সালমান শাহ হত্যা মামলা: ১১ আসামি কে কোথায়?
- আপডেট সময় : ১২:৩১:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
- / 224
জনপ্রিয় চিত্রনায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ওরফে ইমন, যিনি চলচ্চিত্রে সালমান শাহ নামে পরিচিত। তার মৃত্যুর ঘটনায় ২৯ বছর আগে করা অপমৃত্যুর মামলা এখন রূপ নিয়েছে হত্যা মামলায়। আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে গত ২১ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় সালমান শাহর মামা, চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর হোসেন কুমকুম বাদী হয়ে এই হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, শাশুড়ি লতিফা হক লুসি, বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকেও আসামি করা হয়েছে। তবে এসব আসামি বর্তমানে কে কোথায় আছেন, তা স্পষ্টভাবে জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এই হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন—সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, শাশুড়ি লতিফা হক লুসি, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল হক ওরফে ডন, ডেভিড, জাভেদ ও ফারুক (বিএফডিসি এলাকার বাসিন্দা), ফরিদপুরের রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, রুবী, আ. ছাত্তার ও সাজু।
মামলা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৩ অক্টোবর আদালতে শুনানির সময় প্রথমবার উপস্থিত ছিলেন সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক। এর এক সপ্তাহ পর আদালতের নির্দেশে রমনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে—আসামিরা বর্তমানে কোথায়? দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই বহুদিন ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ লন্ডনে আছেন। সামিরা হক, তার মা লতিফা হক লুসি ও খলনায়ক ডন দেশেই ছিলেন। ১৩ অক্টোবর আদালতে সামিরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে ২০ অক্টোবর আদালতের নির্দেশে মামলা দায়েরের পর থেকে তারা গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্য আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ এখনও নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেনি।
মামলাটি তদন্ত করেছে পুলিশের চারটি সংস্থা। প্রথমে রমনা থানার এসআই মাহবুবুর রহমান তদন্ত করেন। পরে তা হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। সেখানে পর্যায়ক্রমে এএসপি হুমায়ুন কবীর ও এএসপি মো. মজিবুর রহমান তদন্ত করেন। এরপর মামলাটি যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি), যেখানে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি খালেক-উজ-জামান। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে মামলাটি পিবিআইয়ের কাছে যায়। সেখানে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ইন্সপেক্টর মো. সিরাজুল ইসলাম বাবুল এবং তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার শফিউল আজম ও বশির আহমেদ। প্রতিটি সংস্থার প্রতিবেদনেই সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়েছে।
এ ঘটনায় বিচারিক তদন্তও হয়েছিল। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের বিচারক ইমদাদুল হক জুডিশিয়াল তদন্ত পরিচালনা করেন, যেখানে একই ফলাফল উঠে আসে।
২১ অক্টোবর দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে রমনা থানার ইন্সপেক্টর আতিকুল আলম খান্দকারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,
“নতুন করে তদন্ত শুরু করেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি আসামিদের অবস্থান শনাক্তের কাজ চলছে।”
আসামিরা দেশে আছেন, না বিদেশে পালিয়েছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,
“জানলে তো ধরেই ফেলতাম। তারা কে কোথায় আছেন, সেটা জানার চেষ্টা চলছে। আসামিরা যাতে দেশ ছেড়ে যেতে না পারেন, সে জন্য ইমিগ্রেশনে মামলার তথ্য পাঠানো হয়েছে।”
অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান,
“যেসব আসামি দেশে আছেন, তারা যেন পালিয়ে যেতে না পারেন—সে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুলিশও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“রেজভীর দেড় বছরের সাজা হয়েছিল। পরে জামিনে বেরিয়ে তিনি লন্ডনে পালিয়ে যান। সেখান থেকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে একটি মেইল এবং আদালতের কাছে একটি ভয়েস মেইল পাঠিয়েছেন। আমরা আদালতে সেটির সার্টিফায়েড কপি চেয়েছি, তার বক্তব্য জানার জন্য। যদিও তিনি পলাতক হওয়ায় আইনগতভাবে এমনটি করার অধিকার নেই। আদালতও তাকে পলাতক ঘোষণা করেছে। সাজা পরোয়ানা জারি হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা রিভিশন আবেদন করেছিলাম, যার শুনানি ১৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়। সেই শুনানিতে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক প্রথমবার আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনিই মামলার মূল আসামি।”
সালমান শাহ হত্যা মামলার প্রধান আইনজীবী আরও বলেন,
“সালমানের মৃত্যুর দিনই অনেকটা পরিবারের অজান্তে পুলিশ তার বাবার সই নিয়ে রমনা থানায় অপমৃত্যুর মামলা করে। সেই মামলার তদন্ত চলাকালেই ১৯৯৭ সালে রেজভী আহমেদ এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। সেখানে তিনি স্বীকার করেন, সালমান শাহকে হত্যা করে আত্মহত্যা সাজানো হয়েছে এবং তিনিও হত্যায় জড়িত ছিলেন। পরে সালমানের বাবার করা মামলায় ১০ জনকে আসামি করা হয়। সর্বশেষ করা এই হত্যা মামলায় আসামির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১।”
মামলার বাদী সালমান শাহর মামা ও চলচ্চিত্র পরিচালক মো. আলমগীর কুমকুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,
“সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করেছি। পুলিশ তদন্ত করছে। আমরা খুনিদের বিচার চাই।”
সালমান শাহ ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান। রাজধানীর রমনা থানার নিউ ইস্কাটন রোডের ১১/বি ইস্কাটন প্লাজার ফ্ল্যাট থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিনই নায়কের বাবা কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী রমনা থানায় এজাহার দাখিল করেন, যা পরে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর সিআইডি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলা হয়। কয়েক বছর পর, ২০০০ সালের ১১ মে সালমানের বাবা মারা যান। এরপর তার মা নিলুফার জামান চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরী আইনি লড়াই চালিয়ে যান। শুরু থেকেই তার অভিযোগ ছিল—সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে, আর সেই অভিযোগের আঙুল ছিল পুত্রবধূ সামিরা হকসহ আরও কয়েকজনের দিকে।




















