ঢাকা ০২:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে আরও ৩০ দেশের নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা খাঁচা থেকে বের হওয়া সিংহী আড়াই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী!

স্বর্ণের দাম দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যে বাংলাদেশেই কেন সর্বোচ্চ

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০১:২১:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
  • / 72

দোকানে সাজানো স্বর্ণ

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গত তিন বছর ধরে দেশের স্বর্ণবাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এই বৃদ্ধির ধারা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই প্রবণতা নতুন নয়—দুই দশকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০০ সালে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির দাম ছিল মাত্র ৬ হাজার ৯০০ টাকা। এক দশক পর ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা। ২০২০ সালে দাম ছুঁয়ে ফেলে প্রায় ৭০ হাজার টাকার ঘর, আর ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো তা এক লাখ টাকা অতিক্রম করে। বর্তমানে দামের মাত্রা পেরিয়েছে সোয়া দুই লাখ টাকার কাছাকাছি, যা দেশের স্বর্ণবাজারে এক ঐতিহাসিক রেকর্ড। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের এক ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা।

এর আগের দিন সোমবার (১৩ অক্টোবর) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির দাম ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৭১৯ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নতুন রেকর্ড গড়েছে সোনার বাজার। শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বর্তমানে স্বর্ণের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তর ছাড়িয়েছে। সোমবার (১৩ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে (১৪৫০ জিএমটি) স্পট মার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৯৯ দশমিক ৫৫ ডলার, কিছু সময়ের জন্য তা ছুঁয়ে ফেলে ৪ হাজার ১০৩ দশমিক ৫৮ ডলার।

কেন বাড়ছে দাম

বিশ্লেষকদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্থরতা, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্রমশ স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছেন। নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ায় এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারেও।

বাজারে প্রভাব

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান মনে করেন, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দাম আরও বাড়তে পারে। তার ভাষায়, “স্বর্ণের ভবিষ্যৎ মূল্য পুরোপুরি নির্ভর করছে বৈশ্বিক বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ মজুত নীতির ওপর। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়লে দেশের বাজারেও দাম বাড়া অস্বাভাবিক নয়।”

তবে এতে সাধারণ ক্রেতারা পড়েছেন বিপাকে। মাসুদুর রহমান বলেন, “সোনার দাম এখন অনেকের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক কারিগর বেকার হয়ে পড়ছেন।”

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের ঊর্ধ্বমুখী দামের প্রভাব কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও পড়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে স্বর্ণের দাম

স্বর্ণের এই ঊর্ধ্বগতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই প্রভাব ফেলেছে—বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে।

বাংলাদেশ: রেকর্ড দামে নতুন ইতিহাস

বাংলাদেশের বাজারে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সর্বশেষ ঘোষিত দামে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির দাম দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা। প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ১৮ হাজার ৫৪৭ টাকা। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলার সমান প্রায় ১২১ টাকা ৮০ পয়সা।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি—এই দুটি কারণেই দেশে স্বর্ণের দাম লাগাতার বাড়ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশের স্বর্ণ ব্যবসা এখন করপোরেট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করায় স্বর্ণের দাম বেপরোয়া হারে বেড়ে চলেছে, ফলে সাধারণ ক্রেতারা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণ কেনা এখন অনেক পরিবারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শখের বশে যারা আগে স্বর্ণ ব্যবহার করতেন, তারাও এখন তা কিনতে পারছেন না। এটি মূলত এক ধরনের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।”

তিনি আরও বলেন, “স্বর্ণের বাজার সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে পার্শ্ববর্তী দেশে স্বর্ণপাচারের অভিযোগ শোনা যেত, কিন্তু এখন আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো—দেশের অভ্যন্তরে করপোরেট ব্যবসায়ীরাই এই বাজারকে প্রভাবিত করছে।”

নাজের হোসাইন মনে করেন, স্বর্ণ ব্যবসায় এমনিতেই নানা ফাঁকফোকর ও অনিয়ম রয়েছে। তার সঙ্গে করপোরেট গ্রুপগুলোর প্রভাব যুক্ত হওয়ায় বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, “স্বর্ণ ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে সরকারের উচিত উপযুক্ত আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা। এতে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে এবং বাজারে স্বচ্ছতা আসবে।”

