‘সুবিধাবাদ দেখে বিপর্যস্ত’ উমামা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়লেন, বিস্তর অভিযোগ
- আপডেট সময় : ০৩:০৩:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
- / 269

গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্রের ভূমিকায় ছিলেন উমামা ফাতেমা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করা উমামা ফাতেমা সংগঠন থেকে সরে গেছেন। বলছেন, “প্ল্যাটফর্মকে সুবিধাবাদীরা পোকার মতো ভেতর থেকে খেয়ে ফেলেছে।” তবে এই সুবিধাবাদীরা কারা সেটি তিনি স্পষ্ট করেননি।
বৃহস্পতিবার সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পর শুক্রবার মধ্যরাতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
উমামা লিখেছেন, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) নামের রাজনৈতিক দল গঠনের পর ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর অসমাপ্ত কাজের দায়বদ্ধতা থেকে বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকিতে পড়তে পারে—এই আশঙ্কা থেকে অনলাইন ও অফলাইনে তার ওপর ‘ভয়াবহ চাপ’ তৈরি করা হয়।
“আমি পুরো বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই একটা সদিচ্ছা থেকে ব্যানারকে সচল করার চেষ্টা করেছিলাম”, লিখেছেন তিনি।
কিন্তু পরিস্থিতির ক্রমাবনতি দেখে গত এপ্রিল-মে মাসে কার্যত এই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন বলে জানান তিনি।
উমামা বলেন, যাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক বা মিছিল করেছেন—তাদের একটি অংশই পরিকল্পিতভাবে কনিষ্ঠদেরকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে ‘মানহানিকর প্রচারণা’ চালানো হয়েছে।
“মানুষ বাইরে যত ভালো সাজার চেষ্টা করুক, ভেতর থেকে কতটা ছোটলোক হতে পারে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই সেই সময়গুলাতে। এই তথাকথিত সহযোদ্ধারা মানুষকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করে, প্রয়োজন শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলতে এক মুহূর্তও লাগে না।”
উমামা ফাতেমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। রাজনৈতিক জীবনে তিনি মানুষের অধিকার, সমতা ও ন্যায়ের জন্য নানা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে দেশের ছাত্র সমাজের বড় আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘ম্যাডেলিন অলব্রাইট অনারারি গ্রুপ’ পুরস্কারে মনোনীত হলেও, ফিলিস্তিনের প্রতি তার সমর্থনের কারণে উমামা ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে তিনি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত থেকে বিশেষ সম্মাননা পান।
‘সুবিধাবাদীরা প্ল্যাটফর্মটিকে ভেতর থেকে গিলে ফেলেছে’
এমন মন্তব্য করে উমামা লেখেন, “অনেক শাখা কমিটিতে ভালো মানুষ থাকলেও এদের কারণে তারা টিকে থাকতে পারেনি।”
নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে হতাশা প্রকাশ করে গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত এই নেত্রী লেখেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় ঘটনা দেখার পর চোখের সামনে সবকিছু ভেঙে পড়তে দেখাটা অনেক কঠিন।”
পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত চট করে নেওয়া হয়নি জানিয়ে উম্মা জানান, তিনি অনেকবারই এমন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।
“একটা পদত্যাগপত্র লিখে আর জমা দিইনি। পারি নাই আসলে।”
রাজনৈতিকভাবে ভাবলে পদত্যাগ করে আসাটা ‘সবচেয়ে সহজ’ কাজ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু আমি তো মানুষ, অনেক কঠিন, অভ্যুত্থানের কারণে পারি নাই।”
এই প্ল্যাটফর্মে দেশ সংস্কার করতে এসেছিলেন জানিয়ে উমামা আরও লেখেন, “কাদা ছোঁড়াছুড়ি করতে তো আসি নাই এখানে।”
জেলা উপজেলা থেকে অনিয়মের খবর
উমামা জানান, তাদের প্লাটফর্মের জেলা ও উপজেলা শাখার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের খবর আসত, সাংবাদিকদের কল আসত।
“আমি পরিষ্কার করে বলেছি যারা এই কমিটিগুলো দিয়েছে তাদের আপনারা কেন জিজ্ঞেস করেন না? যাদের সইয়ে কমিটি হচ্ছে তাদের মুখের সামনে মাইক ধরেন না কেন?”
