ঢাকা ০৬:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিকে অস্বীকার, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছেন না বামপন্থীরা

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ১০:১৫:৩৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
  • / 122

বাম সংগঠনগুলোর সংবাদ সম্মেলন

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব ও অঙ্গীকারনামা সম্বলিত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেছে বাম ধারার চার দল।

তাদের অভিযোগ, বিদ্যমান সংবিধানের চার মূল নীতি বাদ দেওয়া হয়েছে, অঙ্গীকারনামায় মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বিষয় যুক্ত হয়েছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়া হয়েছে—এসব মিলিয়ে সাতটি কারণে তারা সনদে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) রাজধানীর পল্টনের মুক্তি ভবনে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল–বাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল–বাংলাদেশ জাসদ এই সিদ্ধান্ত জানায়।

দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিকে প্রকারান্তরে ‘অস্বীকার’ করা হয়েছে সনদে। পাশাপাশি আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না—এমন অঙ্গীকারে তারা স্বাক্ষর করতে রাজি নয়।

শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগের দিনই তারা এই ঘোষণা দেয়।

এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে এখনো মতভেদ রয়ে গেছে।

‘কেন আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারছি না’—এ ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাতটি কারণ তুলে ধরে তারা জানায়—

১. জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনার সময়ই তারা বলেছিলেন, যেসব বিষয়ে সবার ঐকমত্য আছে শুধু সেসব বিষয়েই স্বাক্ষর নেওয়া যেতে পারে। ভিন্নমতগুলো অতিরিক্ত (এনেক্স) প্রতিবেদনে যুক্ত করা যেতে পারে।
২. সনদের পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের বিবরণ সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি; সংশোধনী প্রস্তাব দিলেও তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
৩. সনদের শেষ অংশে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার চাওয়া হয়েছে—যা ভিন্নমতের অবস্থায় তাদের কাছে অযৌক্তিক।
৪. অঙ্গীকারনামার ২ নম্বরে জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। তারা সর্বসম্মত সনদ সংবিধানে যুক্ত করার পক্ষে, কিন্তু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ তা করা তাদের বোধগম্য নয়।
৫. অঙ্গীকারনামার ৩ নম্বরে বলা হয়েছে, ‘জুলাই সনদ নিয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না’—যা মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থি।
৬. এছাড়াও সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ষষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’ এবং সপ্তম তফসিলে থাকা ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, সেটা বাদ দিলে তো বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। অথচ জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে।
৭. অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা প্রাথমিক খসড়ায় থাকলেও চূড়ান্ত সনদ থেকে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

এসব কারণ ব্যাখ্যা করে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “এই সাতটি বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় আমাদের পক্ষে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, “সংবিধানের চার মূলনীতি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ—এবং ১৫০(২) অনুচ্ছেদের তফসিল পরিবর্তনের বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না—এমন অঙ্গীকারে স্বাক্ষর দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

বাসদ (মার্কসবাদী)-এর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, “দীর্ঘদিন আলোচনার পরও বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দেওয়া, মৌলিক অধিকারবিরোধী ধারা সংযোজন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়ার মতো বিষয় যুক্ত করে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে।”

সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “উনি (মুহাম্মদ ইউনূস) বলেছেন, সবকিছু হয়েছে ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ অনুযায়ী। এই সনদের মাধ্যমে এখন জাতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। মনে হয় ১৯৭১ সালকে ২০২৪ সাল দিয়ে মুছে দেওয়ার অংশ হিসেবেই এই সনদ তৈরি হয়েছে কি না, তা জনগণকেই ভেবে দেখতে হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন ও বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন।
সেখানে সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দনও উপস্থিত ছিলেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিকে অস্বীকার, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করছেন না বামপন্থীরা

আপডেট সময় : ১০:১৫:৩৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব ও অঙ্গীকারনামা সম্বলিত জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেছে বাম ধারার চার দল।

তাদের অভিযোগ, বিদ্যমান সংবিধানের চার মূল নীতি বাদ দেওয়া হয়েছে, অঙ্গীকারনামায় মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি বিষয় যুক্ত হয়েছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়া হয়েছে—এসব মিলিয়ে সাতটি কারণে তারা সনদে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) রাজধানীর পল্টনের মুক্তি ভবনে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল–বাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল–বাংলাদেশ জাসদ এই সিদ্ধান্ত জানায়।

দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিকে প্রকারান্তরে ‘অস্বীকার’ করা হয়েছে সনদে। পাশাপাশি আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না—এমন অঙ্গীকারে তারা স্বাক্ষর করতে রাজি নয়।

শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগের দিনই তারা এই ঘোষণা দেয়।

এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে এখনো মতভেদ রয়ে গেছে।

‘কেন আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারছি না’—এ ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাতটি কারণ তুলে ধরে তারা জানায়—

১. জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনার সময়ই তারা বলেছিলেন, যেসব বিষয়ে সবার ঐকমত্য আছে শুধু সেসব বিষয়েই স্বাক্ষর নেওয়া যেতে পারে। ভিন্নমতগুলো অতিরিক্ত (এনেক্স) প্রতিবেদনে যুক্ত করা যেতে পারে।
২. সনদের পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের বিবরণ সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি; সংশোধনী প্রস্তাব দিলেও তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
৩. সনদের শেষ অংশে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার চাওয়া হয়েছে—যা ভিন্নমতের অবস্থায় তাদের কাছে অযৌক্তিক।
৪. অঙ্গীকারনামার ২ নম্বরে জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। তারা সর্বসম্মত সনদ সংবিধানে যুক্ত করার পক্ষে, কিন্তু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ তা করা তাদের বোধগম্য নয়।
৫. অঙ্গীকারনামার ৩ নম্বরে বলা হয়েছে, ‘জুলাই সনদ নিয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না’—যা মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থি।
৬. এছাড়াও সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন বিধানে ষষ্ঠ তফসিলে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’ এবং সপ্তম তফসিলে থাকা ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি, সেটা বাদ দিলে তো বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। অথচ জুলাই সনদ সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার কথা বলা হচ্ছে।
৭. অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা প্রাথমিক খসড়ায় থাকলেও চূড়ান্ত সনদ থেকে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

এসব কারণ ব্যাখ্যা করে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “এই সাতটি বিষয় নিষ্পত্তি না হওয়ায় আমাদের পক্ষে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, “সংবিধানের চার মূলনীতি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ—এবং ১৫০(২) অনুচ্ছেদের তফসিল পরিবর্তনের বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন করা যাবে না—এমন অঙ্গীকারে স্বাক্ষর দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

বাসদ (মার্কসবাদী)-এর সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, “দীর্ঘদিন আলোচনার পরও বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দেওয়া, মৌলিক অধিকারবিরোধী ধারা সংযোজন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়ার মতো বিষয় যুক্ত করে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে।”

সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “উনি (মুহাম্মদ ইউনূস) বলেছেন, সবকিছু হয়েছে ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ অনুযায়ী। এই সনদের মাধ্যমে এখন জাতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। মনে হয় ১৯৭১ সালকে ২০২৪ সাল দিয়ে মুছে দেওয়ার অংশ হিসেবেই এই সনদ তৈরি হয়েছে কি না, তা জনগণকেই ভেবে দেখতে হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন ও বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন।
সেখানে সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দনও উপস্থিত ছিলেন।