স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এখন এমন অবস্থা যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য স্বর্ণ কেনা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একসময় বিয়ে, উৎসব কিংবা সঞ্চয়ের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ কেনা ছিল পারিবারিক সংস্কৃতির অংশ—এখন তা বিলাসপণ্য হয়ে উঠেছে।

ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার এক জুয়েলার্স মালিক বলেন, “আগে প্রতিদিনই কেউ না কেউ গয়না বানাতে বা পুরোনো গয়না বদলাতে দোকানে আসতেন। এখন অনেকে শুধু দেখতে আসেন, কিনতে পারেন না। ক্রেতা কমেছে, কিন্তু দাম বাড়ছেই।”

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাঁতিবাজারের প্রবীণ স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ হালদার, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই পেশায় আছেন, স্মৃতিচারণ করে বলেন, “স্বাধীনতার আগে গিনি স্বর্ণের দাম ছিল ভরি মাত্র দেড়শ টাকা। তখনও মানুষ বলতো দাম বেশি। কিন্তু এখন তো অবস্থা আরও কঠিন হয়ে গেছে।”

ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের গুলশান শাখার ইনচার্জ সাগর সরকার জানান, সাধারণত স্বর্ণের দাম বাড়লে বিক্রি কিছুটা বাড়ে, কারণ মানুষ ধরে নেয় দাম আরও বাড়বে। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। “অনেক ক্রেতাই এখন আর স্বর্ণ কেনার সামর্থ্য রাখছেন না,” বলেন তিনি।

ভারতে তুলনামূলক দাম কিছুটা কম

ভারতের স্বর্ণবাজারেও দাম বেড়েছে, তবে বাংলাদেশ থেকে তা কিছুটা কম। মুম্বাই বাজারে বুধবার (১৫ অক্টোবর) ২৪ ক্যারেট সোনার প্রতি গ্রামের দাম দাঁড়িয়েছে ১২,৪৫৩ ভারতীয় টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,৯১৬ টাকা। ১ ভরি (১১.৬৬ গ্রাম) স্বর্ণের দাম প্রায় ১,৮৫,৫৮০ টাকা।

২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম কিছুটা কম—প্রতি গ্রাম প্রায় ১১,৮৬০ ভারতীয় টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫,৯০০–১৫,৯২০ টাকার মধ্যে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বিশাল স্বর্ণবাজারে দামের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি শুল্ক এবং উৎসব মৌসুমে চাহিদা বৃদ্ধি। ফলে ভারতের বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও বাংলাদেশে দাম বেশি।

পাকিস্তানে রুপির দরপতনে দ্বিগুণ দাম

পাকিস্তানে মুদ্রা রুপির তীব্র অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম ব্যাপক বেড়েছে। গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের ১ গ্রাম দাম ছিল ৩৬,৭৮৮ পাকিস্তানি টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,৮৭০ টাকা)। প্রতি ভরির দাম প্রায় ১,৮৫,০০০ টাকা। দুদিন বাজার বন্ধ থাকার পর সোমবার দাম আরও বেড়ে এক গ্রাম স্বর্ণ ৩৭,০২১ পাকিস্তানি টাকায় বিক্রি হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৫,৯০০ এবং প্রতি ভরিতে প্রায় ১,৮৫,৫০০ টাকা।

২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪,৫০০ টাকা প্রতি গ্রাম, ২১ ক্যারেটে প্রায় ১৩,৯০০ এবং ১৮ ক্যারেটে প্রায় ১২,০০০ টাকা।

শ্রীলঙ্কা: কিছুটা কম দাম, আস্থা এখনও বেশি

আইএমএফের সহায়তায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও কলম্বোর বাজারে স্বর্ণের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা কম। সোমবার (১৪ অক্টোবর) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার ৬২০ শ্রীলঙ্কান রুপিতে। দেশটিতে ১ ডলার সমান ৩০২ দশমিক ৮৫ রুপি। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে এক ভরি স্বর্ণের দাম প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ সংকট কাটিয়ে উঠলেও শ্রীলঙ্কাবাসীর কাছে স্বর্ণ এখনও নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতীক।

