ইরানের হামলার মুখে ইসরায়েলি আরবরা কেমন আছেন?
- আপডেট সময় : ১১:৫৩:২৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫
- / 197

“আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল,” বলছিলেন ৬৭ বছর বয়সী কাসেম আবু আল-হিজা। ইরানের ছোঁড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র গত শনিবার উত্তর ইসরায়েলে তামরা শহরে তার বাড়িতে আঘাত হেনেছিল। সিমেন্টের ছাদটা ভেঙ্গে পড়েছিল ঘরের ভেতরেই। ওই এক হামলাতেই তার পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বাড়ির ভেতর থেকে বই, জামাকাপড়, বাচ্চাদের খেলনা, আর দেহের টুকরো অংশগুলো উড়ে এসে রাস্তায় পড়েছিল।
ক্ষেপণাস্ত্রটা যখন আঘাত হেনেছিল, পুরো রাস্তাটাই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। রক্তের দাগ ধরে উদ্ধার-কর্মীরা কোনো মতে দেহগুলি খুঁজে বের করেছিলেন।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন মি. কাসেমের মেয়ে, ৪৫ বছর বয়সী মানার খাতিব, দুই নাতনি – ২০ বছরের শাদা আর ১৩ বছরের হালা আর ওদের ৪১ বছর বয়সী খালা মানাল খাতিব।
ওরা সবাই একই সঙ্গে বাড়ির ভেতরেই কংক্রিটের ঢালাই করা একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যালিস্টিক মিসাইলটা সরাসরি এসে পড়েছিল ওই ঘরেই।
মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরেই গান গেয়ে উল্লাসের ভিডিও
উত্তর ইসরায়েলের যে তামরা শহরে তারা থাকতেন, সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই আরব। ওই চারজনের মৃত্যুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনলাইনে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যাচ্ছিল যে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রটা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে আসছে।
তামরা শহরের ওপরে যখন মিসাইলটা পড়ল, তখনই ভিডিওতে একটা গলা শোনা গেল, হিব্রুতে কেউ চিৎকার করে বলছে, “গ্রামে পড়েছে, গ্রামে পড়েছে।” এরপরে বেশ কয়েকজনকে একসঙ্গে হাততালি দিয়ে গান গাইতে শোনা যাচ্ছিল, তারা বলছিল, “তোমাদের গ্রামটা পুড়ে যাক” বলে। আমার পরিবারে যা ঘটল, সেটা নিয়ে ওরা গান গাইছিল,” ধরা গলায় বলছিলেন মি. কাসেম। তাকে তখন ঘিরে রেখেছিলেন আত্মীয় পরিজন।
ওই ভিডিওতে যে গানটা শোনা যাচ্ছিল, সেই ‘আরব-বিরোধী’ স্লোগানটা মাঝে মাঝেই উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদীরা গেয়ে থাকে। ওই ভিডিওটা ইসরায়েলে ভাইরাল হয়ে গেছে, তবে দেশের ভেতরেই ভিডিওটার প্রবল নিন্দাও হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ মন্তব্য করেছেন, “ভয়াবহ এবং লজ্জাজনক।”
ইসরায়েলি আরবদের নেই সরকারি বাঙ্কার
ওই ঘটনায় মি. কাসেম এবং তামরার বৃহত্তর আরব সমাজের ক্রুদ্ধ হওয়ার পিছনে আরও কারণ আছে। শুধু ওই এলাকায় নয়, ইসরায়েলের অন্যান্য আরব-প্রধান এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ৩৮ হাজার মানুষের জন্য কোনও সরকারি বাঙ্কার নেই।
কাছাকাছি ইহুদী-প্রধান শহর কারমিয়েলের জনসংখ্যা ৫৫ হাজার, কিন্তু সেখানে ১২৬টি সরকারি বাঙ্কার আছে।
দুই এলাকার ফারাকটা চোখে পড়ার মতো। তামরার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরেই এই বৈষম্য নিয়ে সতর্ক করে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে, দেশের তৃতীয় বড় শহর হাইফা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত তামরা শহর। আবার লেবাননের সীমান্ত থেকে শহরটির দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। তাই ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর ছোঁড়া রকেট এই শহরে আঘাত হানতেই পারে।
হেজবুল্লাহর ছোঁড়া একটি রকেটের আঘাতে গত বছর অক্টোবর মাসে এক নারী গুরুতর চোট পেয়েছিলেন।
পুরো ইসরায়েলেই জনসংখ্যার সিকি ভাগ উপযুক্ত বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পান না। তবে অ-ইহুদী এলাকায় সংখ্যাটা বেড়ে হয়ে যায় বাসিন্দাদের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। এই তথ্য ২০১৮ সালে দিয়েছিল ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় প্রধান হিসাবরক্ষকের দফতর।