এই কমিটিগুলো করার সময় তার কাছে অভিযোগ এলে তিনি তা সরাসরি সাবেক আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের কাছে জানিয়েছেন বলেও লেখেন তিনি।
ঢালাও কমিটি নিয়ে আপত্তি
গত ফেব্রুয়ারির শেষে এনসিপি গঠনের আগে ঢালাওভাবে কমিটি হয়েছে বলে মন্তব্য করে উমামা লেখেন, “আমিসহ কয়েকজন এসব কমিটি নিয়ে আপত্তি দিই। কোনো উত্তর আমাদের দেওয়া হয়নি।”
মুখপাত্র হিসেবে বৈষম্যবিরোধীর পেইজের প্রবেশাধিকার তার কাছে থাকার কথা থাকলেও তাকে সেটা দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন উমামা।
তিনি লেখেন, “বরং এই পেইজ থেকে মার্চ মাসে আমার বিরুদ্ধে পর্যন্ত পোস্ট হয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিতে চাইলে পেইজকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় আর নইলে Silent treatment (অন্তরালের শাস্তি) সহ্য করতে হয়।
“দিনের পর দিন হেন কোনো নোংরামি নাই যা এরা করেনি।”
মার্চ এপ্রিলেই বিপর্যস্ত
উমামার ভাষ্য, মার্চ-এপ্রিল মাসে এসব ঘটনার কারণে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
‘হেয়ার রোড’ অর্থাৎ মন্ত্রীপাড়ার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আমার সাথে যারা কাজ করছিল তারা একদিকে আমার কথার সাথে তাল মেলাত, অন্যদিকে রাতের বেলা গিয়ে পদ-পদবি নিয়ে দরকষাকষি করত।”
সব খবর পেতেন জানিয়ে এই নারী রাজনৈতিক কর্মী লেখেন, তিনি এর বিরোধিতা করলে তাকে বলা হত যাতে শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি পদ নিয়ে কথা বলে আসেন।
“আমি সরাসরি বলি যে, আমি কেন ওদের কাছে পদ খুঁজতে যাব?”
“ওরা আমাকে পদ দেয়ার কে? ও কোন ‘হনু’ হয়ে গেছে যে আমাকে এসে তারা পদ দেবে? ওর কাছে গিয়ে পদ আনতে হলে প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করার আর মানে কী?”
উমামা লেখেন, এসবের ভাই-ব্রাদার রাজনীতির ‘যন্ত্রণায়’ ‘বদ্ধ জলাশয়ের মতো’ প্ল্যাটফর্ম আটকে ছিল।
তার আরও অভিযোগ, তিনি কাজ করতে চাইলে সেটা করতে দেওয়া হয়নি বরং পেছনে কথা ছড়ানো হতো তিনি প্ল্যাটফর্মের কাউকে কাজ করতে দিচ্ছেন না, কাউন্সিল আটকে রেখেছেন।
“নেতারা তাদের জুনিয়রদের দিয়ে অপপ্রচার ছড়িয়ে বেড়ায় বিভিন্ন ফোরামে। পরবর্তীতে আমি সিদ্ধান্ত নেই এভাবে হয় না। নির্বাহীর যারা অবশিষ্ট ছিল তাদের জানিয়ে দেই। মুখপাত্র পরিচয়টা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থী পরিচয়টাকে আপন করার শুরু করি।”
উমামা লেখেন, এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জানতে পারেন, তার বিরুদ্ধে ছড়ানো হয়েছে তিনি নাকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাউন্সিল আটকে রেখেছেন।
“অথচ সবাই জানে কাউন্সিল মন্ত্রীপাড়ায় আটকে আছে। আর আমি এই প্ল্যাটফর্মের সাথেই নাই। আমি চুপ করে ছিলাম সেটা নিয়েও একটা না একটা অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছিল।”
