শিক্ষা বাজেটে হতাশা, এবতেদায়ীতে সুখবর : বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক বললো সিপিডি
- আপডেট সময় : ০৯:৫৬:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫
- / 217

নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
শিক্ষায় বরাদ্দকে ‘হতাশাজনক’ আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। তারা মনে করেন, এই বাজেটে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন’ ঘটেনি।
সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য উত্থাপিত ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৭ শতাংশ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমে ৯৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় নেমে আসে।
এই অর্থের পরিমাণ সংশোধিত বাজেটের ১৩.৩২ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৮ শতাংশের সমান।
অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশের শিক্ষাখাতের জন্য জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করা আদর্শ ধরা হয়।
এই বাজেট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল হালিম বলেন, “এ বাজেটে কি আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পেলাম? অবশ্যই না। জুলাই অভ্যুত্থানের পর শিক্ষাখাত গুরুত্ব পাবে বলে আশা ছিল, কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তার প্রতিফলন দেখলাম না।
“শিক্ষা মানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, তখন জিডিপির অনুপাতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমা হতাশার। কারণ যে কোনো উদ্যোগের মেরুদণ্ড হল ফাইন্যান্স। বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কিভাবে আশা করব?”
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ৯৩৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে মোট ৯৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।
তবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা কম বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা।
যদিও প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ কিছুটা কমেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দের প্রস্তাব ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।
এছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে ৮৯৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ বিভাগের জন্য ১২ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য ১২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য ৯৩৪ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব ‘আশানুরূপ নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, “শিক্ষায় টাকার অংকে যতটুকু বরাদ্দ বেড়েছে তা আশানুরূপ নয়, তবে প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ অনেকটা কমে যাওয়া হতাশার। আমাদের আশা ছিল শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।
“সরকারের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকায় শিক্ষায় আশানুরূপ বরাদ্দ আসেনি। রাজস্ব আদায়ের হার আশানুরূপ থাকলে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত আরও অগ্রাধিকার পেত বলে আমি মনে করছি।”
উচ্চশিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ
উচ্চশিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, “আমাদের যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, সেগুলোর মান কোন দিকে যাচ্ছে সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। কারণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটা পিছিয়ে। বিশ্ব র্যাংকিংগুলোতে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।”
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তিনি বলেন, “বেসরকারি যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে, সেগুলোর প্রত্যেকটিতে কি শিক্ষার মান ঠিক আছে? এমন বহু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলোতে অধ্যাপক নেই। এমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে।
“যে টাকায় একজন অধ্যাপকের বেতনভাতা হয়, সে টাকায় হয়ত তিনজন প্রভাষককে নিয়োগ দেওয়া যায়। সেখানেও অর্থনৈতিক চিন্তা। আমার মনে হয়, এ জায়গাগুলোতে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। সরকারের উচিত উচ্চশিক্ষার মানে নজর দেওয়া।”
স্কুল ফিডিংয়ে ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা
বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আগামী অর্থবছরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচির জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।
“প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান। প্রাথমিক শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৫ হাজার ৯৪৬টি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, ১৭ হাজার ১৬৪টি ওয়াশব্লক নির্মাণ, ৪ হাজার ৪৫০টি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে।
“এছাড়া চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৯২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শতভাগ শিক্ষার্থীকে ইএফটির মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।”
পাঠ্যপুস্তকে বরাদ্দ ১ হাজার ৬২৬ কোটি
বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সংশোধিত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের জন্য ১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন।
তিনি বলেন, “উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, আধুনিক ও বিশ্বমানে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক মানের আউটকাম বেইজড এডুকেশন (ওবিই) পদ্ধতিতে কারিকুলাম হালনাগাদ করা হয়েছে।
“মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতায় ৬২টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫১ লাখ, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৮ লাখ এবং স্নাতক পর্যায়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বোনাস বৃদ্ধি এবং গ্রাচ্যুইটি প্রদানসহ সকল স্তরের শিক্ষকদের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।”
এবতেদায়ী শিক্ষকদের জন্য সুখবর
বাজেটে প্রাথমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের জন্য সুখবর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি এবতেদায়ী পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান এবং মাদ্রাসাগুলোর এমপিওভুক্তি বাবদ ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে ১ হাজার ১৩৫টি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫১৩টি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। ৪৯৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে।”
লক্ষ্য কারিগরি শিক্ষায় ২০ শতাংশ এনরোলমেন্ট
বাজেট বক্তৃতায় কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট হার বাড়ানোর লক্ষ্যও তুলে ধরেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্টের হার ১৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ২০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে মহিলা পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জেলা পর্যায়ে পলিটেকনিক এবং উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।”
