ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ রূপ নিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে? কী প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশে?
- আপডেট সময় : ১২:০০:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
- / 296

বিশ্বের অন্যতম ভূরাজনৈতিক উত্তপ্ত অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য আবারও অস্থিরতায় কাঁপছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক ও উত্তেজনা। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এটি হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস। এই সংঘাত সামরিকভাবে বাংলাদেশে সরাসরি প্রভাব না ফেললেও এর অর্থনৈতিক অভিঘাত হবে গভীর, বিস্তৃত ও বহুস্তরীয়।
যদি সংঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয় এবং হরমুজ প্রণালীতে জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় বা ইরানের জ্বালানি অবকাঠামো আক্রান্ত হয়, তবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের ওপরও পড়বে সরাসরি ও বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষক ও শিল্পপতিরা। প্রতিবেদন করেছেন গোলাম মওলা।
জ্বালানি নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি
মধ্যপ্রাচ্য হলো বৈশ্বিক অপরিশোধিত তেল সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র। যুদ্ধের ফলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ করেই বিপুলভাবে বেড়ে যেতে পারে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ইতোমধ্যে ১২০ ডলারে পৌঁছেছে, যা খুব দ্রুতই ১৩০ ডলার ছুঁয়ে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর ৬০ থেকে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দামের এই ঊর্ধ্বগতি সরাসরি আমদানি ব্যয় বাড়াবে। এর প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন ও শিল্প খাতে। সরকারকে দিতে হতে পারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি, যা বাড়াবে বাজেট ঘাটতি। ফলাফল হিসেবে দেখা দিতে পারে মুদ্রাস্ফীতি ও রাজস্ব সংকট।
জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতিতে সরাসরি আঘাত
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জ্বালানি পরিবাহিত হয়। সাময়িক সময়ের জন্য এটি বন্ধ হলেও তেল ও এলএনজির দাম হঠাৎ বেড়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি জ্বালানিনির্ভর দেশ। আমদানি করা পরিশোধিত তেল ও এলএনজির ওপর আমাদের নির্ভরতা বেশি। তেলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে, যার প্রভাব শিল্প, কৃষি ও পরিবহনসহ সর্বত্র পড়বে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়ে জনজীবন কঠিন হয়ে উঠবে।’
‘জ্বালানি আমদানির ব্যয় বাড়লে রিজার্ভে চাপ তৈরি হবে। টাকার মান কমে গিয়ে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি ত্বরান্বিত হবে,’ বলেন তিনি।
তার মতে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ থাকলে আমদানি-রফতানি বিলম্বিত হবে ও খরচ বাড়বে। বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে অর্ডার বাতিলের ঝুঁকি বাড়বে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিকও অনিশ্চয়তায় পড়তে পারেন, রেমিট্যান্স হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হবে।
সরকারকে এখনই বিকল্প জ্বালানি উৎস, এলএনজি চুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মত দেন তিনি।
রফতানি ও সরবরাহ চেইনে চাপ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধ দীর্ঘ হলে ইউরোপ-আমেরিকায় ভোক্তা চাহিদা কমবে, যা তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
তিনি জ্বালানির দাম ও শিপিং ব্যয়ের বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিজিএমইএর নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘জ্বালানির দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ বেড়ে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা হ্রাস পাবে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ছোট ও মাঝারি রফতানিকারকরা।’
তিনি সরকারের প্রতি কৌশলগত জ্বালানি পরিকল্পনা ও খাতভিত্তিক প্রণোদনার আহ্বান জানান।
জাহাজ চলাচল ও বৈশ্বিক অস্থিরতা
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে জাহাজগুলোকে কেপ অব গুড হোপ ঘুরে যেতে হবে, এতে ১৫ দিন বেশি সময় ও ৩০-৪০ শতাংশ বাড়তি খরচ হবে।’
তিনি বলেন, ‘তেলের দাম যদি ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে যায়, তাহলে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে, যার ফলে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং বাজারে চাহিদা হ্রাস পেতে পারে।’
শিপিং ও সরবরাহ ব্যয়ে বড় ধাক্কা
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১২ শতাংশ বাণিজ্য পণ্য সুয়েজ খাল ও রেড সি রুটে পরিবাহিত হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এসব রুট অনিরাপদ হলে জাহাজগুলোকে কেপ অব গুড হোপ ঘুরে আসতে হবে, যা সময় ও খরচ দুই-ই বাড়াবে।
ফলে বাংলাদেশের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্য, সার ও যন্ত্রাংশ আমদানির খরচ বাড়বে এবং রফতানিতে সময়ক্ষেপণ ও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে সম্ভাব্য ধাক্কা
মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির কর্মসংস্থান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে হুমকির মুখে পড়তে পারে। অনেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশে ফিরে আসতে পারেন, যার ফলে রেমিট্যান্স আয় হঠাৎ কমে যেতে পারে। এর প্রভাব পড়বে রিজার্ভ ও টাকার মানের ওপর।
মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়
তেল ও শিপিং ব্যয় বৃদ্ধির ফলে খাদ্য, শিল্প কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে, যা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আরও বাড়তে পারে।
বিনিয়োগ ও উৎপাদনে অনিশ্চয়তা
আন্তর্জাতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ স্থগিত হতে পারে। দেশীয় উদ্যোক্তারাও উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে সংকোচনের পথে যেতে পারেন। কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতা তৈরি হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে ও কর্মসংস্থান ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এখনই প্রস্তুতির সময়
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধুই রাজনৈতিক সংঘাত নয়, বরং এটি অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য জ্বালানি ও রফতানিনির্ভর দেশের জন্য ভয়াবহ সংকটের পূর্বাভাস বহন করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনই সরকারের কৌশলগত প্রস্তুতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, যাতে ভবিষ্যৎ ধাক্কা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়।

















