পুলিশকে সরাসরি গুলির নির্দেশ, কোন যুগে বাংলাদেশ?
- আপডেট সময় : ১২:২৩:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
- / 74
গত সপ্তাহে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ব্রাশফায়ার করে হত্যা করার নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। ওয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে তিনি এ নির্দেশনা দেন সিএমপি পুলিশ সদস্যদের। একইভাবে গতকাল রবিবার (১৬ নভেম্বর) ককটেল হামলা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধে প্রয়োজন হলে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। দুজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার এমন নির্দেশের পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তাদের মন্তব্য, এ ধরনের নির্দেশ আসলে অপরাধকে উসকে দেওয়ার মতো বার্তা।
গত মঙ্গলবার সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে কয়েক দফায় ওয়্যারলেস সেটে টহল ও থানা পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেখামাত্র ব্রাশফায়ার নিরস্ত্র জনসাধারণের জন্য নয়। যার হাতে অস্ত্র নেই, তার ওপর তো আর এসএমজি ইউজ করবো না। সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী যারা তাদের জন্য এই নির্দেশনা। আমার এলাকায় ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে একটা খুন করে গেলো (বায়েজিদের চালিতাতলী)। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে তারা যেন আর সাহস না পায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে চট্টগ্রাম নগরে ঢোকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তারা যেন স্বপ্নেও এটি কল্পনা করতে না পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।’
একইভাবে রবিবার (১৬ নভেম্বর) বিকেলে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ওয়্যারলেস বার্তায় ডিএমপির মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের ককটেল হামলা ও যানবাহনে আগুন ধরানোর ঘটনা ঠেকাতে প্রয়োজনে হামলাকারীদের গুলি করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার কথা বলেছি। যারা মানুষ বা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করবেন, যানবাহনে আগুন দেবেন—আইনসম্মতভাবেই তাদের ওপর গুলির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশকে এমন নির্দেশ দেওয়ার পর দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও নাশকতার ঘটনা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তবে এর মধ্যেই সবচেয়ে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হলো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ‘দেখামাত্র গুলি’ করার নির্দেশনা। তাদের মতে, এটি দায়িত্বহীন, সংবিধানবিরোধী এবং মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মৌলিক নীতির পরিপন্থি।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদে প্রতিটি নাগরিকের আইনি নিরাপত্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ন্যায্যবিচারের অধিকার সংরক্ষিত। আইন বহির্ভূতভাবে গুলি করার নির্দেশ এসব অধিকার স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে। বাংলাদেশ পুলিশ আইন, দণ্ডবিধি বা ফৌজদারি কার্যবিধির কোথাও ‘দেখামাত্র গুলি’ করার অনুমতি নেই। বরং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পেশাদারিত্বের অন্যতম মূলনীতি হলো অভিযুক্ত অপরাধীকেও গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করা।
মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ‘ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য মানবাধিকারবিরোধী। যে হামলা করবে বা বোমা মারবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কিছু মৌলিক নীতিমালা আছে—কোথায়, কতটা, কোন পরিস্থিতিতে এবং কীভাবে সমানুপাতিকভাবে ব্যবহার করা যাবে। সেই নীতিমালা না মেনে, ওয়্যারলেসে সিএমপি কমিশনার বলেছেন ব্রাশফায়ার করার কথা। আর এখন ডিএমপি কমিশনার বললেন গুলি চালাতে। এটা নিঃসন্দেহে মানবাধিকার হরণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন তারা। এই মানবাধিকার হরণের আকাঙ্ক্ষা নতুন বাংলাদেশে বা স্বাধীন বাংলাদেশে অপরাধমূলক। এটি অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের রাজনীতিকে উসকে দেয়। এটি তারা করতে পারেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, তাদের মাথায় রাখা উচিত যে, বাংলাদেশে গত ১৭ বছরে চার হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আগের পরিসংখ্যান ধরলে সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়াবে। সীমান্তে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া আছে। এমন বাস্তবতায়—যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছায়া রয়েছে, এবং আজও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ হলো—এই সময়ে এ ধরনের আরেকটি মানবাধিকার হরণের রাজনীতি উসকে দেওয়া নিঃসন্দেহে প্রবঞ্চনামূলক। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ বাড়াবে এবং আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে যাবে।’
মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘জননিরাপত্তার নামে বিচারবহির্ভূত বলপ্রয়োগের বৈধতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন নির্দেশ কেবল সহিংসতা বাড়ায়, জবাবদিহি কমায় এবং নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি করে।’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘রাষ্ট্র যদি নিজেই আইনের বাইরে গিয়ে আচরণ করে, তাহলে মানুষ ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করবে কীভাবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই যেকোনও সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ। নাশকতার ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে, তবে তা হতে হবে তদন্ত, প্রমাণ ও আদালতের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্ব হলো জনগণকে রক্ষা করা, আতঙ্কিত করা নয়। মানবাধিকার ও সংবিধানের প্রতি সম্মান দেখানোই নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করে, অন্য কোনো পথ নয়।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মামুন মাহবুব বলেন, ‘তাদের এমন সিদ্ধান্ত অন্যায় এবং সংবিধানবিরোধী। এটি কোনও বৈধ সরকারের বক্তব্য হতে পারে না। তারা এভাবে প্রমাণ করলেন যে আইনের প্রতি তাদের কোন শ্রদ্ধা নেই। স্বৈরশাসনের সময়েও এমনটা দেখা গেছে। একটি মামলার রায়ে সুপেরিয়র রেসপনসিবিলিটির কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারা সরাসরি গুলি না করেও দণ্ডিত হয়েছেন। সেক্ষেত্রে যেখানে বিচার করে সাজা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখানে পুলিশ নিজেদের আইন ও সংবিধান ভেঙে দেশের সকল আইন লঙ্ঘন করেছে। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
গত মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সিএমপি কমিশনারের ব্রাশফায়ারের নির্দেশের পর আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের নির্দেশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করে, যা সংবিধান, আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থি।
আসক জানায়, সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে নাগরিকের জীবনের অধিকার এবং আইনের আশ্রয় পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া আছে। সন্দেহভাজন অপরাধীকেও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া হত্যা বা গুলি করার নির্দেশ গ্রহণযোগ্য নয়।
সংগঠনটি বলে, এ ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানবাধিকার ও সংবিধানসম্মত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। সরকারকে জানাতে হবে—বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুলি চালানোর নির্দেশ রাষ্ট্রের নীতি ও আইনি কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
আসক মনে করে, রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব নাগরিকের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করা। চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের এমন বক্তব্য দায়িত্বশীল প্রশাসনিক আচরণের পরিপন্থি এবং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের মৌলিক নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। আসকের মত, এ বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত, নইলে এমন নির্দেশ ভবিষ্যতে প্রাণহানি ও বিচারবহির্ভূত ঘটনার ঝুঁকি বাড়াবে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের জন্য অগ্রহণযোগ্য।

