“অনেক দশক ধরে আরব প্রধান এলাকার স্থানীয় কর্মকর্তারা নানা খাতেই কম সরকারি অনুদান পান। এই সব খাতের মধ্যে রয়েছে বোমা বা রকেট হামলার মতো জরুরী প্রয়োজনের জন্য প্রস্তুতির খাত,” বলছিলেন থিংক ট্যাঙ্ক ইসরায়েল ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউটের লিতাল পিলার।
আবার যেসব জায়গায় বাঙ্কার আছে, “সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও খুব খারাপ, দীর্ঘদিন থাকার উপযুক্ত নয়,” বলছিলেন মিজ পিলার।
বিবিসি বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য জানতে চেয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক
ইসরায়েলের বাসিন্দা আরবদের অনেকেই নিজেদের ফিলিস্তিনি নাগরিক বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ইসরায়েলের জনসংখ্যার পাঁচভাগের এক ভাগই আরব। আইন অনুযায়ী ইহুদী নাগরিকদের মতো সমান অধিকার পাওয়ার কথা তাদের।
কিন্তু তারা নিয়মিতই অভিযোগ তুলে থাকেন যে, সরকারি ভাবেই তারা বৈষম্যের শিকার হন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মতো ব্যবহার করা হয় তাদের সঙ্গে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকেই তেল আভিভ আর হাইফায় যখন ইরাকি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করতে থাকে, সেই সময়েই ইসরায়েলি সরকার নির্দেশ দিয়েছিল, যত নতুন ভবন তৈরি হবে, সেগুলোতে ‘মামাদ’ বা মোটা কংক্রিটের ঢালাই করা নিরাপদ ঘর থাকতে হবে।
সমাজকর্মীরা বলছেন, আরব সমাজকে এমনিতেই নতুন বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করতে গিয়ে এত কড়া নিয়মকানুনের মোকাবিলা করতে হয় যে অনেক ক্ষেত্রেই তারা অনিয়ম করেই বাড়ি বানান, যেখানে বাঙ্কার রাখা হয় না।
স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তামরার ৪০ শতাংশ বাড়িতে নিজস্ব বাঙ্কার আছে, বাকি সিংহভাগ মানুষকে আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রতিবেশীদের বাড়িতে দৌড়তে হয়। অনেক সময়ই রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার যথেষ্ট আগে সতর্কবার্তা আসে না। তাই আশ্রয় নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে বলে জানাচ্ছেন সমাজকর্মীরা।
অ্যারাব-জিউইশ সেন্টার ফর এম্পাওয়ারমেন্ট, ইকুয়ালিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন বা আজীস-এর ইলান আমিত বলছেন, “ফারাকটা বিরাট”। ওই সংগঠনটি আরবদের আশ্রয়স্থল গড়ে দেওয়ার কাজ করে।
“আমি জেরুজালেমে থাকি। প্রত্যেকটা বাড়িতে বাঙ্কার আছে। প্রতিটা পাড়ায় একটা করে সরকারি বাঙ্কার রয়েছে,” বলছিলেন মি. আমিত।
আরব বেদুইন আর গরীব ইহুদিদেরও বাঙ্কার নেই
তামরায় তখন অন্ধকার নামছে। সব বাসিন্দাদের ফোনে একই সঙ্গে সতর্কবার্তা এল : “আপনাকে নিশ্চিতভাবে কোনো নিরাপদ জায়গার কাছাকাছি থাকতে হবে।”
একটু পরেই সাইরেন বেজে উঠল। বাসিন্দাদের মনে গত শনিবারের ঘটনাটা তখনও তাজা রয়েছে। মানুষজন আতঙ্কে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন – মায়েরা বাচ্চাদের এক জায়গায় করে ফেললেন, রাস্তায় হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কয়েকটা পরিবার গাদাগাদি করে একটিই বাঙ্কারে আশ্রয় নিলেন। কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, অন্য অনেকের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
এক ব্যক্তি চোখ বুজে প্রার্থনা করছেন। ওপরে শুরু হল ‘বুম’, ‘বুম’ আওয়াজ।
বাঙ্কারের সমস্যাটা ইসরায়েলের আরব বেদুইন সমাজের ক্ষেত্রে আরও প্রকট। এদের অনেকেই নেগেভ মরুভূমির কাছাকাছি গ্রামগুলোতে থাকেন। ওইসব গ্রামের আবার ইসরায়েল সরকারের স্বীকৃতি নেই, তাই সেখানে সরকারি বাঙ্কার তৈরিও করা হয় না।
গত বছর এপ্রিল মাসে যখন ইসরায়েল আর ইরানের মধ্যে সংঘাত বেড়ে গিয়েছিল, সেই সময়ে একমাত্র যিনি গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন, সেই অল্প বয়সী নারী এরকমই এক বেদুইন সমাজের সদস্য ছিলেন। ইরানের ছোঁড়া মিসাইলের কিছু টুকরো তার মাথায় উড়ে এসে লেগেছিল। প্রায় বছর খানেক তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
