দুই সপ্তাহ সময় নিলেন ট্রাম্প, থামবে কি যুদ্ধ?
- আপডেট সময় : ০৩:৪৬:১৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫
- / 242

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ গড়িয়েছে দ্বিতীয় সপ্তাহে। এমন সময়ে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন হয়ে উঠেছে—যুক্তরাষ্ট্র কি এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান কী হবে? এই প্রশ্নের জবাব দিতে দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছেন তিনি।
শুক্রবার (২০ জুন ২০২৫) রয়টার্স, সিএনএন ও আল জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে আশাবাদ ও সংশয়ের প্রকাশ করেছে।
যুদ্ধ চান না ট্রাম্প
ইসরায়েলের টানা আট দিনের হামলায় বিপর্যস্ত ইরান পাল্টা জবাব দিতে ব্যবহার করেছে তাদের উল্লেখযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র মজুত। এই অবস্থায় ট্রাম্প ও তাঁর উপদেষ্টারা আশা করছেন, তেহরান হয়তো নিজেদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে পরমাণু চুক্তিতে রাজি হবে।
চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল ইউরেনিয়াম পরিশোধন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা। কিন্তু ইরান এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করে জানায়, শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু শক্তি ব্যবহারের অধিকার তাদের রয়েছে।
গত কয়েক দিন ধরে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো সময় ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি হামলায় অংশ নিতে পারে। কিন্তু অষ্টম দিনে এসে তিনি জানালেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তাঁর আরও দুই সপ্তাহ সময় প্রয়োজন।
ক্ষমতায় ফিরে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি যুদ্ধ চান না। নির্বাচনী প্রচারে ইউক্রেন-রাশিয়া ও গাজার যুদ্ধ দ্রুত বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, এমন অবস্থায় ইরানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো তাঁর ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ কারণে ট্রাম্প কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ইরানের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়া মানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে নামা—যা তাঁর অগ্রাধিকার নয়।
ট্রাম্প সবসময়ই জানিয়েছেন, হামাস বা হিজবুল্লাহর তুলনায় তিনি চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসনকেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন।
কূটনীতি শুরুর আগেই বাধা
দুই সপ্তাহের মধ্যে কূটনৈতিক সমাধান সম্ভব কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। হোয়াইট হাউসের মধ্যে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, স্টিভ উইটকফ ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইরানের সঙ্গে আলোচনায় যাবেন। কিন্তু শুক্রবার ইসরায়েলের অতর্কিত হামলায় সেই পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়।
এদিকে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শুক্রবার জেনেভায় ইরানি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত তারা তেহরানকে অবহিত করেছেন। ইসরায়েলি হামলা মূলত ওই শর্ত প্রত্যাখ্যানের পরপরই শুরু হয়।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, সিএনএনকে বলেন, ‘ইউরোপীয় নেতারা ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসছেন। প্রেসিডেন্ট এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানাচ্ছেন।’
ওয়াশিংটনের প্রতি ইরানের বার্তা
ইসরায়েল হামলা শুরুর পর থেকেই তেহরান ওয়াশিংটনকে সাফ জানিয়ে এসেছে—‘আগ্রাসনের মুখে দরকষাকষি সম্ভব নয়।’ ইরান স্পষ্টভাবে জানায়, ইসরায়েলের হামলা বন্ধ না হলে তারা কোনো আলোচনায় বসবে না।
সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলকে হামলা থামাতে চাপ দেয়নি। বরং ট্রাম্প নিজেই নেতানিয়াহুকে বলেছেন, “চালিয়ে যাও।”
সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র এখনো ব্যবহার করেনি ইরান?
ইরান এখনো ইউরেনিয়াম পরিশোধন বন্ধের যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে নেয়নি, এমনকি এমন কোনো ইঙ্গিতও দেয়নি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে কোনো নতুন আলোচনা চূড়ান্ত হয়নি।
ট্রাম্পের অবস্থান বোঝা কঠিন
একদিন আগেও বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন, ‘এই বুঝি ট্রাম্প হামলা শুরুর নির্দেশ দিলেন।’ কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত জানাতে দুই সপ্তাহ সময় নিলেন।
এতে ধারণা করা হচ্ছে, সামরিক নয়, কূটনৈতিক সমাধানেই ট্রাম্প বেশি আগ্রহী।
বৃহস্পতিবার প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট সব সময় কূটনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগেও তিনি পিছপা হবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইরানসহ বিশ্বের জানা উচিত—মার্কিন সামরিক বাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আমাদের সামর্থ্য অতুলনীয়।’
এর আগে একাধিক জরুরি বৈঠকে ট্রাম্প উপদেষ্টাদের প্রশ্ন করেন, ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসে বাঙ্কার বাস্টার বোমা কতটা কার্যকর হবে এবং এতে কত সময় লাগতে পারে।
তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল জানায়, সামরিক অভিযান হলে তা দ্রুত শেষ করতে চান ট্রাম্প। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রতি তাঁর আগ্রহ নেই।
তবে ট্রাম্পের সাবেক প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যাননের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
হোয়াইট হাউস সূত্র জানায়, ট্রাম্পকে দেওয়া বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনায় পরবর্তী সংঘাত বেশ কিছুদিন ধরে চলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণেই এসব পরিকল্পনাকে ‘অতৃপ্তিকর’ বলে মনে করছেন প্রেসিডেন্ট।
এই দুই সপ্তাহে কী করবেন ট্রাম্প?
ট্রাম্পের দুই সপ্তাহ সময় চাওয়া নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। এক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “এতে কোনো ফল হচ্ছে না। এখনই সিদ্ধান্ত জানানো উচিত।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই সময়কালে ট্রাম্প শীর্ষ গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য নেবেন।
তিনি সিআইএ প্রধান জন র্যাটক্লিফ এবং জয়েন্ট চিফস চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইনের কাছ থেকে বিকল্প পরিকল্পনার খসড়া চেয়েছেন।
একইসঙ্গে পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিনিধি ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু উইটকফ থাকবেন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কেন্দ্রে। তিনি ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
উইটকফের প্রস্তাবে বলা হয়, ইরানকে ভূখণ্ডে ইউরেনিয়াম পরিশোধন কার্যক্রম থেকে পুরোপুরি সরে আসতে হবে। হোয়াইট হাউসের মতে, এই শর্ত পূরণ ছাড়া চুক্তি সম্ভব নয়।
দুই সপ্তাহ পর কী ঘটতে পারে?
সব মিলিয়ে এটা পরিষ্কার—তেহরান যদি তাদের অবস্থান না বদলায়, তবে দুই সপ্তাহ পর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে নামবে।
সে ক্ষেত্রে ‘যুদ্ধ চাই না’ বললেও ইসরায়েলকে সহায়তা দিতে ট্রাম্প বাধ্য হবেন। যুদ্ধবিমান, বাঙ্কার বাস্টার বোমাসহ সব কিছুই পাঠাতে হতে পারে।
তখন মধ্যপ্রাচ্য নতুন এক ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হবে। পুড়বে ইরান, প্রাণ হারাবে লাখো মানুষ।
বিশ্ববাসীর এখন একটাই আশা—এই দুই সপ্তাহের মধ্যেই তেহরান ও ওয়াশিংটন কোনো সমঝোতায় পৌঁছাবে, যা এই সংঘাতের অবসান ঘটাবে। হয়তো তাতে গাজাবাসীরও মুক্তির সম্ভাবনা জাগবে। হয়তো মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই বয়ে যাবে শান্তির সুবাতাস।



















