প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীর বড় তালিকা নিয়ে প্রশ্ন
- আপডেট সময় : ১১:৫৮:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 189
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে নিউইয়র্কে আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারি নথি অনুযায়ী, নিরাপত্তা টিম ও কর্মকর্তাসহ এবার তাঁর সফরসঙ্গীর সংখ্যা ১০৪ জন। তবে সফর–সংক্রান্ত পুস্তিকায় এই সংখ্যা ৬২। সফরসঙ্গীদের মধ্যে উপদেষ্টাদের পাশাপাশি তিনটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন নেতাও রয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আছেন—বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সদস্য মোহাম্মদ নকিবুর রহমান (যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্ত হয়েছেন), জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন এবং জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা।
আগের রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় সাধারণত সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মী ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা এমন সফরে অংশ নিতেন। এবার অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সফরসঙ্গী করেছে। তবে বড় তালিকার কারণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সহ বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলেছে—নির্দলীয় সরকারও কি রাজনৈতিক সরকারের পুরোনো ধারা অনুসরণ করছে?
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সরকারপ্রধানের নির্ধারিত বক্তৃতার সময় সফরসঙ্গীদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের উপস্থিতির সুযোগ থাকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অতীতে রাজনৈতিক সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীর সংখ্যা প্রায়ই ১৫০ থেকে ২০০ জন হতো। ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন, আর ২০১৯ সালে ছিলেন ২৯২ জন। তবে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৭–০৮) সময় সফরসঙ্গীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল।
প্রথমবার মাত্র ৭ জনের কথা বলা হয়েছিল
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গীর সংখ্যা মাত্র ৭ জন বলে জানানো হয়। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর কন্যা। তবে পরে জানা যায়, প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৫৭। সেই সময় নিউইয়র্ক যাত্রার আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যয় সংকোচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে নিরাপত্তাজনিত কিছু বিষয় আছে, যেগুলো এড়ানো সম্ভব নয়।”
গত বছর সরকারি নথি অনুযায়ী সফরসঙ্গীর সংখ্যা ছিল ৮০-এর বেশি, আর পুস্তিকায় উল্লেখ ছিল ৫৭ জন। এবার নথি অনুযায়ী ১০৪ আর পুস্তিকায় ৬২। সাধারণত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারপ্রধানের সফরের জন্য আলাদা নথি ও পুস্তিকা দুটোই তৈরি করে।
দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সভায় যোগ দিতে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের বিদেশ সফরে বড় বহর নেওয়ার সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের। এবারও বড় তালিকা থাকা সত্ত্বেও নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে রাজনৈতিক নেতারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এর দায় এড়াতে পারবে না বলে মনে করছেন অনেকেই।
সফরসঙ্গী কারা?
৮০তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে পুস্তিকায় সফরসঙ্গীর সংখ্যা ৬২, আর সরকারি নথি অনুযায়ী ১০৪। উভয় তালিকায় আছেন চার উপদেষ্টা—আসিফ নজরুল, মো. তৌহিদ হোসেন, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও আদিলুর রহমান খান। উপদেষ্টা পদমর্যাদার আরও দুইজন আছেন—আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। এছাড়া প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার একজন, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনও আছেন সফরে।
এ ছাড়া, অন্যান্যের মধ্যে ড. ইউনূসের দুই কন্যা, আলোচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলমও রয়েছেন এবারের সফরে।
সরকারি নথি অনুযায়ী, এবার প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের মধ্যে নিরাপত্তা কর্মকর্তা আছেন ১৯ জন এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা ৪৭ জন।
টিআইবির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের চর্চা অনুসরণ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বিশালসংখ্যক প্রতিনিধি প্রেরণকারী ব্যতিক্রমী দেশের তালিকাভুক্ত হওয়ার বিব্রতকর রেকর্ড অব্যাহত রাখায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। শতাধিক প্রতিনিধিসহ চলতি অধিবেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী বার্তা দিলো? এর বিনিময়ে দেশ ও জনগণ তথা করদাতাগণের কোনো সুফল পাওয়ার সম্ভাবনাই বা কতটুকু? এই প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ‘‘পতিত কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনসহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক ফোরামে বিশাল আকারের প্রতিনিধিদল প্রেরণ স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হয়, যা সংখ্যার বিচারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুইশতাধিক পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। আমরা আশা করেছিলাম ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিনির্ভর সুশাসনসহ রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকার এ ধরনের চর্চা পরিহার করবে। দুঃখজনকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার একই পথ অনুসরণ করলো। পরিতাপের বিষয় দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারকর্তৃক অহেতুক বিদেশ সফরের মাধ্যমে জনগণের অর্থের অপচায় বন্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশনাসহ যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে, শতাধিক প্রতিনিধির ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণের স্ববিরোধী এ ঘটনার মাধ্যমে সরকার নিজেই তার অবস্থান সম্পর্কে আস্থাহীনতা তৈরি করলো।’
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তির দেশগুলো জাতিসংঘে তাদের বহুমাত্রিক প্রভাববলয় বজায় রাখার কূটনৈতিক ভূমিকা নিশ্চিতে তুলনামূলক বড় দল পাঠায়, তা-ও শতাধিক হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। অন্যদিকে নাইজেরিয়ার মতো কিছু সুশাসনবর্জিত দেশের বড় প্রতিনিধিদল পাঠানোর প্রবণতার পেছনে কূটনীতির নামে ‘‘ভ্রমণবিলাস’’ ছাড়া অন্যকোনো যুক্তি পাওয়া যায় না উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলছেন, ‘গতবছর সাধারণ অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকার ৫৭ জনের প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে জনগণের অর্থের অপচয় পরিহারের সম্ভাবনার সূচনা করেছিলো ভেবে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম যে, এ বছর হয়তো সংখ্যাটি আরও কমতে পারে। অথচ এবার পশ্চাৎ-মুখী হয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনামলের বিব্রতকর চর্চার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। জনগণের করের টাকায় বিশালসংখ্যক প্রতিনিধি প্রেরণের খরচের পাশাপাশি বর্হিবিশ্বের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মূল্য বিবেচনায় প্রতিনিধিদের কার কী ভূমিকা তা নির্ধারণ সাপেক্ষে দলটি গঠিত হয়েছে কী? অধিবেশনের আলোচ্য বিষয়বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অর্থবহ অংশগ্রহণ এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় প্রতিনিধিদলের সম্মানিত সদস্যগণ কোন পরিমণ্ডলে, কী ভূমিকা পালন করবেন, এসব কতটুকু বিবেচিত হয়েছে? এ ধরনের প্রশ্নের জবাব জনগণ পাবে কী? এ ব্যাপারে রাষ্ট্রসংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা উচিত।’
গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এ জাতীয় প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টান্ত বিব্রতকর ও হতাশাজনক মনে করে টিআইবি।




