ব্যঙ্গ করে উমামা লেখেন, “আমার এত ক্ষমতা, আমি কমিটি আটকে রেখেছি। অথচ আমি শাখা কমিটি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি, ঢালাওভাবে পেইজ থেকে পোস্ট হওয়া উপজেলা কমিটিগুলোও আটকাতে পারিনি। অথচ যখন হেয়ার রোড থেকে আহ্বায়ক মনোনীত হলো তখন নির্বাচন হতে ২০ দিনও লাগেনি।”
প্রার্থী না হয়েও সদস্য নির্বাচিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে যে কমিটি গঠন হয়েছে, সেই নির্বাচন নিয়েও অভিযোগ আছে উমামার।
তিনি লেখেন, “বৈষম্যবিরোধীর ছাত্র আন্দোলনের কাউন্সিলে ভোটারদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সদস্যরাই ছিলেন। যারা কাজ করতে চেয়েছিল, তাদের অনেকেই প্রার্থী হতে পারেননি।”
তবু শেষ মুহূর্তে উমামা ভোট দেন, আর এটিই তার সর্বশেষ চেষ্টা ছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
“আমি ভেতর থেকে চাচ্ছিলাম এই প্ল্যাটফর্মটার অন্তত ভালো কিছু হোক। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যেভাবে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে প্ল্যাটফর্মকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে, এখান থেকে ভালো কিছু অসম্ভব।”
ভোটের ফলাফল দেখে হতাশ উমামা বলেন, “নির্বাচনে অংশ না নেওয়া একজন এসে সদস্য হয়ে গেছে কাউন্সিলের। এসব দেখে আমি অত্যন্ত লজ্জিত। সেই একই স্বেচ্ছাচারিতা, স্ট্যান্ডবাজি, ভাই-ব্রাদার কোরামের খেলা। এখন বোধ করি এই প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
অভ্যুত্থানের স্বপ্ন নষ্ট হয়েছে
উমামা জানান, অভ্যুত্থানের কথা চিন্তা করে তিনি এই ‘বৈষম্যবিরোধী’ প্ল্যাটফর্ম থেকে সব ধরনের সমর্থন ও কাউন্সিলে দেওয়া ভোট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
‘অত্যন্ত অশান্তিতে’ থাকার কথা জানিয়ে তিনি লেখেন, “অভ্যুত্থান যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছে, গোষ্ঠীস্বার্থে এই প্ল্যাটফর্ম একইভাবে বহু মানুষের স্বপ্ন ও সময় নষ্ট করেছে।
“আমি অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিলাম। প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার আগে আমাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে যাওয়ার পরেই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের ‘বুলিমাত্র’। শুধু আমি না, অনেক ছাত্ররাই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সবার সাথে শুধু ছলনা হয়েছে।”
যারা ‘কষ্ট দিয়েছে’, ‘নোংরামি করেছে’ এতগুলা মাস, অভ্যুত্থানকে ‘বাজারদরে কেনা-বেচা করেছে’, তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবের না জানিয়ে উমামা লেখেন, “আমি রুহের ভেতর থেকে বদদোয়া দিচ্ছি এই মোনাফেকদের।”
সবশেষে উমামা লেখেন, তিনি রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারতেন, কিন্তু পারেননি। কারণ, তা ভেতর থেকে আসেনি।
“আমি গত ৮-৯ মাসকে ঝেড়ে ফেলে সামনে আগাতে চাই। অনেক ভালো ছেলে-পেলেকে এই প্ল্যাটফর্মে আমি দেখেছি, সদিচ্ছাl আছে যাদের। আমি পরামর্শ দেব, আপনারা সবাই পড়াশোনায় মন দিন, কাজে মন দিন। আমিও ভেঙে পড়ছি না, গুছিয়ে আনছি সবকিছু।”
‘ফি আমানিল্লাহ’ লিখে দীর্ঘ পোস্ট শেষ করেন উমামা।


















