শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুন: অবহেলাতেই কি সব পুড়ল?
- আপডেট সময় : ১০:৫৮:০০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
- / 68
একটি ছোট আগুন মুহূর্তেই রূপ নেয় ভয়াবহতায়। টানা সাত ঘণ্টা জ্বলার পর ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু ততক্ষণে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে রাখা অধিকাংশ পণ্যই পুড়ে ছাই।
রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় দুপুরের দিকে আগুন লাগার পর এত সময় পেরিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য প্রতিবছরই বিমানবন্দরে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া হয়—ডামি উড়োজাহাজে আগুন লাগিয়ে ফায়ার ইউনিটের আধুনিক ‘এয়ারপোর্ট ক্রাশ টেন্ডার’ দিয়ে তা নিভিয়ে প্রশংসা কুড়ানো হয়। কিন্তু শনিবার বাস্তব আগুনের ঘটনায় সেই দক্ষতার ছাপ দেখা যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
মাত্র ছয় দিন আগেই (১২ অক্টোবর) বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানিয়েছিল, যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি) শাহজালালের কার্গো শাখার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শতভাগ নম্বর দিয়েছে। সেটি ‘বড় সাফল্য’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। এক সপ্তাহ না যেতেই ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড সেই সাফল্য ও বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি—দুয়ের ওপরই বড় আঘাত হেনেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোও ‘ঢাকা বিমানবন্দরে আগুনে ফ্লাইট বিপর্যয়’ শিরোনামে খবরটি প্রকাশ করেছে।
কার্গো কমপ্লেক্স সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুন লাগার পর যথেষ্ট সময় থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছানোর আগেই আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রাসায়নিক থাকার আশঙ্কায় ফায়ার সার্ভিস ‘পানি না ছিটিয়ে’ রক্ষণশীল আচরণ করায় আগুন দ্রুত পুরো কমপ্লেক্সে ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্টরা প্রাথমিক হিসাবে বলছেন, ব্যবসায়ীদের কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সরকার কিছু না বলায় উদ্বেগ বাড়ছে তাদের মধ্যে।
বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগুন লাগে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, তারা খবর পায় ২টা ৩০ মিনিটে, প্রথম ইউনিট পৌঁছে ২টা ৫০ মিনিটে—অর্থাৎ অন্তত ৩৫ মিনিট পর।
ফায়ার সার্ভিসের আগে ঘটনাস্থলে যায় বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট, তবে তারাও দেরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বেবিচকের সেই ইউনিটে রয়েছে আধুনিক ‘রোজেনবাওয়ার প্যানথার’ সিরিজের অগ্নিনির্বাপন যান, যেগুলো দূর থেকে পানি ও ফোম ছিটাতে সক্ষম।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অভিযোগ, এই ইউনিট কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এমনকি আগুন লাগার প্রাথমিক পর্যায়ে যারা ভেতরে ঢুকে নেভাতে চেয়েছিলেন, তাদেরও বাধা দেওয়া হয়।
এ ওয়ান নামের সিঅ্যান্ডএফ কোম্পানির পরিচালক ইমরান হোসাইন বলেন, “ভাই, আগুনটা কুরিয়ারের গুদাম থেকে লাগে। সেখানে ২৫-৩০টা কুরিয়ার সার্ভিসকে খোপ আকারে জায়গা দেওয়া, যেটাকে আমরা বলি ‘খাঁচা’। ডিএইচএলের খাঁচা থেকেই প্রথম আগুনের খবর পাই। কিন্তু নেভাতে যাওয়া লোকজনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল ভেতরে বিস্ফোরক বা কেমিকেল আছে।”
এ বিষয়ে ডিএইচএল কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের কর্মী সাকিব বলেন, “বিমানবন্দরে আগুন বা ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমাদের কোনো নির্দেশনা বা তথ্য দেওয়া হয়নি। কাস্টমার কেয়ার সেন্টারও বিষয়টি জানে না।”
ওয়্যারহাউজটির আয়তন প্রায় ১৪ লাখ বর্গফুট—দৈর্ঘ্যে ৪০০ গজ ও প্রস্থেও ৪০০ গজ, জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মুহাম্মদ জাহেদ কামাল।
গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ-এর কর্মীরা জানান, বেলা ২টার পর অ্যালার্ম বাজতেই তারা বেরিয়ে আসেন। একজন বলেন, “আমাদের কিছু লোক আগুন নেভাতে গেলে বলা হয় এখানে বিস্ফোরক আছে, সরে যান—তখন আমরা ফিরে আসি।”
আরেকজন বলেন, “গুদামে অনেক ক্যামেরা লাগানো। সেখানে দেখা গেলেই বোঝা যাবে আগুন কখন-কীভাবে লাগল।”
