হাতে হাত, মুখে হাসি—কী বার্তা দিচ্ছেন শি, পুতিন, মোদী?
- আপডেট সময় : ০৪:৫১:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 143
ভ্লাদিমির পুতিন হাত ধরে শি জিনপিংয়ের কাছে নিয়ে এলেন নরেন্দ্র মোদীকে; শির কাঁধে হাত রেখে কিছু বললেন পুতিন। তাতে হেসে উঠলেন মোদী, সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল শির মুখেও।
পরক্ষণেই আঙুল তুলে কিছু বললেন মোদী। তার উত্তরে সম্মতির ভঙ্গিতে নিজের মুষ্টিতে হাত জড়ালেন পুতিন। এরপর পুতিনকে কিছু বোঝাতে বোঝাতে সামনে এগোতে থাকলেন মোদী, সেই দৃশ্য নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন শেহবাজ শরিফ।
রবিবার (৩১ আগস্ট) চীনের বন্দরনগরী তিয়ানজিনে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে চীন, রাশিয়া ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণের এই মুহূর্ত চলমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট স্পষ্ট করে তুলেছে।
চীনের এই সম্মেলন আয়োজন দেখে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো শঙ্কার সুরে বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি আসলে দেশগুলোকে চীনের প্রভাববলয়ে ঠেলে দিচ্ছে। সেই সুযোগে বিশ্বে নিয়ন্ত্রণকারীর অবস্থান দৃঢ় করতে চাইছে বেইজিং।
গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট পদে ফেরার তিন মাসের মাথায় ট্রাম্প বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেন, যা বিশ্বের প্রায় সব দেশের বিরাগ ডেকে আনে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া আগে থেকেই নানা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত। এর ওপর চীনা পণ্যে বড় অঙ্কের শুল্ক বসিয়েছেন ট্রাম্প। এমনকি রাশিয়া থেকে তেল কেনায় ভারতের ওপরও আরোপ করেছেন ৫০ শতাংশ শুল্ক।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মোদী তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ট্রাম্পের ফোন ধরছেন না—এমন খবরও ছড়িয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে আগের এসসিও সম্মেলন এড়িয়ে গেলেও এবার তিয়ানজিনে যোগ দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
সাত বছর পর চীন সফরে গিয়ে শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের ছবি শেয়ার করে মোদী এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, “তিয়ানজিনে পারস্পরিক যোগাযোগ অব্যাহত! এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে মতবিনিময়।”
পুতিন, শি ও মোদীর এবারের উপস্থিতি ২০১৮ সালের ব্রিকস সম্মেলনের ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়।
সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী চীনের প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে বৈরী সম্পর্ক পেরিয়ে সহযোগিতা জোরদারের অঙ্গীকার করেন তারা।
২০২০ সালের গালওয়ান সীমান্তে সংঘর্ষের পর থেকে দিল্লি-বেইজিং সম্পর্ক নাজুক হয়ে পড়ে। এর পর আর চীন সফরে যাননি মোদী।
সম্মেলনে ভাষণে মোদী দ্বিমুখী নীতির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গ তোলেন। তা পাকিস্তানকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে—এটা স্পষ্ট। এর পর এসসিও পহেলগামে এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানায় বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম।
ভারতের সংবাদমাধ্যমে সেই ছবি ও ভিডিও বড় করে প্রচার হচ্ছে, যেখানে মঞ্চে মোদী পুতিনকে নিয়ে এগোচ্ছেন আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ নিশ্চল দাঁড়িয়ে তা দেখছেন।
তবে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে এসব জায়গা পায়নি। বরং গুরুত্ব পেয়েছে শেহবাজের ভাষণ, যেখানে তিনি বলেন—জোটের সব দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা জরুরি।
চীনের মিত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল সংযত। পহেলগাম প্রসঙ্গ টেনে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ইঙ্গিত দিয়ে শেহবাজ বলেন, তাঁর দেশ সব সময় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী।
সম্মেলনে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের সমালোচনার জবাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, পশ্চিমারা কিয়েভকে ন্যাটোতে নেওয়ার প্ররোচনাই এই সংকট ডেকে এনেছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে পুতিন আরও বলেন, ২০১৪ সালে ইউক্রেনে অভ্যুত্থানের নেপথ্যে পশ্চিমাদের হাত ছিল। এরপর তারা ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যেতে উসকানি দিয়েছে।
তিয়ানজিনের এসসিও সম্মেলনের দিকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম আগেই নজর রেখেছিল। চীনেও গেছেন অনেক সাংবাদিক। তাঁদের একজন সিএনএনের ইভান ওয়াটসন লিখেছেন, কীভাবে ট্রাম্পের নীতি বহু দেশকে চীনের বলয়ে ঠেলে দিচ্ছে।
মোদীর একটি পোস্টও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ ছড়াচ্ছে, যেখানে তিনি পুতিনের সঙ্গে ছবি দিয়ে লিখেছেন, “তার সঙ্গে দেখা করা সব সময়ই আনন্দের।”
ট্রাম্পের শুল্কনীতিকে কাজে লাগিয়ে শি যে বিশ্বমঞ্চে চীনের প্রভাব বাড়াতে চাইছেন—বিশ্লেষকরা আগেই সে কথা বলেছিলেন।
২০০১ সালে চীন, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানকে নিয়ে গঠিত এসসিও মূলত আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতা থেকে যাত্রা শুরু করলেও, পরে এর পরিধি বেড়েছে।
এবারের সম্মেলনে চীন, রাশিয়া ও ভারতের পাশাপাশি ইরান, পাকিস্তান, বেলারুশসহ ১৬টি সদস্য দেশের নেতারা উপস্থিত। পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নিয়েছে কম্বোডিয়া, মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, কুয়েত এবং ন্যাটো সদস্য তুরস্ক।
বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও এতগুলো দেশকে একত্রিত করতে পারায় প্রেসিডেন্ট শির কূটনৈতিক দক্ষতার প্রশংসা করছেন অনেকে।
তারা বলছেন, শির বক্তব্যেই তা প্রতিফলিত হয়েছে; কারণ তিনি স্পষ্ট করেছেন—যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলা করাই তাদের ঐক্যের মূল লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের নাম না নিয়েই উদ্বোধনী ভাষণে শি এককেন্দ্রিক বিশ্বের হুমকিমূলক আচরণের সমালোচনা করেন। তিনি স্নায়ুযুদ্ধের ধাঁচের প্রতিযোগিতা ও জোটগত সংঘাতের বিরোধিতা করে ন্যায় ও ন্যায্যতার পক্ষে অটল থাকার আহ্বান জানান।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, সিনহুয়া, তাস, এনডিটিভি, ডন


















