গালফের অন্যতম দেশ কাতারের দর্শনীয় কৃত্রিম দ্বীপ ‘পার্ল আইল্যান্ড’-এর উপর দিয়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে। যদি ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় তবে গালফের অন্যান্য দেশগুলোর মত কাতারও পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
মধ্যপ্রাচ্যের গালফ অঞ্চলে বাড়ছে পারমাণবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা। ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, তাহলে কাতারসহ গালফের অন্যান্য দেশগুলো ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে—এমন আশঙ্কায় দেশগুলো এখন জরুরি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
কাতারের বিখ্যাত কৃত্রিম দ্বীপ ‘পার্ল আইল্যান্ড’-এর উপর দিয়ে যখন মেঘ উড়ে যাচ্ছে, তখনই এই শঙ্কা নতুন মাত্রা নিচ্ছে।
ওমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পারমাণবিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, “একটি বন্ধ ও নিরাপদ ঘরের ভেতরে (যতটা সম্ভব জানালাবিহীন) আশ্রয় নিতে হবে, জানালা-দরজা শক্ত করে বন্ধ করতে হবে এবং শীতাতপ বা বায়ু চলাচলের সব ব্যবস্থা বন্ধ রাখতে হবে।”
বাহরাইনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, দেশজুড়ে ৩৩টি জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে এবং সতর্কতা সাইরেনও পরীক্ষা করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহে পারমাণবিক বিকিরণজনিত ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন গালফ দেশের সংবাদমাধ্যমে সচেতনতা ও করণীয় বিষয়ে গাইড প্রকাশিত হয়েছে।
গত ১৭ জুন ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের হারজেলিয়া শহরে আঘাত হানলে যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়, তা পুরো পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের ‘মিডল ইস্ট ইনিশিয়েটিভ’-এর ফেলো ও বাহরাইনের নাগরিক এলহাম ফাখরো বলেন, “ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ সত্যিই উদ্বিগ্ন।”
তিনি আরও বলেন, “পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা রয়েছে—বিশেষ করে উপসাগরের পানিতে। সেইসঙ্গে ইরানের পাল্টা হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে, যা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য হুমকির। এছাড়া বিমান চলাচলেও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাঘাত ঘটতে পারে।”
ইরানের একমাত্র সচল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘বুশেহর’—তেহরানের তুলনায় অনেক বেশি কাছে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলোর রাজধানীর। সম্ভাব্য দূষণের প্রভাব তাই সবচেয়ে বেশি পড়তে পারে এই গালফ দেশগুলোতেই।
বাহরাইনেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড, যা সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে সোমবার গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)—যার সদস্য বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—কুয়েতে অবস্থিত ‘ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’ সক্রিয় করেছে।
লক্ষ্য—“পরিবেশগত ও তেজস্ক্রিয় ঝুঁকির মুখে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিশ্চিত করা।”
সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ সতর্ক করে বলেন, “বেপরোয়া বা ভুলভাবে নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপ শুধু ইরান-ইসরায়েল নয়, গোটা অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে।”
একইভাবে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “যদি সমন্বয়হীন হামলা হয়, তবে পারস্য উপসাগরের পানির উৎসই হুমকির মুখে পড়বে।”
উল্লেখযোগ্য যে, প্রায় ৬ কোটি মানুষ এই উপসাগরের পানি থেকে সরবরাহকৃত বিশুদ্ধ পানীয় ও গৃহস্থালি পানি ব্যবহার করেন, যার বেশিরভাগ আসে সমুদ্রের পানি শোধন করে। তাই বুশেহর কেন্দ্রে হামলা হলে এই জলসম্পদ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
‘তিন দিনের মধ্যে পানি থাকবে না’
চলতি বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক টাকার কার্লসন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আল থানিকে প্রশ্ন করেছিলেন—“যদি বুশেহর পারমাণবিক কেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী হবে?”
উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের পানি দূষিত হয়ে যাবে। মাছ থাকবে না, জীবন থাকবে না। কারণ আমাদের পুরো পানির উৎসই সমুদ্র, যা আমরা শোধন করে ব্যবহার করি। আমাদের না কোনো নদী আছে, না কোনো পানির রিজার্ভ। তিন দিনেই পানি ফুরিয়ে যাবে। কেবল কাতার নয়, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত—সবাই হুমকির মধ্যে পড়বে।”
এই প্রেক্ষাপটে কাতার বিশাল জলাধার তৈরি করেছে বলেও তিনি জানান।
এদিকে সিএনএন–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ধীরে ধীরে কূটনৈতিক পথ থেকে সরে গিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পক্ষে মনোভাব পরিবর্তন করছেন বলে ঘনিষ্ঠ দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন। যদিও ট্রাম্প এখনো কূটনৈতিক সমাধানের দরজা খোলা রেখেছেন, যদি ইরান কিছু শর্তে রাজি হয়। ট্রাম্প বলেন, “আমি এটা করতেও পারি, আবার নাও করতে পারি। কেউই জানে না আমি কী করব।”
বিশ্বের অন্যতম প্রবাসীবান্ধব ও বিনিয়োগবান্ধব অঞ্চল হিসেবে গালফ দেশগুলো যেমন—সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও সৌদি আরব—যেখানে নেই কোনো আয়কর, রয়েছে উচ্চ বেতন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা; সেখানেও নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
আবুধাবির এক মার্কিন নাগরিক বলেন, “আমি চিন্তিত নই, নিরাপত্তা নিয়ে আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানকে আক্রমণ করে, তারপর কী হবে—সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি।”
দুবাইয়ের এক মিশরীয় নারী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “নিজেকে নিরাপদ মনে করি এবং মনে করি সঠিক জায়গায় আছি। তবে সাম্প্রতিক খবর দেখে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। সবাই উদ্বিগ্ন… যুদ্ধ যেন হাতের নাগালেই চলে এসেছে।”
























