হামজা-সামিতরা মন জিতেছেন, বাংলাদেশের শেষ পরিণতি আফসোসেই থামল
- আপডেট সময় : ১২:৪৩:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
- / 338

উৎসবের ঘাটতি ছিল না দর্শকসারিতে। উত্তেজনা ছিল আকাশছোঁয়া। নব্বই মিনিটজুড়ে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ ধ্বনি গর্জে উঠছিল ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে।
খেলোয়াড়রাও সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়েছেন। বিশেষ করে শেষ বিশ মিনিটে সিঙ্গাপুরের রক্ষণ শুধু কর্নার আর থ্রো-ইন সামলাতেই ব্যস্ত! হামজা চৌধুরী একটি অ্যাসিস্ট করেন এবং শেষ দিকে তাঁর শটও উত্তেজনা ছড়িয়ে পোস্টের বাইরে যায়। আজই বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক হওয়া সামিত সোম শুরু থেকে— বিশেষত প্রথমার্ধে— প্লেমেকিংয়ে নজরকাড়া নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।
নব্বই মিনিট শেষের পর যোগ করা সময়ে একটি স্পটকিক পায়নি বাংলাদেশ। ভিএআর থাকলে ফাহিমের ওপর সিঙ্গাপুরের ডিফেন্ডারের ট্যাকল যে পেনাল্টি হতো, তা নিশ্চিত। একেবারে শেষ বাঁশির ঠিক আগের মুহূর্তে তারিক কাজীর হেড আবারও বারে লেগে ফিরে আসে।
সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছিল— আজকের এই সন্ধ্যা শেষ পর্যন্ত আফসোসে ভরা। এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে সিঙ্গাপুরের কাছে ২-১ গোলে হারের পরও গ্যালারির ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ স্লোগান স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিল, বাংলাদেশ অন্তত দর্শক-হৃদয় জিতেছে। তবে হারার পর আফসোস তো থেকেই যায়!
প্রতিটি দল প্রথম ম্যাচে এক পয়েন্ট পাওয়ায়, মূলপর্বে যেতে হলে বাংলাদেশকে জিততেই হতো— ম্যাচের আগে সেটাই জানা ছিল। বিরতিতে সেই প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হয়েছে। প্রথমার্ধে দারুণ খেলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ। এদিকে খবর আসে, গ্রুপের অন্য ম্যাচে হংকংয়ের কাছে ভারত ১-০ গোলে হেরে গেছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য এই ম্যাচে জয় অথবা অন্তত ড্র একেবারে জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু ৫৮ মিনিটে এক রকম বিপর্যয় ঘটে। বাংলাদেশের রক্ষণ-রেখা এলোমেলো হয়ে যায়। তিন দফা শটের পর সিঙ্গাপুর গোল পেয়েই যায়! মাঝমাঠের ফাঁক ফুঁড়ে বক্সের বাঁ দিকে ঢুকে পড়া সং ইওয়াংয়ের শট প্রথমে তপু ঠেকান, বল বক্সের বাইরে যায়। সেখান থেকে হামি সিয়াহিন শট নেন, বাতাসে বাঁক খাওয়া শটটাকে মিতুল মারমা পাঞ্চ করে ফেরান। কিন্তু বল আবার বক্সের বাঁ দিকে থাকা ইখসান ফান্ডির পায়ে চলে যায়!

সেখানে বাংলাদেশের ভাগ্যই যেন লেখা হয়ে গিয়েছিল। মিতুল এগিয়ে যান, তপুও ব্লক দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফান্ডির বুদ্ধিদীপ্ত শট ফাঁক গলিয়ে জালে জড়িয়ে যায়।
গ্যালারি তখন খানিক স্তব্ধ। হামজা ও অন্যরা হাত নেড়ে, ইশারায় গ্যালারিকে চাঙা করার চেষ্টা চালান। কিছুটা সাড়া মিললেও প্রাণ ফেরাতে গোল চাই। সেটা এলো ৬৭ মিনিটে, মনে হচ্ছিল উৎসব আর থামবে না!
মাঝমাঠ থেকে হামজার দারুণ থ্রু খুঁজে পায় ডিফেন্ডারদের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া রাকিব হোসেনকে। সিঙ্গাপুরের গোলকিপার বিপদ বুঝে এগিয়ে এলেও, রাকিবের শট তাঁর পায়ের ফাঁক গলে জালে চলে যায়। গ্যালারি ফেটে পড়ে উল্লাসে। সেই আওয়াজের সঙ্গে ফিরে আসে আশা।
ফুটবলারদের বুকে তা ছড়িয়ে পড়ে। শেষ ১৫ মিনিটে কোচ হাভিয়ের কাবরেরা পাঁচ ফরোয়ার্ড নামিয়ে খেলান। সিঙ্গাপুরের রক্ষণ তখন নাস্তানাবুদ। একের পর এক কর্নার, একের পর এক থ্রো-ইন; কিন্তু শেষ টাচ আর হলো না। গোলও আর এল না।
এই পুরো ম্যাচের গল্পই কি তাই নয়?