নেপালে স্বর্ণের দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল

নেপালে বর্তমানে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি গ্রাম প্রায় ১০,৮৯২ নেপালি রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯,৩৬৬ টাকা। এক ভরির দাম নেপালি রুপিতে প্রায় ১,২৬,৯০০—বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,০৯,১৫০ টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, উৎসব মৌসুম ও বিনিয়োগ প্রভাবিত করলেও নেপালের স্বর্ণবাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে।

ভুটান: ছোট বাজার, সচেতন ক্রেতা

ভুটানের মুদ্রা নুলট্রাম ভারতীয় রুপির সমমূল্যের হওয়ায় দেশটির স্বর্ণের দামও ভারতের সঙ্গে প্রায় সমান। থিম্পু বাজারে বর্তমানে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম ১০,৮৯৮ নুলট্রাম (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৪,৯০০)। প্রতি ভরিতে দাম প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৩ টাকা।

বাজার ছোট হলেও ভুটানে স্বর্ণ কেনাবেচা এখনও সংস্কৃতির অংশ, বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিয়ের সময়।

মালদ্বীপে পর্যটন আয়ের ভরসায় দামের স্থিতি

পর্যটননির্ভর দেশ মালদ্বীপেও স্বর্ণের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। রাজধানী মালেতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৮৫ মালদ্বিয়ান রুফিয়ায়। দেশটিতে ১ ডলার সমান ১৫ দশমিক ৪ রুফিয়া। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে এক ভরির দাম প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, পর্যটন থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে কিছুটা স্থিতিশীল রাখছে, যদিও বিশ্ববাজারের প্রভাব এখানেও স্পষ্ট।

বিনিময় হারই মূল নিয়ামক

বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণবাজারে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার। টাকার তুলনায় ভারতীয় রুপি কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও পাকিস্তানি রুপি ও শ্রীলঙ্কান রুপি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডলারের বিপরীতে মুদ্রার দরপতন আমদানি ব্যয় বাড়ায়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলে স্বর্ণের দামে।

বর্তমানে এক ডলারের বিনিময়মূল্য বাংলাদেশে প্রায় ১২১.৮০ টাকা, ভারতে ৮৭.৭৮ রুপি, পাকিস্তানে ২৮৩.৫৮ রুপি, নেপালে ১৪২.১১ রুপি, ভুটানে ৮৬.৫৮ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩০২ রুপি এবং মালদ্বীপে ১৫.৪১ রুফিয়া। ফলে মুদ্রার মানের পার্থক্য স্বর্ণ ক্রয়ের সক্ষমতাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা ও স্থানীয় মুদ্রার মান পরিবর্তনের কারণে স্বর্ণের দাম আরও অস্থির হতে পারে। উৎসব ও বিয়ের মৌসুমে চাহিদা বাড়া এবং বিনিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজার এখন শীর্ষে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “যেসব দেশে ডলার সংকট বা মুদ্রার অবমূল্যায়ন বেশি, সেখানে স্বর্ণের দামও তুলনামূলক বেশি। এটি এক ধরনের ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রতিফলন’।”

অর্থনীতিবিদদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণবাজারে এখন নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি, মুদ্রানীতি ও আন্তর্জাতিক প্রভাব ভিন্ন হলেও সামগ্রিক চিত্র একটাই—স্বর্ণ এখন আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি দামি ও চাহিদাসম্পন্ন।

বাংলাদেশে দাম সবচেয়ে বেশি হলেও বিনিয়োগকারীরা এটিকে বিলাসী ধাতু নয়, বরং নিরাপদ সম্পদ হিসেবে দেখছেন। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা যতদিন থাকবে, দক্ষিণ এশিয়ার বাজারেও স্বর্ণের এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা প্রবল।

