যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০ তরুণকে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরিয়ে ভারতে ফেরত
- আপডেট সময় : ০১:২৩:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
- / 202
উন্নত জীবনের আশায় জমি বিক্রি, ঘর বন্ধক রেখে এবং দালালদের ভরসায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। অবৈধভাবে বসবাস করায় যুক্তরাষ্ট্র এসব ভারতীয় নাগরিককে বহিষ্কার করেছে। রোববার (২৬ অক্টোবর) ভোরে হরিয়ানা রাজ্যের ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৫০ তরুণকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এ সময় তাঁদের হাতে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরানো ছিল।
ফেরত আসা তরুণদের অনেকেই দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানের ফলে ধরা পড়ার পর এখন তাঁরা ঋণের বোঝায় জর্জরিত।
হরিয়ানার কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ফেরত পাঠানোদের মধ্যে ১৬ জন কারনালের, ১৪ জন কাইথালের, ৫ জন কুরুক্ষেত্রের ও ১ জন পানিপথের বাসিন্দা। তাঁরা সবাই দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মধ্য দিয়ে পরিচিত মানব পাচারের পথ ‘ডানকি রুট’ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন। কেউ সেখানে কয়েক বছর ছিলেন, কেউ বা মাত্র কয়েক মাস। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে ফেরত পাঠানোর আগে কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে।
ফেরত আসা ভারতীয়দের একজন কারনালের রাহরার বাসিন্দা অঙ্কুর সিং (২৬)। তিনি জানান, ২০২২ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে তাঁর ২৯ লাখ রুপি খরচ হয়েছিল। দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ পেরোতে তাঁর যাত্রায় প্রায় চার মাস লেগেছিল।
অঙ্কুর সিং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে বলেন, ‘আমি “ডানকি রুট” হয়ে গিয়েছিলাম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে একটি মদের দোকানে কাজ করার সময় আমি ধরা পড়ি।’
অঙ্কুর আরও বলেন, এরপর তাঁকে একটি আটককেন্দ্রে রাখা হয়। ২৪ অক্টোবর ভারতে ফেরার জন্য তাঁদের উড়োজাহাজে তোলা হয়। সেই ফ্লাইটে হরিয়ানার প্রায় ৫০ জন ছাড়াও পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ, গুজরাট ও গোয়ার তরুণেরাও ছিলেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৫০০ ভারতীয় নাগরিককে আটটি সামরিক, চার্টার্ড এবং বাণিজ্যিক ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বা প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও গুজরাটের বাসিন্দা।
রোববার ফেরত পাঠানো দলে ছিলেন কারনালের ঘোরাউন্দা ব্লকের পোপরা গ্রামের হুসন (২১)। তিন বোনের একমাত্র ভাই হুসন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। তাঁর কাকা সুরেন্দর সিং জানান, এজেন্টদের ৪৫ লাখ রুপি দিতে পরিবারের তিন একর জমি বিক্রি করতে হয়েছে।
সুরেন্দর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই হুসন ধরা পড়ে। এটা আমাদের জন্য এক বিশাল ধাক্কা ছিল। তাঁরা রোববার রাত ১টার পর দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছান। তাঁদের হাতে হাতকড়া এবং পায়ে বেড়ি পরানো ছিল।’
কারনালের কালসী গ্রামের হরিশ এসসি (তফসিলি জাতি) শ্রমজীবী পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁর ভাই রিঙ্কু বলেন, ‘তিনি ২০২৩ সালে কর্মীভিসায় কানাডায় গিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর সেখানে থাকার পর গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং একটি দোকানে কাজ শুরু করেন। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ধরা পড়েন।’
কাইথালের তারাগড় গ্রামের নরেশ কুমার এক বছরেরও বেশি সময় আটক থাকার পর দেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, ‘উড়োজাহাজে ওঠানোর সময় আমাদের হাতকড়া পরানো হয়েছিল। তবে তাঁরা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি। ফেরত পাঠানোর আগে আমি সেখানে ১৪ মাস কারাগারে ছিলাম।’
নরেশ আরও বলেন, ‘আমি ২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি দিল্লি থেকে রওনা হয়ে ব্রাজিল হয়ে ৬৬ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাই। আমাদের এজেন্টরা প্রতারণা করেছে। তারা ৫৭ লাখ ৫০ হাজার রুপি নিয়েছিল। প্রথমে ৪২ লাখে পাঠানোর কথা বলেছিল, পরে আরও টাকা দাবি করে। আমি এক একরের বেশি জমি বিক্রি করেছি। সুদে ৬ লাখ টাকা ধার করেছি, আমার ভাই ৬ লাখ ৫০ হাজার রুপির জমি বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া এক আত্মীয় আরও ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা সাহায্য দিয়েছেন।’
কাইথালের পুলিশ সুপার উপাসনা জানান, জেলার ১৪ জন ফেরত আসা ব্যক্তিকে রোববার দুপুর ২টার দিকে দিল্লি থেকে আনা হয়। তিনি বলেন, তাঁরা সবাই ‘ডানকি রুট’ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আবগারি মামলার পরোয়ানাভুক্ত আসামি ছিলেন, যিনি একাধিকবার আদালতে হাজিরা দেননি।
জিণ্ডের এসপি কুলদীপ সিং নিশ্চিত করেছেন, তাঁর জেলা থেকেও তিনজনকে ফেরত আনা হয়েছে। তাঁদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এসপি সিং সতর্ক করে বলেন, ‘ডানকি রুটে’ বিদেশে যাওয়া গুরুতর অপরাধ। এটি পরিবারকে আর্থিকভাবে নিঃস্ব করে দেয় এবং জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। পথে অনেকেই দুর্ব্যবহার, প্রতারণা এমনকি মৃত্যুর মুখেও পড়েন।’

