আবার তেল আভিভের দক্ষিণের যেসব এলাকায় তুলনামূলক ভাবে গরীব ইহুদীরা থাকেন, সেখানেও বাঙ্কারের অভাব একটা বড় সমস্যা।
ইসরায়েলি আরবরা উভয় সঙ্কটে
হিব্রু ইউনিভার্সিটির এক নতুন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ইহুদী ইসরায়েলিদের ৮২.৭ শতাংশ মানুষই ইরানের ওপরে আক্রমণ সমর্থন করেন। কিন্তু আরব ইসরায়েলিদের মধ্যে ৬৭.৯ শতাংশ এর বিরুদ্ধে। ওই সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে যে আরব ইসরায়েলিদের ৬৯.২ শতাংশ মানুষ হামলার ভয়ে ভীত, আর ২৫.১ শতাংশ মানুষ হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
ইলান আমিত বলছিলেন, “আরব সমাজ মনে করে, তাদের অবহেলার শিকার হয়ে পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষা আর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেমন বিরাট ফারাক আছে, তেমনই রয়েছে বাঙ্কারের ক্ষেত্রেও।”
তামরার পৌর প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা আদেল খাতিবের কথায়, “এই ঘটনাটা যেদিন ঘটল, সেই শনিবার থেকেই কী পরিমাণ ক্রোধ মানুষের মধ্যে জমা হয়েছে, সেটা আপনি টের পাবেন।
“আমরা একেবারে সাধারণ সুযোগ সুবিধাও পাই না। বেশির ভাগ আরব এলাকাতেই কমিউনিটি সেন্টার নেই বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আলাদা ভবন নেই,” জানাচ্ছিলেন মি. খাতিব।
ইসরায়েল সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে আরব সমাজের ৪২.৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে ছিলেন।
সম্প্রতি দুই সমাজের মধ্যে ফারাকটা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা হয়েছে। ইসরায়েলের বিগত সরকার ২০২১ সালে আরব সমাজের জন্য একটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এনেছিল।
ইলান আমিত বলছিলেন, “বড় আকারের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মতো ক্ষেত্রগুলোতে যাতে ফারাকটা কমিয়ে আনা যায়, সেই কাজই চলছে এখন।”
বর্তমান ক্ষমতাসীন দক্ষিণ-পন্থী জোট দেশটির ইতিহাসে সবথেকে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তারা ওই পরিকল্পনায় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সেই অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই বরাদ্দ ছাঁটাই একবার হয়েছে গাজার যুদ্ধের জন্য সরকার যে বাজেটে অদল বদল ঘটায়, সেই সময়ে।
ইলান আমিত বলছেন, “সহজ ভাষায় বলতে গেলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চাকা আটকিয়ে দিয়েছে বর্তমান সরকার। বৃহত্তর উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও বাস্তবায়িত হতে দিচ্ছে না তারা।”
“গত বছর দেড়েকে আরব সমাজ এক উভয় সঙ্কটে পড়েছে। একদিকে তারা নিজেরা বর্তমান সরকারের নীতির কারণে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে এই যুদ্ধের ফলে গাজায় আর পশ্চিম তীরে তাদের সমাজেরই মানুষদের সঙ্কটও তাদের দেখতে হচ্ছে,” বলছিলেন মি. আমিত।
‘বোমা তো আর ইহুদী বা আরব দেখে ফাটে না’
কাসেম আবু আল-হিজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে তারই প্রতিবেশী, ১৬ বছর বয়সী মুহাম্মদ ওসমান বলছিলেন, “সবাই ক্রুদ্ধ আর ক্ষুব্ধ হয়ে আছে।”
শাদার কথা বলতে গিয়ে ওসমান বলছিলেন, “সবসময়েই পড়াশোনা নিয়ে থাকত। সবথেকে ভাল হয়ে উঠতে চাইত ও। তার বাবা একজন আইনজীবী, সেও বাবার মতোই হতে চাইত। তার সব স্বপ্ন এক লহমায় মুছে গেল।”
“ছবির মতো একটা সুখী পরিবার ছিল। যখনই মনে পড়ছে ওদের কথা, তখনই আবার চোখে ভেসে উঠছে ওই সুন্দর ছবিটার টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া,” বলছিলেন ওসমান।
জানাজা বেরনোর আগে সমাজের সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে চা কফি খেতে খেতেই একে অপরের হাত ধরে নীরবে শোক পালন করছিলেন।
কাসেম আবু আল-হিজা বলছিলেন, “বোমা তো আর ইহুদী বা আরব দেখে ফাটে না। এই যুদ্ধটা শেষ করা দরকার আমাদের, এখনই।”
সৌজন্যে : বিবিসি নিউজ