নিউজটি শেয়ার করুন

স্বর্ণের দাম দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যে বাংলাদেশেই কেন সর্বোচ্চ

আপডেট সময় : ০১:২১:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

গত তিন বছর ধরে দেশের স্বর্ণবাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এই বৃদ্ধির ধারা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই প্রবণতা নতুন নয়—দুই দশকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০০ সালে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির দাম ছিল মাত্র ৬ হাজার ৯০০ টাকা। এক দশক পর ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা। ২০২০ সালে দাম ছুঁয়ে ফেলে প্রায় ৭০ হাজার টাকার ঘর, আর ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো তা এক লাখ টাকা অতিক্রম করে। বর্তমানে দামের মাত্রা পেরিয়েছে সোয়া দুই লাখ টাকার কাছাকাছি, যা দেশের স্বর্ণবাজারে এক ঐতিহাসিক রেকর্ড। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের এক ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা।

এর আগের দিন সোমবার (১৩ অক্টোবর) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির দাম ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৭১৯ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নতুন রেকর্ড গড়েছে সোনার বাজার। শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বর্তমানে স্বর্ণের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তর ছাড়িয়েছে। সোমবার (১৩ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে (১৪৫০ জিএমটি) স্পট মার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৯৯ দশমিক ৫৫ ডলার, কিছু সময়ের জন্য তা ছুঁয়ে ফেলে ৪ হাজার ১০৩ দশমিক ৫৮ ডলার।

কেন বাড়ছে দাম

বিশ্লেষকদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্থরতা, আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্রমশ স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছেন। নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ায় এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারেও।

বাজারে প্রভাব

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান মনে করেন, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দাম আরও বাড়তে পারে। তার ভাষায়, “স্বর্ণের ভবিষ্যৎ মূল্য পুরোপুরি নির্ভর করছে বৈশ্বিক বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ মজুত নীতির ওপর। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়লে দেশের বাজারেও দাম বাড়া অস্বাভাবিক নয়।”

তবে এতে সাধারণ ক্রেতারা পড়েছেন বিপাকে। মাসুদুর রহমান বলেন, “সোনার দাম এখন অনেকের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় অনেক কারিগর বেকার হয়ে পড়ছেন।”

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের ঊর্ধ্বমুখী দামের প্রভাব কেবল বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও পড়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে স্বর্ণের দাম

স্বর্ণের এই ঊর্ধ্বগতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই প্রভাব ফেলেছে—বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে।

বাংলাদেশ: রেকর্ড দামে নতুন ইতিহাস

বাংলাদেশের বাজারে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে স্বর্ণ। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সর্বশেষ ঘোষিত দামে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি ভরির দাম দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা। প্রতি গ্রাম স্বর্ণের দাম ১৮ হাজার ৫৪৭ টাকা। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলার সমান প্রায় ১২১ টাকা ৮০ পয়সা।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি—এই দুটি কারণেই দেশে স্বর্ণের দাম লাগাতার বাড়ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশের স্বর্ণ ব্যবসা এখন করপোরেট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করায় স্বর্ণের দাম বেপরোয়া হারে বেড়ে চলেছে, ফলে সাধারণ ক্রেতারা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণ কেনা এখন অনেক পরিবারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শখের বশে যারা আগে স্বর্ণ ব্যবহার করতেন, তারাও এখন তা কিনতে পারছেন না। এটি মূলত এক ধরনের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।”

তিনি আরও বলেন, “স্বর্ণের বাজার সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে পার্শ্ববর্তী দেশে স্বর্ণপাচারের অভিযোগ শোনা যেত, কিন্তু এখন আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো—দেশের অভ্যন্তরে করপোরেট ব্যবসায়ীরাই এই বাজারকে প্রভাবিত করছে।”

নাজের হোসাইন মনে করেন, স্বর্ণ ব্যবসায় এমনিতেই নানা ফাঁকফোকর ও অনিয়ম রয়েছে। তার সঙ্গে করপোরেট গ্রুপগুলোর প্রভাব যুক্ত হওয়ায় বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, “স্বর্ণ ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে সরকারের উচিত উপযুক্ত আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা। এতে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে এবং বাজারে স্বচ্ছতা আসবে।”

