এই আশঙ্কার পেছনে রয়েছে সৌদি আরবের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০৩০’। এর বাস্তবায়নের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে দেশে ফিরতে হতে পারে, এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ। এ নিয়ে প্রতিবেদনটি করেছেন দেশকাল নিউজ ডটকম-এর সিফাত কবীর।
কী এই ভিশন ২০৩০
২০১৬ সালে ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’-এর মূল উদ্দেশ্য সৌদি অর্থনীতিকে তেলনির্ভরতা থেকে সরিয়ে বহুমুখী খাতে রূপান্তর করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের অবদান ৪০ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে উন্নীত করা এবং বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সৌদির রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে সরকারি রাজস্ব থেকে, আর জিডিপির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই তেলনির্ভর।
কীভাবে আলোচনার সূত্রপাত
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেন, ২০১৭ সালে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়েছিল যে ‘ভিশন ২০৩০’-এর আওতায় বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তার ভাষায়, “এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে অন্তত ২২ লাখ বাংলাদেশিকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ফিরতে হতে পারে। ২০২৫ প্রায় চলে এসেছে, অথচ আমরা এখনও এর জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারিনি।”
সাবেক রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ
সৌদি আরব ও ওআইসিতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ জানান, সৌদি সরকার তাদের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতে এবং বিদেশি শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত প্রবাসী শ্রমিককে স্বদেশি নাগরিকদের দ্বারা প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
তিনি বলেন, “সৌদি কর্তৃপক্ষ একবার সিদ্ধান্ত নিলে তা ঘন ঘন মনে করিয়ে দেয় না, বরং সময়মতো বাস্তবায়ন করে ফেলে।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, “মাত্র তিন মাসে ৭২ হাজার বাংলাদেশি মোবাইল বিক্রেতা, ২ লাখ নিরাপত্তারক্ষী এবং ২ লাখ বিক্রয়কর্মীকে সৌদি নাগরিকদের দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।”
তার ভাষায়, “এসব উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, সৌদাইজেশন নীতিটি তারা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করছে।”
গোলাম মসিহ আরও জানান, বর্তমানে অনেক বাংলাদেশি ‘ফ্রি ভিসা’ নিয়ে সৌদি আরবে যাচ্ছেন, যা অবৈধ। তাদের অধিকাংশই নিম্নবেতনের কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, “চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে স্বয়ংক্রিয়তা ও রোবোটিক প্রযুক্তির বিস্তারে বহু শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন, যা এক মিলিয়নেরও বেশি বাংলাদেশির জীবিকা হুমকিতে ফেলতে পারে।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত আরও জানান, ট্যাক্সি চালানোর অপরাধে অনেক বাংলাদেশিকে ২০ হাজার সৌদি রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা করা হচ্ছে, যার ফলে প্রায় এক লাখ চালক চাকরি হারিয়েছেন।
নারী কর্মীদের দুরবস্থা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আমার সময়ে রিয়াদে ৫০০, জেদ্দায় ১০০ ও মদিনায় ৫০ নারীর জন্য সেফ হাউস চালু ছিল, কিন্তু এখন সেগুলো প্রায় অকার্যকর। ফলে অনেক বাংলাদেশি নারী সৌদির বড় শহরগুলোতে রাস্তায় ভিক্ষা করছেন, যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান
এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ফেরত আসার আশঙ্কাকে ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে মনে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের মধ্যপ্রাচ্য শাখার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশকাল নিউজকে বলেন, “এত বড় পরিসরে বাংলাদেশি শ্রমিক কমানো এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত নয়। সৌদি আরব এখনও বাংলাদেশি শ্রমিক নিচ্ছে এবং গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতা ও খুচরা বিক্রয়সহ বিভিন্ন খাতে বিদেশি শ্রমের ওপর নির্ভর করছে।”
তিনি আরও জানান, “বর্তমানে যারা সৌদি যাচ্ছেন, তারা ‘তাকামুল’ প্রশিক্ষণ নিয়ে সার্টিফিকেটসহ যাচ্ছেন।”
তার ভাষায়, “চিন্তার কিছু নেই। যদি শ্রমিক কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, আমরা ইতিমধ্যেই তার ইঙ্গিত পেতাম। সৌদির চলমান প্রকল্পগুলোতে এখনও বিপুল শ্রমশক্তির প্রয়োজন।”
অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী মনে করেন, পরিবর্তিত বাস্তবতার জন্য বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
তিনি বলেন, “সরকারকে এখন থেকেই প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমশক্তি তৈরি করতে হবে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “শ্রমবাজার ব্যর্থ হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু রেমিট্যান্স অনেক কম, কারণ আমরা প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করতে পারিনি।”
ড. সিদ্দিকী আরও বলেন, “এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক দেশে ফিরে এলে তার প্রভাব পড়বে আমদানি-রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ও টাকার মানে, কারণ রেমিট্যান্সের ওপরই আমাদের নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি।”
তার পরামর্শ, “শুধু দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করলেই হবে না; দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে শক্তিশালী দরকষাকষি গড়ে তুলতে হবে। দেশে আরও বেশি প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে এবং বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।”
বিএমইটির পরিসংখ্যান
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ৯৬৪ জন বাংলাদেশি সৌদি আরবে গেছেন।
সংস্থাটি জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারিতে সৌদিতে নারী প্রবাসী গেছেন ৪ হাজার ৬৩৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৩৪২, মার্চে ৪ হাজার ১০১, এপ্রিলে ১ হাজার ২০১ এবং মে মাসে ৪ হাজার ৫০৪ জন।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন, “শুধু দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করলেই হবে না; দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে শক্তিশালী দরকষাকষি গড়ে তুলতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে এবং বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয় করতে হবে।”

















