ঢাকা ০৯:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে আরও ৩০ দেশের নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা খাঁচা থেকে বের হওয়া সিংহী আড়াই ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে লন্ডনে ফ্লাই রবিবার, নির্জন কারাবাস থেকেই খালেদা জিয়ার ‘নানা রোগের সূচনা’ জানালেন ফখরুল মহাকাশ থেকে পবিত্র  কাবা শরিফের উজ্জ্বল ছবি আন্দোলনে থাকা প্রাথমিকের শিক্ষকদের বদলি, ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবার অনিশ্চিত, কীভাবে ভোটার হবেন? খালেদা জিয়া ছাড়া পরিবারের কেউ ভিভিআইপি সুবিধা পাবেন না কুকুরছানা হত্যা মামলায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে ২ বছরের শিশু খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিতে ঢাকায় আসছেন জুবাইদা যুক্তরাজ্যের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী!

যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্ক সমঝোতা : রফতানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

৫২ বাংলা
  • আপডেট সময় : ০৯:২২:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
  • / 401
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বিশ্ব অর্থনীতির দুই প্রধান শক্তি—চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—দীর্ঘদিনের বাণিজ্য যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এক ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছেছে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা শুল্ক দ্বন্দ্বের অবসানে উভয় দেশই একাধিক বিষয়ে সম্মত হয়েছে, যার ফলে মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের প্রবেশাধিকার সহজতর হবে।

এই সমঝোতার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার রফতানিনির্ভর অর্থনীতিতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের সুযোগে বাংলাদেশ পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এখন সেই অর্জন বিপদের মুখে।

চীনের প্রত্যাবর্তন: চাপে বাংলাদেশের রফতানি

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, যার ফলে ইলেকট্রনিক্স, পোশাক, যন্ত্রাংশ ও হালকা শিল্পজাত পণ্যের আমদানি কমে আসে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রীর রফতানি তখন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। কিন্তু এখন বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের উৎপাদন দক্ষতা, স্কেল, বিনিয়োগ ক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্য সরবরাহ চেইনের কারণে মার্কিন ক্রেতারা আবারও চীনের দিকে ঝুঁকতে পারেন।

“চীন এগিয়ে থাকবে, আমরা পেছাবো”—রফতানিকারকদের উদ্বেগ

বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “চীন যদি শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করে, আর আমাদের যদি ১০ শতাংশ বা তার বেশি দিতে হয়, তাহলে প্রতিযোগিতায় আমরা মার খাব।”

তিনি আরও বলেন, “চীনের অবকাঠামো, উৎপাদন দক্ষতা, ফাইন্যান্সিং এক্সেস—সবই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। এর ওপর আবার যদি শুল্ক বৈষম্য থাকে, তাহলে আমরা কার্যত প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যাবো।”

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: নতুন চাপে বাংলাদেশ

২০২৫ সালের ২ এপ্রিল হঠাৎ ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। যদিও তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়, সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী ৯ জুলাই। এর মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে শুল্ক আবারও কার্যকর হবে।

এটি কার্যকর হলে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও যন্ত্রাংশ খাতে বড় ধাক্কা আসবে। রফতানিকারকরা বলছেন, এতে বহু অর্ডার বাতিল বা মূল্যছাড়ে বিক্রি করতে হতে পারে।

সময়ের সঙ্গে দৌড়ে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি “রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট” চুক্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ উচ্চপর্যায়ের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া চুক্তিতে বলা হয়েছে, মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে হলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইন ও বাণিজ্য নীতি’ অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ পাল্টা প্রস্তাবে বলেছে, “একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অন্য দেশের আইন অনুসরণ করা সম্ভব নয়।” ঢাকা চায়, পারস্পরিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ হোক।

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ড. খলিলুর রহমান

চূড়ান্ত আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, যিনি বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন। ২৬ জুন তিনি ইউএসটিআরের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টার বৈঠকে অংশ নেন।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে চেয়েছেন—

  • বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় থাকতে চায়, বৈষম্যের শিকার হতে চায় না;

  • গম, এলএনজি ও বিমান আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় আগ্রহী;

  • চীনের মতো সুবিধা নয়, বরং ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত সুযোগ প্রত্যাশা করছে।