স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এখন এমন অবস্থা যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য স্বর্ণ কেনা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একসময় বিয়ে, উৎসব কিংবা সঞ্চয়ের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ কেনা ছিল পারিবারিক সংস্কৃতির অংশ—এখন তা বিলাসপণ্য হয়ে উঠেছে।

ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার এক জুয়েলার্স মালিক বলেন, “আগে প্রতিদিনই কেউ না কেউ গয়না বানাতে বা পুরোনো গয়না বদলাতে দোকানে আসতেন। এখন অনেকে শুধু দেখতে আসেন, কিনতে পারেন না। ক্রেতা কমেছে, কিন্তু দাম বাড়ছেই।”

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাঁতিবাজারের প্রবীণ স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ হালদার, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই পেশায় আছেন, স্মৃতিচারণ করে বলেন, “স্বাধীনতার আগে গিনি স্বর্ণের দাম ছিল ভরি মাত্র দেড়শ টাকা। তখনও মানুষ বলতো দাম বেশি। কিন্তু এখন তো অবস্থা আরও কঠিন হয়ে গেছে।”

ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের গুলশান শাখার ইনচার্জ সাগর সরকার জানান, সাধারণত স্বর্ণের দাম বাড়লে বিক্রি কিছুটা বাড়ে, কারণ মানুষ ধরে নেয় দাম আরও বাড়বে। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। “অনেক ক্রেতাই এখন আর স্বর্ণ কেনার সামর্থ্য রাখছেন না,” বলেন তিনি।

ভারতে তুলনামূলক দাম কিছুটা কম

ভারতের স্বর্ণবাজারেও দাম বেড়েছে, তবে বাংলাদেশ থেকে তা কিছুটা কম। মুম্বাই বাজারে বুধবার (১৫ অক্টোবর) ২৪ ক্যারেট সোনার প্রতি গ্রামের দাম দাঁড়িয়েছে ১২,৪৫৩ ভারতীয় টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,৯১৬ টাকা। ১ ভরি (১১.৬৬ গ্রাম) স্বর্ণের দাম প্রায় ১,৮৫,৫৮০ টাকা।

২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম কিছুটা কম—প্রতি গ্রাম প্রায় ১১,৮৬০ ভারতীয় টাকা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫,৯০০–১৫,৯২০ টাকার মধ্যে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের বিশাল স্বর্ণবাজারে দামের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি শুল্ক এবং উৎসব মৌসুমে চাহিদা বৃদ্ধি। ফলে ভারতের বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও বাংলাদেশে দাম বেশি।

পাকিস্তানে রুপির দরপতনে দ্বিগুণ দাম

পাকিস্তানে মুদ্রা রুপির তীব্র অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দাম ব্যাপক বেড়েছে। গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের ১ গ্রাম দাম ছিল ৩৬,৭৮৮ পাকিস্তানি টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫,৮৭০ টাকা)। প্রতি ভরির দাম প্রায় ১,৮৫,০০০ টাকা। দুদিন বাজার বন্ধ থাকার পর সোমবার দাম আরও বেড়ে এক গ্রাম স্বর্ণ ৩৭,০২১ পাকিস্তানি টাকায় বিক্রি হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৫,৯০০ এবং প্রতি ভরিতে প্রায় ১,৮৫,৫০০ টাকা।

২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪,৫০০ টাকা প্রতি গ্রাম, ২১ ক্যারেটে প্রায় ১৩,৯০০ এবং ১৮ ক্যারেটে প্রায় ১২,০০০ টাকা।

শ্রীলঙ্কা: কিছুটা কম দাম, আস্থা এখনও বেশি

আইএমএফের সহায়তায় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও কলম্বোর বাজারে স্বর্ণের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কিছুটা কম। সোমবার (১৪ অক্টোবর) ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার ৬২০ শ্রীলঙ্কান রুপিতে। দেশটিতে ১ ডলার সমান ৩০২ দশমিক ৮৫ রুপি। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে এক ভরি স্বর্ণের দাম প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ সংকট কাটিয়ে উঠলেও শ্রীলঙ্কাবাসীর কাছে স্বর্ণ এখনও নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতীক।

