুলোতে যা ঘটেছিল
২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ৩৪ দিনের যুদ্ধে কিছুটা ক্ষতি হলেও বড় শহরগুলো অক্ষত ছিল।
২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধেও কিছু রকেট হামলা হলেও ইসরায়েল বড় ক্ষতির মুখে পড়েনি।
২০২১ সালে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে ১২ জন ইসরায়েলি নিহত হয়, কিন্তু আয়রন ডোম সফলভাবে আক্রমণ ঠেকায়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হঠাৎ আক্রমণের পর গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েল।
এর মধ্যেই ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা, এবং এপ্রিল মাসে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে আঘাত হানে। এর পাল্টা জবাবেই ইরান ৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে আক্রমণ করে।

এবারের বিপর্যয়ের পেছনে কারণ কী?
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েকটি কৌশলগত, প্রযুক্তিগত ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।

১. ইরান একযোগে ব্যালিস্টিক, ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন ও সাইবার হামলা চালায়—এতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চাপের মুখে পড়ে।

২. রাডার স্টেশন, প্রতিরক্ষা ইউনিট, বাসাবাড়ি, হাসপাতালসহ সব জায়গায় হামলা হয়—আইডিএফের কমান্ড ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়।

৩. সাইবার আক্রমণে জিপিএস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে—জনগণকে সরিয়ে নেওয়ায় বিলম্ব হয়।

৪. গোয়েন্দা বিভাগ ইরানের পরিকল্পনার ব্যাপ্তি সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেনি—প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল।

৫. আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাব ছিল—যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দ্রুত সমর্থন আসেনি। ফলে ইসরায়েলকে এককভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে।

ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া আরও ক্ষোভপূর্ণ
বৃহস্পতিবার সকালে ইসরায়েল ইরানের আরাক হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টরে হামলা চালায়। এর পাল্টায় ইরানও ডজনখানেক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানান, দক্ষিণ ইসরায়েলের সোরোকা হাসপাতালসহ বেসামরিক স্থাপনাতেও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।

ইসরায়েল এই হামলার জন্য ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছে—যদিও গত অক্টোবরে গাজায় নিজেদের অভিযান চলাকালে একের পর এক হাসপাতালে হামলা করেছে তারাই।

প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “তেহরানের স্বৈরাচারীদের কাছ থেকে আমরা এর পূর্ণ মূল্য আদায় করব।”

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল ক্যাটজ বলেন, “ভীতু ইরানি শাসক নিরাপদ বাংকারে বসে ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকায় হামলা চালাচ্ছেন। এটাই যুদ্ধাপরাধের জঘন্যতম উদাহরণ। খামেনি এর দায় এড়াতে পারবেন না।”

তবে ইরান দাবি করেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি কোনো হাসপাতালে আঘাত করেনি। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানায়, বিস্ফোরণের তরঙ্গ গিয়ে হাসপাতালে আঘাত করেছে, ক্ষেপণাস্ত্র নয়।