‘নন-ডিসক্লোজার চুক্তি’ নিয়ে অনিশ্চয়তা

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১২ জুন সই হওয়া এক ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী, কোনো পক্ষ চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশ করতে পারবে না। এতে বেসরকারি খাত ও রফতানিকারকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি বলেছেন, এখন সিরিয়াস হতে হবে। সরকারও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছে। তবে আমাদের শঙ্কা, প্রতিযোগীদের তুলনায় যেন আমাদের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক না পড়ে।”

তিনি জানান, জুলাইয়ের প্রথম দিকে সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ইউএসটিআরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবে।

৯ জুলাইয়ের মধ্যে সমঝোতা না হলে কী হবে—এমন প্রশ্নে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আমরা আশা করছি যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেবে। দরকার হলে সময় বাড়াবে। অন্তত সে আশাই করছি।”

বাংলাদেশও চালাচ্ছে কৌশল

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে—
১. ইউক্রেন থেকে গম আমদানির পরিকল্পনা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত।
২. বোয়িং বিমানের ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু।
৩. স্পট মার্কেট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি আমদানির অনুমোদন।

এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ দেখাতে চাইছে, শুধু রফতানি নয়, আমদানিতেও যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

শুল্ক হিসাব নিয়ে মতবিরোধ

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, বাংলাদেশ তাদের পণ্যের ওপর গড়ে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছে। বাংলাদেশ তা অস্বীকার করে বলছে, প্রকৃত গড় শুল্ক ২০-২৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত ১৯০টি পণ্যের শুল্কহার কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

রেসিপ্রোকাল চুক্তিতে বাংলাদেশ এগিয়ে?

সরকারের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল চুক্তি নিয়ে ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া এখনো প্রাথমিক আলোচনায় আছে; কিন্তু বাংলাদেশ চুক্তির খসড়া পর্যায়ে পৌঁছে এনডিএ সই করেছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, “চুক্তি সই করলেই সব হয় না। যদি শর্ত প্রতিযোগিতার অনুকূলে না হয়, তবে তা বুমেরাং হতে পারে।”

বাণিজ্য ভারসাম্যই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের মূল

২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য:

  • বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি: ৮৩৬ কোটি ডলার

  • যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি: ২২১ কোটি ডলার

এই বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্তকেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

সময়ের কঠিন পরীক্ষা

যখন চীন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসছে, বাংলাদেশ তখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তির জন্য লড়ছে। ৯ জুলাইয়ের মধ্যে সমঝোতা না হলে ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হবে, যা পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে সরকার এখনো আশাবাদী—ন্যায়সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্ক সমঝোতা : রফতানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ০৯:২২:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

বিশ্ব অর্থনীতির দুই প্রধান শক্তি—চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—দীর্ঘদিনের বাণিজ্য যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এক ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছেছে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা শুল্ক দ্বন্দ্বের অবসানে উভয় দেশই একাধিক বিষয়ে সম্মত হয়েছে, যার ফলে মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের প্রবেশাধিকার সহজতর হবে।

এই সমঝোতার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার রফতানিনির্ভর অর্থনীতিতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের সুযোগে বাংলাদেশ পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এখন সেই অর্জন বিপদের মুখে।

চীনের প্রত্যাবর্তন: চাপে বাংলাদেশের রফতানি

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, যার ফলে ইলেকট্রনিক্স, পোশাক, যন্ত্রাংশ ও হালকা শিল্পজাত পণ্যের আমদানি কমে আসে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রীর রফতানি তখন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। কিন্তু এখন বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের উৎপাদন দক্ষতা, স্কেল, বিনিয়োগ ক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্য সরবরাহ চেইনের কারণে মার্কিন ক্রেতারা আবারও চীনের দিকে ঝুঁকতে পারেন।

“চীন এগিয়ে থাকবে, আমরা পেছাবো”—রফতানিকারকদের উদ্বেগ

বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “চীন যদি শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করে, আর আমাদের যদি ১০ শতাংশ বা তার বেশি দিতে হয়, তাহলে প্রতিযোগিতায় আমরা মার খাব।”

তিনি আরও বলেন, “চীনের অবকাঠামো, উৎপাদন দক্ষতা, ফাইন্যান্সিং এক্সেস—সবই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। এর ওপর আবার যদি শুল্ক বৈষম্য থাকে, তাহলে আমরা কার্যত প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যাবো।”

