একাত্তরের ইস্যুর ‘সমাধান দুইবার হয়েছে’, দাবি পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ‘একমত নয়’ বাংলাদেশ
- আপডেট সময় : ০৩:৩৯:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫
- / 213
বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত ঐতিহাসিক ইস্যুগুলোর সমাধান একবার নয়, বরং দুইবার হয়েছে বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
রোববার (২৪ আগস্ট) ঢাকায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ দাবি করেন।
গত এপ্রিল মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও এসব অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধানের জন্য পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া হয়েছিল। তখন ১৯৭১ সালে গণহত্যার দায় স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা পরিশোধের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছিল।
সে বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে ইসহাক দার বলেন, “এই ইস্যুর সমাধান আসলে দুইবার হয়েছে। একবার ১৯৭৪ সালে, আরেকবার ২০০০-এর শুরুর দিকে, যখন জেনারেল (পারভেজ) মোশাররফ এখানে এসেছিলেন। তিনি পুরো পাকিস্তান জাতির পক্ষ থেকে পুরো বাংলাদেশ জাতিকে উদ্দেশ করে কথাটি বলেছিলেন।”
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, **“অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে আপনার প্রশ্ন… দেখুন, প্রিয় ভাই, ১৯৭৪ সালে এটি লিখিতভাবে সমাধান হয়েছিল। সেই নথি দুই দেশের কাছেই রয়েছে।
“তারপর, যখন জেনারেল মোশাররফ এখানে আসেন, তিনি খোলামেলা এবং অকপটে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। আর আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে, দুই ভাইয়ের মধ্যে একবার সমাধান হলে, সেটাই সমাধান।”**
১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত এবং ৩ লাখ নারী ধর্ষণের ঘটনায় পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
অর্ধ শতাব্দী পেরোলেও পাকিস্তান এখনো ৩০ লাখ হত্যার দায় স্বীকার করেনি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাও চায়নি। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ শুধু সাধারণভাবে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছিলেন।
দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে ইসহাক দার বলেন, “দুই দেশের মানুষের জন্য আরও ভালো কিছু করতে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। এটিই আমাদের ঐকমত্য, এবং আমরা সেটাই করছি।”
তিনি আরও জানান, বৈঠকে বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা—সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। “আমাদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য ছিল না, যা সত্যিই ভালো দিক।”
এর আগে গত এপ্রিলে ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ এবং বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের বৈঠকেও অমীমাংসিত বিষয়গুলো আলোচনায় আসে।
জসীম উদ্দিন তখন বলেছিলেন, আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য অংশ, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা—এসব ইস্যু তিনি বৈঠকে তুলেছিলেন।
“আমরা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুততম সময়ে এই ঐতিহাসিক অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে একটি মজবুত, কল্যাণমুখী ও ভবিষ্যতমুখী সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। এ জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা দরকার, আর আমরা একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি।”
পাওনা অর্থ প্রসঙ্গে জসীম উদ্দিন বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যানের হিসাবে পাকিস্তানের কাছে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা আছে। আরেক হিসাবে এটি ৪.৩২ বিলিয়ন।
“এছাড়া ১৯৭০ সালের নভেম্বরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থা যে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দিয়েছিল, সেটিও আমাদের হিস্যার মধ্যে চাওয়া হয়েছে।”
পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ‘একমত নয়’ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ‘সমাধান দুইবার হয়ে যাওয়ার’ যে দাবি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার করেছেন, তার সঙ্গে একমত না হওয়ার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তার এই বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশ একমত কি-না, এমন প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যাটা সমাধান হয়ে যেত তাদের মত করে, তাই না? আমরা আমাদের অবস্থানটা বলেছি, উনারা উনাদের অবস্থানটা বলেছেন।”
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগের মধ্যে ঢাকা সফর করছেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও বিষয়টি তোলার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তাহলে পাকিস্তান নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে একমত–এটা বলা যাবে কি-না, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “না। আপনি এটা বলতে পারেন না। কারণ আমি কি বলেছি… ডোন্ট পুট ওয়ার্ডস ইন মাই মাউথ। সেটা হল যে, আমি বলেছি যে, নিজ নিজ অবস্থান ব্যক্ত করেছি। শুধু একটি অগ্রগতি মনে করি আমি, ছোট্ট একটু, সেটা হল যে আমরা দুই পক্ষ একমত হয়েছি যে এই বিষয়গুলো আলোচনা করে সমাধান করা প্রয়োজন, যাতে করে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলো বাধা হয়ে না আসে। না দুইপক্ষ এ ব্যাপারেও একমত হয়েছি যে, আমরা একদিনে বসে এটা সমাধান করে ফেলতে পারব না।”
তিনটি বিষয়ে তুলের ধরার পর পাকিস্তান কী অবস্থান জানিয়েছে-এমন প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, “তাদের অবস্থান তাদেরকে যেটুকু জিজ্ঞেস করেছেন, তারা বলেছে- ওটুকুই। আমি সেটা কিছু বলতে চাই না।” বাংলাদেশের অবস্থানটা কী–এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশের অবস্থান খুব স্পষ্ট। আমরা চাই যে, হিসাবপত্র হোক এবং আমাদের টাকাপয়সার যে ব্যাপার, সেটা সমাধান হোক। “আমরা চাই যে এই যে এখানে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে তারা দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাক এবং আমরা চাই যে, যে আটকেপড়া মানুষগুলি আছে, তাদেরকে তারা ফেরত নিক।”
বৈঠকে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কি-না, এ প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, “এ ধরনের স্পেসিফিকে আপনার না যাওয়া উচিত এখন। যেহেতু, আমি তো বলেছি যে, আমরা আমাদের অবস্থানটাকে তুলে ধরেছি। এটা আমার উপরে ছেড়ে দিন, এটুকু বিশ্বাস করেন যে, আমি বাংলাদেশের অবস্থান খুব শক্তভাবে ব্যক্ত করেছি।”
এক চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই
প্রায় ১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তি এবং আরও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে দুই দেশ।
দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, সংস্কৃতি বিনিময়, দুই দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা, দুই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার (বাসস ও এপিপিসি) মধ্যে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সঙ্গে পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) সহযোগিতার বিষয়ে হয়েছে সমঝোতা স্মারক।
পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ বলেন, “আপনারা নিশ্চয় প্রত্যাশা করেন না যে ৫৪ বছরের সমস্যা, আজকের একদিনের মিটিংয়ে, যে মিটিংটা কত বছর, ১২-১৩ বছর পরে, ১৩ বছর পরে এবং তাও কিন্তু পূর্ববর্তী হিনা রব্বানী খারের মিটিং কিছু একটা দাওয়াত দেওয়ার জন্য… দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না। কাজেই এখানে বসে এক ঘণ্টায় আমরা এটা সমাধান করে ফেলতে পারব, এটা আপনারা নিশ্চয় আশা করবেন না। কেউই আশা করবে না। আমরা পরস্পরের অবস্থানটা তুলে ধরেছি। আমি আপনাদেরকে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমরা পরস্পরের অবস্থান তুলে ধরেছি।”

















