আবুল কালামকে হারিয়ে শোকে স্বজনরা, অনিশ্চয়তায় দুই শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ
- আপডেট সময় : ১২:৩৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
- / 82
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। তাকে হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়েছেন স্বজনরা। তার মৃত্যুতে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানের জীবন। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। পরিবারে চলছে শোকের মাতম। রোববার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিহত হন আবুল কালাম।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চৌকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে আবুল কালাম চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। ২০ বছর আগে বাবা-মা দুজনেই মারা যান। এরপর বড় ভাই-বোনদের কাছে বেড়ে ওঠেন তিনি। সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়া যান এবং সেখান থেকে ফিরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে তাদের ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছরের এক মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় বসবাস করতেন। ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন এবং প্রতিদিন ওই কাজের জন্য নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা যাতায়াত করতেন।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে যান আবুল কালাম। এরপর কাজের প্রয়োজনে বের হন তিনি। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যায়। সেটির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান আবুল কালাম। পরে গণমাধ্যমে খবর দেখে পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুর সংবাদ জানতে পারেন। শুরু হয় স্বজনদের আহাজারি। খবর পেয়ে গ্রাম থেকে ছুটে আসেন স্বজনরা। শোকে কাঁদছেন গ্রামের মানুষও।
বিকেলে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চার ভাইয়ের টিনের চারটি বসতঘর। গ্রামে এলে আবুল কালাম একটি ঘরে থাকতেন, এখন সেটি তালাবদ্ধ। বড় ভাই খোকন চৌকদারের ঘরে বসে কাঁদছিলেন বড় বোন সেলিনা বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিবেশীরা।
স্বজনদের ভাষায়, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আবুল কালাম। তার মৃত্যুর পর দুই শিশুসন্তান এতিম হয়ে গেল। এখন তাদের দেখাশোনা কে করবে, সংসার কীভাবে চলবে—এ নিয়েই উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
বড় ভাই খোকন চৌকদার, যিনি গ্রামের বাড়িতে থেকে পারিবারিক জমিজমা দেখাশোনা করেন, বলেন, “গত মাসে আবুল বাড়িতে এসেছিল। কাজ সেরে আবার ঢাকায় ফিরে যায়। বুঝিনি, ওটাই হবে তার শেষ যাত্রা। এখন ফিরবে তার লাশ। তার স্ত্রী-সন্তানদের কে দেখবে, কী হবে তাদের? আমাদের ওপর বড় এক বিপদ নেমে এলো।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বড় বোন সেলিনা বেগম বলেন, “আমার ভাই জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। তার আয়ে সংসার চলতো। ভাইয়ের সন্তানদের এখন কে দেখবে?”
চাচাতো ভাই আলি আহমেদ চৌকদার বলেন, “গতকাল ফেসবুকে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা পোস্ট দিয়েছিল। আজ সত্যিই চলে গেল। নিজেকে সামলাতে পারছি না, আমরা বাকরুদ্ধ।”
আরেক চাচাতো ভাই আব্দুল গণি মিয়া বলেন, “আধুনিক মেট্রোরেল যদি এমন নিরাপত্তাহীন হয়, তাহলে মানুষ শহরে চলাচল করবে কীভাবে? যাদের অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমরা তাদের বিচার চাই।”
আবুল কালামের বাল্যবন্ধু রিহিনুজ্জামান বলেন, “কাল রাতে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। বলেছিল ভালো আছে, সময় পেলে গ্রামে আসবে। সেই মানুষটা আজ নেই—এই মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না।”
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আব্দুল কাইয়ুম খান বলেন, “মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। এতে ঈশ্বরকাঠি গ্রামের আবুল কালামের মৃত্যু হয়েছে। আমরা গভীরভাবে শোকাহত। উপজেলা প্রশাসন তার পরিবারের খোঁজখবর রাখছে। সরকার তাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে, উপজেলা প্রশাসনও ওই পরিবারের পাশে থাকবে।”
প্রসঙ্গত, ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। এ ঘটনায় নিহত আবুল কালামের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দুপুরে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।

