অন্যদিকে কেউ কেউ জানিয়েছেন, আগুন শুরু হয় স্কাই ক্যাপিটাল এয়ারলাইন্সের গুদাম থেকে, পরে ডিএইচএলের অংশে এবং শেষে ‘ডেঞ্জারাস গুডস’-এর গুদামে ছড়ায়।
শাহজালাল বিমানবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলেন, “আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর গেটে আটকে থাকে। অনুমতির জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিল না।”
এই অভিযোগ নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “খতিয়ে দেখা হবে, তবে এমন হওয়ার সুযোগ নেই।”
ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, “আমি এমন কিছু শুনিনি। তবে এটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এখানে ঢুকতে হয় বুঝে-শুনে।”
তিনি জানান, তারা খবর পান ২টা ৩০ মিনিটে, এরপরই অভিযান শুরু করেন।
আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এটা খোলা জায়গা, বাতাসের তীব্রতায় অক্সিজেনের সরবরাহ বেশি ছিল, যেটা আগুনকে আরও জ্বালাতে সহায়তা করেছে।”
আগুনের উৎস বিষয়ে তিনি বলেন, “তদন্ত শেষে বলা যাবে। এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।”
তিনি জানান, বেবিচকের ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করছিল, পরে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট যোগ দেয়। কোনো হতাহতের খবর নেই বলেও জানান তিনি।
রাসায়নিক থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, “আমাদের তথ্য ছিল কিছু কেমিকেল রয়েছে, তাই বাড়তি সতর্ক থাকতে হয়েছে।”
দুজন কর্মকর্তা জানান, ‘ডেঞ্জারাস গুডস’-এর গুদামে দাহ্য রাসায়নিক ও কিছু জ্বালানি থাকার তথ্য পেয়ে ফায়ার সার্ভিস কিছু জায়গায় পানির বদলে ফোম ব্যবহার করেছে।
ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন
শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির কারণে কার্গো কমপ্লেক্সের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকে। কুরিয়ারের কাজ চলে অল্প সময়, তবে লোডিং-আনলোডিংয়ের কাজ হয় সারাক্ষণ।
দুপুরের পর থেকেই সিঅ্যান্ডএফ কোম্পানির লোকজন জড়ো হয়ে ক্ষতির হিসাব কষতে থাকেন।
ফাস্ট অ্যান্ড সেইফ লজিস্টিকস-এর কর্মকর্তা আব্দুল মোমিন মণ্ডল বলেন, “চামড়া, ফ্যাব্রিকস, সুতা, লেইস ও ইলাস্টিক—সব পণ্যই আমাদের গুদামে ছিল। সবই পুড়ে গেছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, “আগুন নেভাতে লোকজনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, ফায়ার সার্ভিসও এসেছে দেরিতে।”
এ ওয়ান গ্রুপ-এর পরিচালক ইমরান হোসাইন বলেন, “আমার তিনটি চালানে কয়েক কোটি টাকার পণ্য ছিল। দুটি সম্পূর্ণ পুড়েছে। তৃতীয়টার খোঁজও পাইনি।”
তিনি আরও বলেন, “শুক্র-শনিবার ছুটির কারণে পণ্য জমে যায়। অনেকে খোলা জায়গায় রাখেন—সেগুলিও পুড়েছে।”
খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠুর প্রশ্ন, “পণ্যের দায়িত্ব তো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার বিমানের। তারা এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষই নিরাপত্তা দেয়। এখন শত শত কোটি টাকার ক্ষতির দায় নেবে কে?”
ইমরান হোসাইন বলেন, “আমার মালামালের জন্য বিমান ও শাহজালাল কর্তৃপক্ষ আলাদা চার্জ নেয়। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেবে কে—তা নিয়ে তারা কিছুই বলছে না। বীমা কভারেজ মাত্র ৬০০০ ডলার পর্যন্ত, কিন্তু ক্ষতি শত কোটি টাকার।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “বৃহস্পতিবার ট্যাক্স দিয়েছি, কিন্তু মাল ছাড় হয়নি। এখন মালও গেল, ট্যাক্সের টাকাও গেল।”
বিমান উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “ক্ষতির পরিমাণ জানতে বিমানের কার্গো পরিচালককে ম্যানিফেস্ট অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক বিবরণ দিতে বলা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই রিপোর্ট পাওয়া যাবে।”
তদন্ত কমিটি গঠন
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিমান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আইআরডির কমিটিকে দ্রুত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বিমানের কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে কারণ, দায়-দায়িত্ব ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শেষে, সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে—আগে সব দুর্ঘটনার জন্য দায় দেওয়া হতো জামায়াত-বিএনপিকে; এখন দোষ চাপানো হচ্ছে ফ্যাসিবাদীদের ঘাড়ে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববাদীদের জয়জয়কার যেন চিরকালীন।


















