ইসরায়েল-ইরান হামলা : সামরিক শক্তি কার কতটুকু
- আপডেট সময় : ১১:২১:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫
- / 307

গত শুক্রবার (১৩ জুন ২০২৫) ভোররাতে ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ধারাবাহিকভাবে হামলা চালায়। এর আগের দিন, বৃহস্পতিবার, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে অবস্থিত তাদের দূতাবাসকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছিল।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ওই হামলায় তাদের ২০০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান ইরানের শতাধিক স্থাপনায় আঘাত হানে। তাদের দাবি, এতে ইরানের তিনজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে নিহতদের নাম প্রকাশ করে জানায়, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মোহাম্মদ বাগেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) প্রধান হোসাইন সালামি এবং খাতাম আল-আম্বিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলি রাশিদ।
২০২৪ সালে ইসরায়েল ও ইরান একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ২ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলের বড় শহরগুলোতে অন্তত ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। আইআরজিসি জানায়, গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যু এবং আইআরজিসি, হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা এ হামলা চালায়।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ২৫ অক্টোবর ইরানের অভ্যন্তরে প্রায় ২০টি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি, ইরান ও তার মিত্রদের আক্রমণের জবাবে তারা এই ব্যবস্থা নেয়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বশেষ এই হামলা অঞ্চলে উত্তেজনার একটি বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “ইসরায়েলের জন্য কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে।”
বহুদিন ধরেই এই দুই শত্রু রাষ্ট্র একে অপরের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে লড়াই চালিয়ে এলেও, বর্তমানে তারা সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সামরিক শক্তি, হামলার সক্ষমতা ও প্রতিরক্ষা কৌশল বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে উঠেছে।
সৈন্যসংখ্যা
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)-এর দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুযায়ী:
-
ইরান: সক্রিয় সামরিক সদস্য ৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে ৩ লাখ ৫০ হাজার, আইআরজিসিতে ১ লাখ ৯০ হাজার, নৌবাহিনীতে ১৮ হাজার, বিমানবাহিনীতে ৩৭ হাজার এবং বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগে ১৫ হাজার। রিজার্ভ বাহিনীর সদস্য ৩ লাখ ৫০ হাজার। এখানে ১৮ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক হলেও কিছু ছাড় রয়েছে।
-
ইসরায়েল: সক্রিয় সেনাসদস্য ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌবাহিনীতে ৯ হাজার ৫০০ এবং বিমানবাহিনীতে ৩৪ হাজার। রিজার্ভ বাহিনী আরও বড়—৪ লাখ ৬৫ হাজার সদস্য। এখানে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে অধিকাংশ পুরুষ ও নারীর জন্য সেনাসেবা বাধ্যতামূলক।
সামরিক ব্যয়
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী:
-
ইরান: ২০২৩ সালে সামরিক ব্যয় ছিল ১০.৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ০.৬ শতাংশ বেশি।
-
ইসরায়েল: একই বছরে ব্যয় করেছে ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। এর একটি বড় অংশ গেছে ৭ অক্টোবরের পর গাজায় চলমান যুদ্ধে।
স্থলবাহিনী
দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুযায়ী:
-
ইরান: ট্যাংক ১০,৫১৩টি, কামান ৬,৭৯৮টি, সাঁজোয়া যান ৬৪০টির বেশি। সেনাবাহিনীর কাছে রয়েছে ৫০টি হেলিকপ্টার, আইআরজিসির কাছে ৫টি।
-
ইসরায়েল: ট্যাংক প্রায় ৪০০, কামান ৫৩০টি, সাঁজোয়া যান ১,১৯০টির বেশি।
বিমানবাহিনী
-
ইরান: বিমানবাহিনীর কাছে রয়েছে ৩১২টি যুদ্ধবিমান; আইআরজিসির অধীনে আরও ২৩টি। এছাড়া বিমানবাহিনীর কাছে রয়েছে ২টি ফাইটার হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর কাছে ৫০টি, আইআরজিসির কাছে ৫টি।
-
ইসরায়েল: ৩৪৫টি যুদ্ধ-উপযোগী বিমান এবং ৪৩টি ফাইটার হেলিকপ্টার।
নৌবাহিনী
-
ইরান: ১৭টি সাবমেরিন, ৬৮টি টহল ও উপকূলীয় যুদ্ধজাহাজ, ৭টি করভেট, ১২টি ল্যান্ডিং শিপ, ১১টি ল্যান্ডিং ক্র্যাফট এবং ১৮টি লজিস্টিক সহায়ক সরঞ্জাম।
-
ইসরায়েল: ৫টি সাবমেরিন এবং ৪৯টি টহল ও উপকূলীয় জাহাজ।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
-
ইসরায়েল: মূলত ‘আয়রন ডোম’ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। এতে রয়েছে রাডার, নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ও ইন্টারসেপ্টর মিসাইল লঞ্চার। ২০টি লঞ্চার প্রতিটি ইউনিটে থাকে, যা হুমকির মুখে থাকা বস্তু ধ্বংস করে। ইসরায়েলে ১০টি আয়রন ডোম ইউনিট মোতায়েন রয়েছে।
আরও আছে ‘ডেভিড’স স্লিং’ (৪০–৩০০ কিমি পাল্লা) ও ‘অ্যারো সিস্টেম’ (২,৪০০ কিমি পর্যন্ত)।
-
ইরান: ২০২৪ সালে মোতায়েন করেছে “আজারাখশ” নামের স্বল্প পাল্লার, নিচু উচ্চতায় কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ইনফ্রারেড, রাডার ও ইলেকট্রো-অপটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
এছাড়া রয়েছে:
-
৪২টির বেশি রুশ নির্মিত দূরপাল্লার S-200, S-300 ও স্থানীয় Bavar-373
-
৫৯টি মাঝারি পাল্লার (MIM-23 Hawk, HQ-2J, Khordad-15)
-
২৭৯টি স্বল্প পাল্লার (CH-SA-4, 9K331 Tor-M1)
-
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র
-
ইরান: সিএসআইএস-এর তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১২ ধরনের স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে:
-
টোন্দর-৬৯ (পাল্লা ১৫০ কিমি)
-
খোররামশাহর, সেজ্জিল (পাল্লা ২,০০০ কিমি পর্যন্ত)
-
-
ইসরায়েল: অন্তত চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে:
-
লোরা (পাল্লা ২৮০ কিমি)
-
জেরিকো-৩ (পাল্লা ৪,৮০০ থেকে ৬,৫০০ কিমি পর্যন্ত)
-
পারমাণবিক সক্ষমতা
-
ইসরায়েল: আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী, আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক অস্ত্র মজুদে রয়েছে।
-
ইরান: এখনো পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্বের প্রমাণ নেই, তবে কর্মসূচি অত্যন্ত অগ্রসর। ২০০০-এর দশকে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি পারমাণবিক অস্ত্রকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা করে ফতোয়া দেন।
তবে ২০২৪ সালের মে মাসে ইরান জানায়, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে।























