হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মাধ্যমে নতুন দমন–পীড়ন শুরু
- আপডেট সময় : ০৬:০৯:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫
- / 105
বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের গ্রেপ্তারে সম্প্রতি সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ব্যবহার বাড়ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই আইনকে নতুন দমন–পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার দলগুলোর উচিত নির্বিচারে আটক ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক মুক্তির দাবি জানানো এবং মানবাধিকার সুরক্ষা ও রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে সরকারকে উৎসাহিত করা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানা তিন সপ্তাহের বিক্ষোভে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। ওই আন্দোলনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন। এরপর ২০২৫ সালের ১২ মে সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে অন্তর্বর্তী সরকার সাময়িকভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করে। দলটির পক্ষে যেকোনো সভা, প্রকাশনা বা অনলাইন মন্তব্যও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও শান্তিপূর্ণ অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তারে এই আইন প্রয়োগ হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে পুরে দেওয়া হোক কিংবা শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশে বাধা—অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করা উচিত নয়, যা শেখ হাসিনার সরকারের সময়ও দেখা গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের উচিত সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তারের ঘটনায় জরুরি হস্তক্ষেপ করা।”
সংস্থাটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধেই শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেকে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন—যা শেখ হাসিনার আমলের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হচ্ছে।
গত ২৮ আগস্ট ঢাকায় ‘মঞ্চ ৭১’ আয়োজিত এক আলোচনাসভা থেকে সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদসহ ১৬ জনকে আটক করে পুলিশ। সভাটি ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি হামলা চালানোর পর পুলিশ হামলাকারীদের নয়, বরং সভায় অংশগ্রহণকারী ১৬ জনকেই আটক করে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সী কয়েকজনও ছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান এবং সাবেক মন্ত্রী (এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত) আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।
শুরুতে পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে আটক করা হয়েছে বলে জানালেও পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একই মামলায় পরে আরও দুজনকে আটক করা হয়। পুলিশের অভিযোগ—তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিয়েছেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর জামিন শুনানির সময় সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাকে হেলমেট, হাতকড়া ও বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিয়ে আদালতে আনা হয়। ওই সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আরেক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালান।
একজন আটক ব্যক্তির পরিবারের সদস্য এইচআরডব্লিউকে বলেন, “এটি তো কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ছিল না, কেবল একটি আলোচনা সভা। তাহলে এটিকে কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলা যায়?”
তিনি আরও বলেন, “যাঁরা হামলা চালিয়েছে, তারা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু অংশগ্রহণকারীরা কারাগারে। এই সরকারও ক্রমে আগের সরকারের মতো আচরণ করছে।”
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়। কর্মকর্তাদের দাবি, ক্ষমতায় থাকাকালে এ আইনের অপব্যবহারের জন্য আওয়ামী লীগের সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনতেই ২০২৫ সালে এর সংশোধন প্রয়োজন হয়েছিল।
তবে এইচআরডব্লিউ সতর্ক করেছে—শান্তিপূর্ণ বক্তব্য ও সমাবেশের অধিকার দমন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থী। বাংলাদেশ এডিটরস কাউন্সিলও বলেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সাম্প্রতিক সংশোধন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক হুমকি হতে পারে।
অন্যদিকে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, সরকার রক্ষণশীল মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছে। এসব গোষ্ঠী নিজেদের দাবি আদায়ে সহিংসতা অবলম্বন করছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলায় অন্তত ১৫২ জন নিহত হয়েছেন।
একজন রাজনৈতিক কর্মী এইচআরডব্লিউকে বলেন, “এখন মনে হচ্ছে, হয় সন্ত্রাসী হিসেবে কারাগারে যেতে হবে, নয়তো জনতার হামলায় মরতে হবে। আমি বলছি না যে অপরাধীদের শাস্তি হওয়া উচিত নয়, তবে তা হতে হবে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে—যা ইউনূস সরকার দিতে পারেনি।”
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তিন বছরের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় ঢাকায় মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচারের জন্য একটি মিশন কাজ করবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্ক বলেন, “এই মিশন বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিশ্রুতির প্রতীক, যা পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।”
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের উচিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার বন্ধ করা। আইনটি যেন রাজনৈতিক দমন-পীড়নের প্রতীক না হয়ে ওঠে। এখন সরকারের প্রধান মনোযোগ হওয়া উচিত নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন।”


















