স্যান্ডেল পিট্টি দেয়া মেয়ের প্রতি খোলা চিঠি
- আপডেট সময় : ১০:৫০:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫
- / 107
প্রিয়বরেষু আত্মজাসম আমার,
শুভাশীষ! হে মেয়ে তুমি আমার কন্যার বয়সী, তোমার মতো মেয়ে আমাদের আশাবাদী করে যে, বাংলাদেশ সত্যিই এগিয়েছে এবং এই ধারা বন্ধ হবে না৷ ওরা নোংড়া কথা বলে দীর্ঘকাল ধরেই পার পেয়ে যাচ্ছিল৷ বাজখাই কণ্ঠে একটি ধমক, পেশিবহুল হাত দিয়ে একটি ধাক্কা বা থপ্পর, লোমশ পা দিয়ে একটি লাথির ভয়ে আমাদের কন্যারা কুঁকড়ে যেতো৷ তোমাকেও যখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো তখন যদি উঠে না দাঁড়াতে তাহলে ওই নষ্ট লোকটি তোমাকে পা দিয়ে চেপে ধরতো৷ বাসের লোকেরা আড্ডায় গল্প বলার উপাদান পেয়ে গিয়েছিলো—পুরুষের আধিপত্যের গল্প৷ কিন্তু তুমি যখন আবারো উঠে দাঁড়ালে এবং স্যান্ডেল দিয়ে আঘাত করতে সক্ষম হলে তখন মনে হয়েছিল ঈশ্বর বুঝি একজন সুন্দরী তরুণীও হতে পারে৷ ইহুদিদের ঈশ্বর তার নিজের অবয়বেই যখন মানুষ সৃষ্টি করেছে আর সে যদি সাহসীই হয় তাহলে সে তোমার মতোই তো হবে৷
তোমার সাহস নিয়ে কবিতা লিখবো এবং আরো বহুদিন ওই সাহসকে শ্রদ্ধা জানাবো৷ এই জুতোপিট্টি কেবলই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা একটা পথরেখা তৈরি করেছে৷ আশা করছি এই দৃশ্য দেখে অসংখ্য মেয়ে পায়ের স্যান্ডেল হাতে তুলে নিতে সময় নিবে না প্রয়োজনের সময়৷ এতোকাল যে কেবল পুরুষরাই চুলের মুঠি ধরে পীঠ ফাঁটাতো তার প্রতিরোধও সম্ভব হবে৷ আমার স্নেহাশীষ এক সহকর্মীকে তার স্বামী বলেছিলো, ‘বেতনের টাকা তুলে না দিলে গায়ে কিন্তু হাত তুলবো৷’ যেদিন আমার সহকর্মী বলতে পারলো, ‘আমারও হাত আছে, আমিও বসে থাকবো না৷’ সেদিনই গণেশ উল্টে গেলো৷ ওর স্বামী হাত তোলার কথা বলতে আর সাহস করেনি৷ মেয়েটি ফিরে পেয়েছিলো তার সম্মান৷ সম্মান ফেরাতে প্রয়োজনে হাত তুলতে হবে, স্যান্ডেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷
হেনরিক ইবসেনের ‘দ্য ডলস হাউজ’ উপন্যাসের নায়িকা ঘর ছেড়েছিলো৷ আমরা জানি না নোরা সফল হয়েছিলো কি না? তবে নোরার পরিকল্পনা ছিলো৷ নোরা স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে ধার করেছিল৷ কিন্তু স্বামী সেটা জানতে পেরে নোরাকে অসম্মান করে৷ তার মনে হয় সে পুতুলের সংসার করছে৷ সে ঘর ছাড়ে স্বাবলম্বী হতে৷ আজ অসখ্য নোরা স্বাবলম্বী হয়েছে৷ দুশ বছর পরের নোরারা তো কেবল চলে গিয়েই ক্ষান্ত থাকবে না৷ তার হাতে স্যান্ডেল খুবই মানানসই৷
বাস্তব দুনিয়ার বহু নারীর সফলতার গল্প ছাড়া আজকের সভ্যতা আসতো না৷ আমাদের বেগম রোকেয়া একই সময়ে স্বামীর মৃত্যুর পরে নারী জাগরণের পথরেখা তৈরি করেছেন৷ তসলিমাও নোরার মতো বারবার ঘর ছেড়েছে৷ অরুন্ধতি রায়ের মতো অসংখ্য মেয়ে সংগ্রাম করেই সফল হয়েছে৷ প্রয়োজনে ব্যাগে ছুরিও রেখেছে৷