নেপালে স্বর্ণের দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল

নেপালে বর্তমানে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি গ্রাম প্রায় ১০,৮৯২ নেপালি রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯,৩৬৬ টাকা। এক ভরির দাম নেপালি রুপিতে প্রায় ১,২৬,৯০০—বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,০৯,১৫০ টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, উৎসব মৌসুম ও বিনিয়োগ প্রভাবিত করলেও নেপালের স্বর্ণবাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে।

ভুটান: ছোট বাজার, সচেতন ক্রেতা

ভুটানের মুদ্রা নুলট্রাম ভারতীয় রুপির সমমূল্যের হওয়ায় দেশটির স্বর্ণের দামও ভারতের সঙ্গে প্রায় সমান। থিম্পু বাজারে বর্তমানে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম ১০,৮৯৮ নুলট্রাম (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৪,৯০০)। প্রতি ভরিতে দাম প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৩ টাকা।

বাজার ছোট হলেও ভুটানে স্বর্ণ কেনাবেচা এখনও সংস্কৃতির অংশ, বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিয়ের সময়।

মালদ্বীপে পর্যটন আয়ের ভরসায় দামের স্থিতি

পর্যটননির্ভর দেশ মালদ্বীপেও স্বর্ণের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। রাজধানী মালেতে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি গ্রাম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮৮৫ মালদ্বিয়ান রুফিয়ায়। দেশটিতে ১ ডলার সমান ১৫ দশমিক ৪ রুফিয়া। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে এক ভরির দাম প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, পর্যটন থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে কিছুটা স্থিতিশীল রাখছে, যদিও বিশ্ববাজারের প্রভাব এখানেও স্পষ্ট।

বিনিময় হারই মূল নিয়ামক

বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণবাজারে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার। টাকার তুলনায় ভারতীয় রুপি কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও পাকিস্তানি রুপি ও শ্রীলঙ্কান রুপি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ডলারের বিপরীতে মুদ্রার দরপতন আমদানি ব্যয় বাড়ায়, যা সরাসরি প্রভাব ফেলে স্বর্ণের দামে।

বর্তমানে এক ডলারের বিনিময়মূল্য বাংলাদেশে প্রায় ১২১.৮০ টাকা, ভারতে ৮৭.৭৮ রুপি, পাকিস্তানে ২৮৩.৫৮ রুপি, নেপালে ১৪২.১১ রুপি, ভুটানে ৮৬.৫৮ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৩০২ রুপি এবং মালদ্বীপে ১৫.৪১ রুফিয়া। ফলে মুদ্রার মানের পার্থক্য স্বর্ণ ক্রয়ের সক্ষমতাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা ও স্থানীয় মুদ্রার মান পরিবর্তনের কারণে স্বর্ণের দাম আরও অস্থির হতে পারে। উৎসব ও বিয়ের মৌসুমে চাহিদা বাড়া এবং বিনিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজার এখন শীর্ষে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “যেসব দেশে ডলার সংকট বা মুদ্রার অবমূল্যায়ন বেশি, সেখানে স্বর্ণের দামও তুলনামূলক বেশি। এটি এক ধরনের ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রতিফলন’।”

অর্থনীতিবিদদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার স্বর্ণবাজারে এখন নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি, মুদ্রানীতি ও আন্তর্জাতিক প্রভাব ভিন্ন হলেও সামগ্রিক চিত্র একটাই—স্বর্ণ এখন আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি দামি ও চাহিদাসম্পন্ন।

বাংলাদেশে দাম সবচেয়ে বেশি হলেও বিনিয়োগকারীরা এটিকে বিলাসী ধাতু নয়, বরং নিরাপদ সম্পদ হিসেবে দেখছেন। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা যতদিন থাকবে, দক্ষিণ এশিয়ার বাজারেও স্বর্ণের এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা প্রবল।