পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে পাথর মেরে ব্যবসায়ীকে হত্যা: কেন এই নৃশংসতা
জড়িত ২ জনকে বহিস্কার করল যুবদল
- আপডেট সময় : ১২:০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
- / 308

প্রকাশ্যে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে, পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা ও মরদেহ নিয়ে বর্বরতার ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, প্রকাশ্যে এমন নৃশংসতা দেখেও কেউ এগিয়ে আসলো না কেন? কেন এমন বর্বর ঘটনা ঘটল?
এক অপরাধ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, অপরাধীরা মনে করছে এখন তাদের জন্য অনুকূল সময়। আইন ভেঙে তারা পার পেয়ে যাবে।
সাবেক এক আইজিপি মনে করছেন, মানুষের মধ্যে থেকে আইনের ভয় চলে গেছে বলে এমন নৃশংসতা সামনে আসছে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায়’ অপরাধীরা ‘যাচ্ছেতাই’ করছে।
নৃশংস ওই ঘটনায় জড়িত থাকার চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুইজনকে বহিষ্কার করেছে যুবদল।
বুধবার (৯ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) ৩ নম্বর গেইটের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যা করা হয়।
ওই হত্যাকাণ্ড সিসিটিভিতে ধরা পড়েছে। শুক্রবার ওই সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, হত্যায় জড়িতরা হাত তুলে চিৎকার করে উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে কিছু বলছেন। এ সময় আশপাশে থাকা কাউকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।
ভিডিওতে দেখা যায় মৃত সোহাগের প্রায় বস্ত্রহীন রক্তাক্ত দেহ ফটকের ভেতর থেকে টেনে বের করছেন দুই যুবক। কালো প্যান্ট পরা খালি গায়ের এক তরুণ তার গালে চড় মারছেন। কালো গেঞ্জি পরা আরেকজন এসে ওই ব্যক্তির বুকের ওপর লাফাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে একই কাজ করছে। এক পর্যায়ে আরেকজন এসে তার মাথায় লাথি মারে। এছাড়া পাথর দিয়ে তার শরীরে আঘাত করতেও দেখা যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রকাশ্যে ওই ঘটনা ঘটলেও কেউ এগিয়ে যায়নি। হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের ক্যাম্পের কাছে ঘটনা ঘটলেও তারা এগিয়ে যাননি।
পুলিশ ও নিহতের পারিবারের সদস্যরা জানায়, পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে পুরান ঢাকার কয়েকজন যুবক সোহাগকে বুধবার দুপুরে ডেকে নিয়ে যায়। পরে তাকে হত্যা করে। সোহাগ পুরনো তামার তার ও অ্যালুমিনিয়াম শিটসহ ভাঙাড়ির ব্যবসা করতেন। সোহাগের ১৪ বছর বয়সী মেয়ে ও ১১ বছর বয়সী ছেলে রয়েছে।
কেন এমন হচ্ছে?
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, “যারা এগুলো করছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত অ্যাকশন নিতে হবে। ইনফরমেশন থাকতে হবে কোথায় এমন ঘটনা ঘটতে পারে। বেশিরভাগক্ষেত্রেই দ্রুত তদন্ত করতে হবে, আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় হবে। তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমবে।”
“মানুষ মনে করে এই ধরনের ঘটনায় পার পাওয়া যায়। কোনো অসুবিধা হয় না। মানুষের ভেতর থেকে আইনের ভয়টা চলে গেছে। এই কারণে এমন ঘটনা ঘটছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, “ব্যক্তির মধ্যে পূর্ব শত্রুতা কিংবা প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে ছিল সেগুলোর নানাভাবে বহিঃপ্রকাশ আমরা লক্ষ্য করছি। সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের নানাভাবে দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দূরত্ব সমাজে প্রচলিত নিয়ম এবং আইনের মাধ্যমে যদি সুরাহা না হয় তখন মানুষ ওই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা অনুকুল একটা সময় খোঁজে।”
“আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিপূর্ণভাবে সক্রিয় না, কাউকে হত্যা করলে মামলা হতেও পারে, নাও হতে পারে, মামলা হলেও গ্রেপ্তার হতেও পারে, নাও পারে, অপরাধকে পুঁজি করে যারা চলছে তারা এই সময়কে প্রতিশোধ নেওয়ার অনুকুল সময় মনে করছে। তাই এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।”
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, “বাংলাদেশে প্রতিশোধ নেওয়ার অন্যতম সময় হচ্ছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগকে হত্যা অবর্ণনীয় নৃশংসতা। ঘৃণা, ক্ষোভ কিংবা প্রতিহিংসা কী পরিমান থাকলে মৃত দেহের সঙ্গে নৃশংস আচরণ করে!”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সামজিক অস্থিরতা বাড়ছে।দেশটা একটা ট্রাঞ্জিশনাল পিরিয়ডে আছে। দলীয় সরকার থাকা অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখত, এখন সেটা নাই। আমাদের প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য হলো, অনুগত দাসের মতো কাজ করতে চায়। তারা উপরে একটা প্রভু চায়। এই সরকার তাদের প্রভু না। তারা জানে এই সরকার দুই দিন পরে চলে যাবে। মানলে মামলাম, না মানলে নাই। এরপর যেই আসবে তাদের ছত্রছায়ায় থেকে কাজ করতে চাইবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বর্তমানে শক্তিশালী অবস্থান নিচ্ছে না। এটা আরেকটা কারণ।”
সোহাগের মরদেহ
সন্ত্রাসীদের মানসিকতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এরা হচ্ছে সাইকোপ্যাথ। সাইকোপ্যাথ হচ্ছে তারা অপরাধ করতে করতে অভ্যস্ত। যার খুন করতে অভ্যস্ত, লুট করতে অভ্যস্ত, চাঁদাবাজি-দখলবাজি করতে অভ্যস্ত, এই অভ্যস্ততার ফলে ন্যায়বোধ-বিবেকবোধ বলে এটা বিষয় আছে সেটা তাদের ভেতর থেকে মরে যায়।”
“সন্ত্রাসীরা নিয়মিত মানুষকে নানাভাবে মারতে মারতে তাদের হৃদয়টা পাথর হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে দানব হয়ে উঠে। তখন তাদের কাছে সোহাগের মতো নৃশংস হত্যাও স্বাভাবিক হয়ে যায়। ছোট অপরাধ করতে করতে এমন পর্যায়ে যায় মানুষকে পাথর মারতে দ্বিধাবোধ করে না।
গ্রেপ্তার চার
সোহাগ হত্যার ঘটনায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করে হত্যা নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এই মামলায় পুলিশ দুইজনকে এবং র্যাব দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে মামলার আসামি মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় গ্রেপ্তার তারেক রহমানের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।”
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে জানা যায়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং পূর্ব শত্রুতার জেরে ওই ঘটনা ঘটেছে। প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে এবং জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
এদিকে মাহিন ও রবিনকে হত্যা ও অস্ত্র মামলায় পাঁচ ও দুই দিন করে রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।
যুবদলের বিবৃতি
যুবদলের কেন্দ্রীয় সহ দপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভুঁইয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গত ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালের মূল ফটকে জনসম্মুখে মোহাম্মদ সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ী যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
“সেই মামলার আসামি যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকিকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ দল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।”
এ ঘটনার তদন্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো ধরনের ‘শৈথিল্য’ না দেখিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুবদল।



