আমার শৈশবে একটি মেয়ে স্বামীর ঘর করতে চায়নি বলে তার নিষ্ঠুর স্বামী চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিচড়ে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল৷ আমি একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেনো এমন করছে? কেউ বলেছিলো, ‘সে তার স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছে৷’ অসংখ্য মেয়েই ভেবেছিলো, এভাবে টেনে হিচড়ে নেয়া স্বামীর অধিকার৷ অসংখ্য মেয়ে বুঝেছিলো, অবাধ্য হলে এভাবে টেনে নেয়া হবে৷ এসব প্রথা সারা বিশ্বের সভ্য দেশের মেয়েরা বহুভাবেই ভেঙেছে৷ এদেশেও তসলিমা, হুমায়ুন আজাদ প্রথা ভাঙার ডাক দিয়েছেন৷
তোমার মনে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীটির কথা যে সন্ধ্যায় ধর্ষণের শিকার হয়ে বলেছিলো, এক খুব শক্তিশালী মানুষ তাকে ধর্ষণ করেছে৷ পরে দেখলাম এক তুচ্ছ পটকা মাদকসেবীকেই সে শক্তিশালী মানুষ ভেবেছে৷ ভয় এমনই জিনিস যা সামনের ইঁদুরকেও সিংহ বানিয়ে দেয়৷ সাহস করতে পারে উল্টোটা৷ একটা দূরন্ত ষাঁড়ের সামনে দাঁড়াতে পারে এক অদম্য কিশোরী৷ শাণিত বুদ্ধি ও দুর্দান্ত সাহসের সম্মিলনই তাঁকে রক্ষা করবে৷ সে জানবে কখন পাশ কাটাতে হবে আর কখন আক্রমণ করতে হবে৷ বাসের কেউ-ই তোমার পক্ষে সোচ্চার হয়নি। তুমি সাহস না দেখালে ওই লোকটিও শক্তিশালী হয়ে উঠতো, তোমাকেই আরও আঘাত করতো।
লেখক ও সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি তার বই ‘এ লেটার টু এ চাইল্ড হু নেভাব বর্ণ’-এ অনাগত সন্তানের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমাকে যদি কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে আসে, তাহলে তুমিই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে।’তুমি এসেছো ওরিয়ানার সেই অনাগত সন্তান হয়ে। ওই বদমাস লোকটি তোমাকে থাপ্পর দিয়েছে, মারার জন্য স্যান্ডেল খুলেছে। ওরিয়ানার প্রত্যাশা মতো তার কন্যা হয়েই তুমিও হাতে স্যান্ডেল তুলে নিয়েছো।
প্রতিবাদ না করতে পারা অসংখ্য মেয়েকে দেখেছি৷ আমাদের এলাকার দুজন ১৪টি করে বিয়ে করেছিলো৷ আগের বা পরের কোনো স্ত্রীই প্রতিবাদ করতে পারেনি৷ আমাদের পাশের গ্রামের দুই সুন্দরী বোন ছিলো যৌনকর্মী৷ এক বোন বাড়িতে আসলে খদ্দের হিসেবে হাজির হয়েছিলো দুই ভাই৷ তা নিয়ে রসালো গল্প তৈরি হয়৷ যৌনকর্মী নারীকে সকালে ধরে এনে বাজারের মধ্যে নিপীড়ন করা হয়৷ প্রকাশ্যে তার চুল কেটে দিয়ে মুখে চুনকালী মাখিয়ে দেয়া হয়৷ তখনও প্রতিবাদের ভাষা তৈরি হয়নি৷ কাউকে কাউকে প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করতে এগিয়ে আসতে হয়৷ প্রতিবাদের একটা ভাষা তৈরি করার জন্য অভিবাদন জানাচ্ছি৷
এখন তোমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অসংখ্য পুরুষও রয়েছে যারা মানবিক ও প্রগতিলীল৷ তোমার সাহসকে অসংখ্য মানুষও সাধুবাদ দিচ্ছে, অসংখ্য নারীকে সাহসী করে তুলেছে। তুমি কোনো ভুল করোনি। হাতে স্যান্ডেল নিতে না পারলেই ভুল হয়ে যেতো। তুমি এই ঘটনা সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় হতাশ বা ট্রমাটাইজড হইও না। ছড়িয়ে না পড়লে, নারীরা কীভাবে উপলব্ধি করতো, এমন ঘটনা ঘটানো যায় এবং তা পথরেখা তৈরি করে।
সাহস ধরে রাখো। ভালো থেকো মেয়ে। ইতি
তোমারই পিতৃসম একজন।
মজিব রহমান: পেশায় শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পাঠাগার আন্দোলনে সক্রিয়।





