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: নতুন চাপে বাংলাদেশ

২০২৫ সালের ২ এপ্রিল হঠাৎ ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। যদিও তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়, সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে আগামী ৯ জুলাই। এর মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে শুল্ক আবারও কার্যকর হবে।

এটি কার্যকর হলে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও যন্ত্রাংশ খাতে বড় ধাক্কা আসবে। রফতানিকারকরা বলছেন, এতে বহু অর্ডার বাতিল বা মূল্যছাড়ে বিক্রি করতে হতে পারে।

সময়ের সঙ্গে দৌড়ে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি “রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট” চুক্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ উচ্চপর্যায়ের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া চুক্তিতে বলা হয়েছে, মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে হলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইন ও বাণিজ্য নীতি’ অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ পাল্টা প্রস্তাবে বলেছে, “একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অন্য দেশের আইন অনুসরণ করা সম্ভব নয়।” ঢাকা চায়, পারস্পরিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ হোক।

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ড. খলিলুর রহমান

চূড়ান্ত আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, যিনি বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন। ২৬ জুন তিনি ইউএসটিআরের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টার বৈঠকে অংশ নেন।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে চেয়েছেন—

  • বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় থাকতে চায়, বৈষম্যের শিকার হতে চায় না;

  • গম, এলএনজি ও বিমান আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় আগ্রহী;

  • চীনের মতো সুবিধা নয়, বরং ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত সুযোগ প্রত্যাশা করছে।

‘নন-ডিসক্লোজার চুক্তি’ নিয়ে অনিশ্চয়তা

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১২ জুন সই হওয়া এক ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ অনুযায়ী, কোনো পক্ষ চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশ করতে পারবে না। এতে বেসরকারি খাত ও রফতানিকারকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি বলেছেন, এখন সিরিয়াস হতে হবে। সরকারও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছে। তবে আমাদের শঙ্কা, প্রতিযোগীদের তুলনায় যেন আমাদের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক না পড়ে।”

তিনি জানান, জুলাইয়ের প্রথম দিকে সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ইউএসটিআরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবে।

৯ জুলাইয়ের মধ্যে সমঝোতা না হলে কী হবে—এমন প্রশ্নে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আমরা আশা করছি যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেবে। দরকার হলে সময় বাড়াবে। অন্তত সে আশাই করছি।”

বাংলাদেশও চালাচ্ছে কৌশল

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে—
১. ইউক্রেন থেকে গম আমদানির পরিকল্পনা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত।
২. বোয়িং বিমানের ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু।
৩. স্পট মার্কেট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি আমদানির অনুমোদন।

এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ দেখাতে চাইছে, শুধু রফতানি নয়, আমদানিতেও যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

শুল্ক হিসাব নিয়ে মতবিরোধ

যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, বাংলাদেশ তাদের পণ্যের ওপর গড়ে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছে। বাংলাদেশ তা অস্বীকার করে বলছে, প্রকৃত গড় শুল্ক ২০-২৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত ১৯০টি পণ্যের শুল্কহার কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

রেসিপ্রোকাল চুক্তিতে বাংলাদেশ এগিয়ে?

সরকারের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল চুক্তি নিয়ে ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া এখনো প্রাথমিক আলোচনায় আছে; কিন্তু বাংলাদেশ চুক্তির খসড়া পর্যায়ে পৌঁছে এনডিএ সই করেছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, “চুক্তি সই করলেই সব হয় না। যদি শর্ত প্রতিযোগিতার অনুকূলে না হয়, তবে তা বুমেরাং হতে পারে।”

বাণিজ্য ভারসাম্যই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের মূল

২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য:

  • বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি: ৮৩৬ কোটি ডলার

  • যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি: ২২১ কোটি ডলার

এই বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্তকেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

সময়ের কঠিন পরীক্ষা

যখন চীন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসছে, বাংলাদেশ তখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তির জন্য লড়ছে। ৯ জুলাইয়ের মধ্যে সমঝোতা না হলে ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হবে, যা পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

তবে সরকার এখনো আশাবাদী—ন্যায়সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।