জাপা অফিসে ফের হামলা, নুরের আহত হওয়া নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি
৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে
- আপডেট সময় : ১১:৪০:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৫
- / 217
ঢাকায় জাতীয় পার্টির (জাপা) কার্যালয়ের সামনে শুক্রবার রাতের সহিংস ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কড়া পুলিশ প্রহরার মধ্যে ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে আবারও হামলার ঘটনা ঘটেছে। একদল বিক্ষোভকারী এই হামলা চালায়। তারা ভবনটির নিচতলায় আগুন দেয়। পরে পুলিশ জলকামান ব্যবহার ও লাঠিপেটা করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। জলকামান দিয়ে পুলিশ আগুন নিভিয়ে ফেলে।
শনিবার (৩০ আগস্ট) সন্ধ্যার দিকে দ্বিতীয় দিনের হামলার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। হামলার সময় বিক্ষোভকারীরা ভবনের সামনে টানানো জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের ছবি ভাঙচুর করে।
কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে ওই ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকালে ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন–এর রিপোর্টার নাইমুর রহমান (২৫) ও বাংলানিউজের ফটোসাংবাদিক জিএম মজিবর (৪৫)। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
কার্যালয়ের সামনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন আছে। এই হামলার জন্য জাপা গণঅধিকার পরিষদকে দায়ি করেছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী অভিযোগ করেছেন, গণঅধিকার পরিষদের লোকজন এই হামলা চালিয়েছে। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আজও আমাদের পার্টির কাকরাইল অফিসে আগুন দেওয়া হলো। ভাঙচুরের চেষ্টা করা হলো। আমরা মনে করি, এর মাধ্যমে দেশকে বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা হচ্ছে। জাতীয় পার্টিকে ভিকটিম করা হচ্ছে। জাতীয় পার্টিকে টার্গেট করা হচ্ছে। এটা অবশ্যই দুঃখজনক।’
জাপা’র পক্ষ থেকে রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, “শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন লাগিয়েছে সন্ত্রাসীরা। গতকালও কয়েক দফা সন্ত্রাসী হামলা এবং মশাল মিছিল নিয়ে আগুন দিতে চেয়েছিলো তারা।”
জাতীয় পার্টির অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে গণ-অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, “আমরা আমাদের বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পুরানা পল্টন, প্রেসক্লাব, মৎস্য ভবন, নয়া পল্টন হয়ে আমাদের দলীয় কার্যালয় গিয়ে শেষ করেছি। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। আমাদের মিছিল থেকে কোনো হামলা চালানো হয়নি।”
“এখন ছাত্র-জনতার অন্য কোনো মিছিল থেকে জাপা অফিসে হামলা চালানো হয়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবো না-” বলেন রাশেদ খান।
শুক্রবার রাতে ঢাকায় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের হামলা এবং জাপা-গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষেতে শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে জাপা কার্যালয়ে হামলার ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। ঠাকুরগাঁও, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, গাইবান্ধায় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়েছে। একইসঙ্গে ঠাকুরগাঁওয়ে হরিপুরে ও রাজশাহীর কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগও করা হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার রাতে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনাকে ঘিরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের মারধরে আহত নুরুল হক নূর। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
সেনাবাহিনী ও পুলিশের হামলায় নুর আহত হওয়ার পর গত রাত থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করতে দেখা গেছে।
এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার পর শুক্রবার রাতেই আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান জানায়। ঘটনাস্থলে ‘মব ভায়োলেন্সের’ মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা হয়েছে উল্লেখ করে আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, “জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়”। তবে, সেনাবাহিনীর এই বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাখ্যান করে গণঅধিকার পরিষদ বলেছে যে, জাতীয় পার্টিকে সুরক্ষা দিতেই নুরসহ গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের ওপর “সেনাবাহিনীর কতিপয় দুষ্কৃতিকারী” হামলা চালিয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসারত নুরুল হক নুরের সাথে শনিবার দুপুরে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এই ঘটনায় হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
ওই সময়ের হামলার ভিডিওগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নুরের ওপর হামলা ঘিরে রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনীতিতে বেশ কোণঠাসা অবস্থায় ছিল জাতীয় পার্টি। গত এক বছরে একাধিকবার জাতীয় পার্টির অফিসে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। শুক্রবার হঠাৎ পরিস্থিতি কেন এমন হলো সেই প্রশ্নও সামনে আছে।
অন্তর্বর্তী সরকারও বিবৃতি দিল
নুরকে আহত করার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে শনিবার দুপুরে এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, “কেবল নুরুল হক নূরের ওপরই নয়, এই ধরনের সহিংসতা ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের ঐতিহাসিক সংগ্রামে জাতিকে একত্রিত করা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্পিরিটের ওপরেও আঘাত বলে মনে করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার”।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করছে যে, এই নৃশংস ঘটনার একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন করা হবে। প্রভাব বা পদমর্যাদা যাই হোক না কেন, জড়িত কোনো ব্যক্তি জবাবদিহিতা থেকে রেহাই পাবে না। স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার সাথে এর বিচার সম্পন্ন করা হবে”।
বিবৃতিতে সরকার জানিয়েছে, নূর এবং তার দলের অন্যান্য আহত সদস্যদের চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য একটি বিশেষায়িত মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে পাঠানো হবে।
এদিকে, এই ঘটনায় একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার কথাও জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, “হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটি ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করবে এবং দোষীদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করবে”।
জাপা-গণঅধিকার সংঘর্ষের নেপথ্যে কী?
শুক্রবার রাতে ঢাকার কাকরাইল এলাকায় জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুই দফায় সংঘর্ষ হয়। মূলত সেই সংঘর্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক দফায় চেষ্টা চালায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশের মারধরে আহত হন নুরুল হক নূরসহ দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।
জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে রাজনৈতিক এই সংকট বেশ কিছুদিন থেকেই চলছে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত বছরের অক্টোবরের শেষে জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয়। সে সময় গণঅধিকার পরিষদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ উঠেছিল।
এরপর এ বছরের মে মাসে রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের রংপুরের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে বরিশালে বিক্ষোভ মিছিল ডাকে জাতীয় পার্টি। ওই মিছিলে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই দলের বেশ বেশ কয়েকজন আহতও হন।
গণঅধিকার পরিষদের অভিযোগ, জাতীয় পার্টিকে আগামী নির্বাচনে বিরোধী বানাতে চেষ্টা চালাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা। শনিবার ঢাকা মেডিকেলের সামনে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, “এই চক্রান্ত জনগণ রুখে দেবে”।
রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা?
শুকবার রাতে জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে সংঘর্ষ ও নুরুল হক নুরকে মারধরের ঘটনার সময় বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম এই ঘটনাটি সরাসরি সম্প্রচার করছিল। সেই সব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এই ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হতে থাকে। বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পরিস্থিতিকে অস্থির করার জন্য একটা মহল কাজ করছে। আমি ঠিক জানি না এক্সাক্টলি কারা এটা করছে। কিন্তু করা হচ্ছে এটা। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন”।


















