নরসিংদীর ভূমিকম্প মনে করিয়ে দিয়েছে, দেশের মধ্যাঞ্চল স্থির নয়: ভূতাত্ত্বিক সমিতি
- আপডেট সময় : ০২:৫৭:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫
- / 118
দেশে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি। সংগঠনটি বলছে, শুক্রবার নরসিংদীতে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্প মনে করিয়ে দিয়েছে, দেশের মধ্যাঞ্চল মোটেই স্থির নয়। ভূমিকম্পের যেহেতু কোনও আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া যায় না, তাই প্রস্তুতি না থাকলে ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায় বলেও উল্লেখ করেছে তারা।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম এবং সাধারণ সম্পাদক ড. আনোয়ার জাহিদ সই করা বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়-
“শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে বাংলাদেশের নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটারের গভীরে একটি ভূকম্পন ঘটেছে। ভূমিকম্পটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৫ হতে ৫ দশমিক ৭; যা ছিল মাঝারি মাত্রার।
ভূমিকম্পটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ভূকম্পনের গভীরতা তুলনামূলক স্বল্প হওয়ায় ভূমিতে সঞ্চারিত কম্পন শক্তিশালীভাবে অনুভূত হয়েছে। এখন পর্যন্ত সংবাদপত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে ১০ জন মানুষের মৃত্যু খবর পাওয়া গেছে, এছাড়া বাসাবাড়ীতে ও মাটিতে ফাটল এবং অনেক জানমালের ক্ষতির হয়েছে।
ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, উক্ত অঞ্চলটি এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেটি ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের অংশভুক্ত। এটি শীতলক্ষ্যা নদীর ফল্ট লাইন বরাবর সংঘটিত হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, দেশে আগামীতেও এ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে লুকানো ফল্টগুলোর দ্রুত ম্যাপিং করে জাতীয় ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্রে গুরুত্ব সহকারে যুক্ত করা প্রয়োজন। ঢাকা ও আশেপাশের এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এ ধরনের ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভূতত্ত্ববিদদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বিস্তারিত মাইক্রোজোনেশন জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদদের মতে বাংলাদেশের জিওগ্রাফিক-জিওলজিক্যাল-টেটনিক অবস্থান খুবই জটিল। তবে, বাংলাদেশ স্পটভাবে সাবডাকশন সম্পর্কিত প্লেট বাউন্ডারিতে অবস্থিত। ইন্ডিয়ান প্লেটটি বার্মিজ প্লেটের নিচে যাওয়া শুরু করছে কয়েক লক্ষ বছর আগে, এর ফলেই চট্টগ্রাম, সিলেটের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে। প্লেট দুটোর চাপ এখনও চলমান রয়েছে। তবে এর গতি-প্রকৃতি বুঝার জন্য আরও সমীক্ষা ও গবেষণা প্রয়োজন।
ভূমিকম্পের যেহেতু কোনও আগাম সতর্কবার্তা দেয়া যাচ্ছে না, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, তাই প্রস্তুতি না থাকলে ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ভূমিকম্প বিষয়ে জ্ঞানের চর্চা, পরিকল্পনা আর একটু সচেতনতা আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে। যদি স্কুল, অফিস বা পরিবারে নিয়মিত মহড়া করা যায়, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারবে এ পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের পাশেই অবস্থান করছে, তাই মাঝেমধ্যে কাঁপুনি অনুভূত হওয়া অবাক হওয়ার কিছু নয়। কিন্তু ভয় বা গুজব নয়, বরং তথ্য-উপাত্তই এখানে সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।
নরসিংদীর ভূমিকম্প আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল মোটেই স্থির নয়। আজকের (২১ নভেম্বর) ভূমিকম্প ভূগর্ভকে চাপমুক্ত করেছে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই বরং ধীরে ধীরে চাপ বাড়ছে এবং যেকোনো সময় এ ধরনের আরও ভূমিকম্প ঘটতে পারে। বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের মধুপূর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট, প্লেট বাউন্ডারি, আরাকান সাবডাকশান জোন আরও বড় মাত্রার ভূ-কম্পন তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থান করায় আগামী দশকগুলোতেও বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকেই যাবে। আজকের (২১ নভেম্বর) ঘটনাটি বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন বার্তা এনে দিয়েছে আর নীতিনির্ধারকদের সামনে ঝুঁকি কমানোর জরুরি দায়িত্ব তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতি মনে করে বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও দেশের বিভিন্ন খাতে টেকসই উন্নয়নের জন্য ভূতাত্ত্বিক জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভূতত্ত্ববিদদের সক্রিয় অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ জরুরি।”

