প্রথমার্ধে সামিতের দুটি থ্রু দারুণ সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। একবার রাকিবের আগে সিঙ্গাপুরের গোলকিপার বল দখলে নেন, আরেকবার ফাহামেদুল একেবারেই ভালো করতে পারেননি ‘ওয়ান-ভি-ওয়ানে’। একবার সামিত বক্সে ঢুকে মাইনাস করেছিলেন, কিন্তু পৌঁছানোর আগেই ক্লিয়ার করে দেয় সিঙ্গাপুরের ডিফেন্ডার।
ফাঁকে সিঙ্গাপুরও দু-তিনবার শঙ্কা জাগিয়েছিল। ৩১ মিনিটে মিতুলের দুর্দান্ত সেইভ না হলে সেদিনই ফান্ডি গোল পেয়ে যেতেন। শেষ পর্যন্ত বিরতির আগেই বাংলাদেশ গোল হজম করে বসে। সেখানে মিতুলের ভুলই বলা যায়। বক্সের ডান পাশে এমাভিয়ের কাছে বল গেলে পোস্ট ছেড়ে এগিয়ে যান মিতুল। এমাভিয়ের মাথার ওপর দিয়ে বল সরিয়ে দিলেও, সেটা বক্সের ডান দিকের আরেক সিঙ্গাপুর খেলোয়াড়ের কাছে যায়। তাঁর ক্রস থেকে বাঁ দিকের পোস্টে থাকা সন উইয়ং গোল করেন।
বিরতির পরও প্রথমে বাংলাদেশের কাছে দারুণ সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সেই ‘শেষ টাচের’ ভুলে তা কাজে লাগেনি। সিঙ্গাপুর অর্ধে বল কেড়ে নিয়ে বদলি ফরোয়ার্ড শাহরিয়ার ইমন ডান পাশ ধরে বক্সের কাছে পৌঁছান। তখন বক্সে রাকিব আর ফাহামেদুল চমৎকার অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু ইমনের ক্রস গিয়ে পড়ে বক্সের উল্টো প্রান্তে!
এর দুই মিনিট পরই সিঙ্গাপুরের দ্বিতীয় গোল। সেখান থেকে ফেরা কঠিন। হামজা-ফাহিমরা তবু এক গোল শোধ দিয়ে, একের পর এক আক্রমণ শানিয়ে সিঙ্গাপুরের শ্বাসরোধ করে দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি।
আর তাই শেষরক্ষা হলো না, শুধু আফসোসই রয়ে গেল!
ফুটবল নিয়ে এমন উন্মাদনা বহুদিন দেখেনি কেউ
বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচ ঘিরে ভক্ত-সমর্থকদের উচ্ছ্বাস নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গত এক যুগে ফুটবল ম্যাচ নিয়ে দেশে এমন উন্মাদনা দেখা যায়নি। স্টেডিয়ামের ভেতর-বাহির মুখরিত ছিল ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ স্লোগানে।
এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগেই দর্শকদের ঢল নামে জাতীয় স্টেডিয়ামে। ফেডারেশনের সতর্কবার্তা ও সূচি মেনে ঘণ্টা পাঁচেক আগেই হাজির তাঁরা। অনেকে গায়ে জড়িয়েছেন দেশের জার্সি, কারো হাতে পতাকা। স্বাগতিকদের পক্ষে স্লোগান দিতেও শোনা যায়।
ফুটবল নিয়ে এমন উন্মাদনা এই প্রজন্মের অভিজ্ঞতায় একদমই নতুন। একজন দর্শক বলেন, ‘আমি কাতার থেকে এসেছি শুধু সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশ ম্যাচটা দেখার জন্য, মাঠে বসে বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার জন্য। হামজা চৌধুরীর খেলা দেখতে আসছি। আমার হামজা চৌধুরীকে পছন্দ।’
ভক্তদের কাছে এরই মধ্যে তারকা ইমেজ তৈরি হয়েছে হামজা, ফাহামেদুল, সমিতদের। স্টেডিয়ামের প্রবেশপথগুলোতে রাখা হয় তাদের কাটআউট। সেখানে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলতে দেখা যায় দর্শকদের।
একজন দর্শক বলেন, ‘আগে কখনও স্টেডিয়ামে খেলা দেখি নি। এটাই আমার প্রথমবার। আশা করি হামজা, ফাহমেদুল, সমিতরা ভালো খেলবে। আমরা সবাই চাই হামজা একটা গোল করবে।’
সংস্কারের পর নতুন রূপের জাতীয় স্টেডিয়ামও আগ্রহ বাড়িয়েছে ম্যাচের। ডিজিটাল বোর্ড, বিগ স্ক্রিন আধুনিক প্রযুক্তির মিশেল যোগ করেছে রঙিন আবহ। তাছাড়া স্থানীয়দের সঙ্গে আকর্ষণের কেন্দ্রে প্রবাসী ফুটবলাররা।
দেশের ফুটবলের নতুন জাগরণ ধরে রেখেই এগোবে লাল-সবুজ।


















