ঢাকা ০৬:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাস: রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র, ফের অনিশ্চয়তা

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ১০:১৯:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / 177

নেপালি কংগ্রেস পার্টি কার্যালয়ে আগুন

অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের মুখে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। ফলে হিমালয়ের এই দেশ আবারও নতুন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়ল। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত নেপালে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। তবে কোনও সরকারই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেনি।

১৯৫১: রানা শাসনের পতন

১৯৫১ সালের আগে নেপালে রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতাবান। রানা বংশীয় শাসকেরা বংশানুক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদ দখলে রাখতেন। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের চাপেই সে শাসন ভেঙে পড়ে। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা।

১৯৬১–১৯৯০: ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা

১৯৬১ সালে রাজা মহেন্দ্র সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে ‘পঞ্চায়েত’ নামে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এতে রাজতন্ত্র আবারও পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পায়। তবে ক্রমে জনঅসন্তোষ বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ‘জনআন্দোলন’ নামে পরিচিত সেই বিক্ষোভে বাধ্য হয়ে রাজা বিরেন্দ্র দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন।

১৯৯৬: মাওবাদী বিদ্রোহ

১৯৯৬ সালে নেপালের বামপন্থী মাওবাদীরা রাজতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। টানা দশ বছরের সেই গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারায় ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ, যা নেপালের রাজনীতিতে গভীর ক্ষত তৈরি করে।

২০০৬–২০১৫: রাজতন্ত্রের অবসান ও নতুন সংবিধান

২০০৬ সালে ফের রাজতন্ত্রবিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়। তীব্র জনচাপ ও রাজনৈতিক চাপে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। নেপাল রূপ নেয় ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে। শেষ রাজা গিয়ানেন্দ্র বর্তমানে কাঠমান্ডুতেই সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করছেন।

২০১৫ সালে দেশটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। এর মাধ্যমে নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রবেশ করে। তবে একই সঙ্গে জাতিগত বৈষম্য, ক্ষমতা ভাগাভাগি ও কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্ক নিয়ে নতুন দ্বন্দ্বও শুরু হয়।

২০১৫–বর্তমান: ওলি সরকারের উত্থান-পতন

কেপি শর্মা ওলি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন ২০১৫ সালের অক্টোবরে, যদিও তার মেয়াদ স্থায়ী হয় মাত্র এক বছর। পরবর্তীতে ২০১৮ ও ২০২১ সালে টানা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ২০২৪ সালে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।

চীনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ওলি তার প্রথম মেয়াদেই ভারতের বিরোধিতা করেন এবং সীমান্ত মানচিত্র পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে বিতর্কে জড়ান। তবে তার পুরো শাসনামল জুড়ে দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদ ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার অভিযোগ ছিল প্রবল। সর্বশেষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে ঘিরে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটার পর মঙ্গলবার তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

অস্থিরতার ধারাবাহিকতা

নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করে দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘূর্ণাবর্তে বন্দি। রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের পরও একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। একের পর এক সরকার পরিবর্তন, নেতাদের প্রতি জনঅবিশ্বাস আর তরুণদের ক্ষোভ—সব মিলিয়েই দেশকে বারবার অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে।

ওলির পদত্যাগের পর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—নেপাল কি অবশেষে টেকসই কোনো রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাবে, নাকি আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে?

সূত্র: রয়টার্স

নিউজটি শেয়ার করুন

নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতিহাস: রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র, ফের অনিশ্চয়তা

আপডেট সময় : ১০:১৯:৪২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভের মুখে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) পদত্যাগ করেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। ফলে হিমালয়ের এই দেশ আবারও নতুন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়ল। ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত নেপালে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। তবে কোনও সরকারই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে পারেনি।

১৯৫১: রানা শাসনের পতন

১৯৫১ সালের আগে নেপালে রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতাবান। রানা বংশীয় শাসকেরা বংশানুক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পদ দখলে রাখতেন। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের চাপেই সে শাসন ভেঙে পড়ে। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা।

১৯৬১–১৯৯০: ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা

১৯৬১ সালে রাজা মহেন্দ্র সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে ‘পঞ্চায়েত’ নামে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এতে রাজতন্ত্র আবারও পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পায়। তবে ক্রমে জনঅসন্তোষ বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ‘জনআন্দোলন’ নামে পরিচিত সেই বিক্ষোভে বাধ্য হয়ে রাজা বিরেন্দ্র দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন।

১৯৯৬: মাওবাদী বিদ্রোহ

১৯৯৬ সালে নেপালের বামপন্থী মাওবাদীরা রাজতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। টানা দশ বছরের সেই গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারায় ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ, যা নেপালের রাজনীতিতে গভীর ক্ষত তৈরি করে।

২০০৬–২০১৫: রাজতন্ত্রের অবসান ও নতুন সংবিধান

২০০৬ সালে ফের রাজতন্ত্রবিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়। তীব্র জনচাপ ও রাজনৈতিক চাপে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। নেপাল রূপ নেয় ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে। শেষ রাজা গিয়ানেন্দ্র বর্তমানে কাঠমান্ডুতেই সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করছেন।

২০১৫ সালে দেশটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। এর মাধ্যমে নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রবেশ করে। তবে একই সঙ্গে জাতিগত বৈষম্য, ক্ষমতা ভাগাভাগি ও কেন্দ্র-প্রদেশ সম্পর্ক নিয়ে নতুন দ্বন্দ্বও শুরু হয়।

২০১৫–বর্তমান: ওলি সরকারের উত্থান-পতন

কেপি শর্মা ওলি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন ২০১৫ সালের অক্টোবরে, যদিও তার মেয়াদ স্থায়ী হয় মাত্র এক বছর। পরবর্তীতে ২০১৮ ও ২০২১ সালে টানা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ২০২৪ সালে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।

চীনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ওলি তার প্রথম মেয়াদেই ভারতের বিরোধিতা করেন এবং সীমান্ত মানচিত্র পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে বিতর্কে জড়ান। তবে তার পুরো শাসনামল জুড়ে দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদ ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার অভিযোগ ছিল প্রবল। সর্বশেষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে ঘিরে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটার পর মঙ্গলবার তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

অস্থিরতার ধারাবাহিকতা

নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করে দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘূর্ণাবর্তে বন্দি। রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের পরও একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। একের পর এক সরকার পরিবর্তন, নেতাদের প্রতি জনঅবিশ্বাস আর তরুণদের ক্ষোভ—সব মিলিয়েই দেশকে বারবার অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিচ্ছে।

ওলির পদত্যাগের পর প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—নেপাল কি অবশেষে টেকসই কোনো রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাবে, নাকি আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে?

সূত্র: রয়টার্স