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে এডিপি বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক মনে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সোমবার সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘বাজেটের যে কাঠামো উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানে বাজেটের আকার সামান্য ছোট করা হয়েছে। পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, সেখানেও কিছুটা কাটছাঁট করা হয়েছে। বাজেটের আকার নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা হয়েছে, সেটার অন্যতম কারণ হচ্ছে যে, আমাদের যে চলমান অর্থনৈতিক সংকট, অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে সমস্যা এবং রাজস্ব আহরণের সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বাজেট প্রস্তাব করেছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।’
ড. ফাহমিদা বলেন, ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির দিকে তাকালে দেখা যাবে, চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ২ শতাংশ কমানো হয়েছে এবং ১৫টি খাতের মধ্যে ১৪টি খাতেই কমানো হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য এবং চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তিনটি খাত—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে টাকার অংকে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সেটা আমাদের কাছে উদ্বেগজনক মনে হয়, কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমরা সব সময় বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলে আসছি এবং কৃষি খাতে, বিশেষত খাদ্য নিরাপত্তার দিকে এখানে বরাদ্দ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘ভৌত অবকাঠামো, বিশেষ করে পরিবহন ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি বরাবরের মতো উপরের দিকে আছে যুক্তিযুক্তভাবে।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘যদি আমরা রাজস্ব পদক্ষেপ দেখি, যেটার সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে যে, কর কাঠামোর মধ্যে করের ক্ষেত্রে যে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ দশমিক ৫ লাখ, অর্থাৎ সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে, এটা একটা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু প্রায় ৩ বছরের মতো সময় ধরে মূল্যস্ফীতি কিন্তু ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে, ১০-১১ শতাংশে উঠে গেছে। সেদিক থেকে যে খুব একটা উল্লম্ফন হয়েছে সেটা না। তবে এটা আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যারা জুলাই যোদ্ধা হিসেবে যারা তালিকাভুক্ত, তাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে, সেটাও আমরা ভালো পদক্ষেপ মনে করি।’
‘করের বিভিন্ন স্ল্যাবগুলোতে পরিবর্তন করা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যারা নিম্ন মধ্যআয়ের মধ্যে যারা পড়েছেন, কর দেওয়ার ক্ষেত্রে হারটা তাদের মধ্যেই বেশি পড়বে। আবার যারা আয়ের উচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে অনেক কম পড়বে। এখানে বৈষম্যের চিত্র দেখা যাচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক ন্যূনতম কর ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা, এখানে আমরা মনে করছি বৈষম্য রয়েছে। কারণ রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্য আরেকটি জেলার সবাইকে এক করে দেখানো; সরকারি সেবা সব জায়গায় সবাই কিন্তু সমানভাবে নেয় না। এখানে পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বলে আমরা মনে করি,’ যোগ করেন তিনি।
ফাহমিদা বলেন, ‘শুল্ক যৌক্তিকরণ হয়েছে এবং আমদানি শিল্পগুলো যৌক্তিকিকরণ করতে গিয়ে হয়তো কিছু কিছু শিল্প চাপে পড়তে পারে। বিশেষ করে যখন মূল্যস্ফীতি বেশি, কস্ট অব ডুইং বিজনেস বেশি। এটাকে শুল্কের যৌক্তিকিকরণ করতেই হবে, কারণ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে যাবে। আস্তে আস্তে ট্যারিফ কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। যে প্রতিঘাত আসবে, সেটা মোকাবিলা করার জন্য কস্ট অব ডুইং বিজনেসের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সাশ্রয়ী মূল্যে কিংবা সহজ শর্তে ঋণ কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে কস্ট অব ডুইং বিজনেস কমানো উদ্যোগ নিতে হবে।’
‘আমাদের কাছে আশ্চর্য লাগছে, মিডিয়াম ম্যাক্রোনিক পলিসি স্টেটমেন্ট, সেখানে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে রাজস্ব জিডিপির রেশিও ২০৩৫ সালে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে। এটা অত্যন্ত কম, কারণ প্রস্তাবিত অর্থবছরে রাজস্ব হার ৯ শতাংশ জিডিপির অনুপাতে। ১০ বছর পর মাত্র দেড় শতাংশ বাড়বে, এটা কেমন লক্ষ্যমাত্রা! তখন তো আমরা উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাব। এখানে আমরা দেখছি আকাঙ্ক্ষার নিম্নকামিতা। এক কম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা কীভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করব? সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখতে পাচ্ছি না।’
প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ই-কমার্সের সুযোগ-সুবিধা এবং ই-কমার্সকে ফরমাল সেক্টরে আনা; এখানে করের আওতায় আনা এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের অধীনে যে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন হয়েছে। আমরা মনে করি, আগেও পিপিপি মডেলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো কিন্তু খুব একটা এগোয় না। সরকারি ক্ষেত্রে দেখা যায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় একটু পিছিয়ে পড়ে, প্রাইভেট সেক্টর আবার খুব দ্রুত এগোতে চায়। এখানে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এবং দেখতে হবে অর্থটার ব্যবহার যেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে হয়।’
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার ফান্ড গঠনকে স্বাগত জানিয়েছে সিপিডি।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কালো টাকা সাদার করার সুযোগটা রয়ে গেছে। যদিও এখানে রেট বাড়ানো হয়েছে কিন্তু আমরা আগেও বলেছি, কালো টাকার ব্যাপারে আমাদের অবস্থান হচ্ছে, এই সুযোগ দিয়ে যারা নৈতিকভাবে প্রতি বছর স্বচ্ছ আয় করে, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার সঙ্গে কর দিয়ে থাকেন, তাদের প্রতি নৈতিক আঘাত। কারণ তাদের আদর্শিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। দুটি জিনিস সমান্তরালভাবে চলতে পারে না!’
ফাহমিদা আরও বলেন, ‘আগে করের হারটাও কম রাখা হতো, এখন করের হার বেশি রাখা হয়েছে। তারপরও এটা থেকে খুব একটা আদায় হয় না। যদি এখান থেকে সত্যি আদায় করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে কিন্তু সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া দুএকবার সুযোগ দিয়ে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় কর রেয়াত কিংবা বিভিন্ন জায়গা থেকে কমানো এবং পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও পরিমাণ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে ১৪০টির মতো কার্যক্রম একসঙ্গে চলতো, সেগুলো কমিয়ে ৯৫টি করা হয়েছে এবং সেখানে অর্থ বরাদ্দ কম করা হয়েছে। খুব কম না কিন্তু বাজেটের তুলনায় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো।’
‘আমরা বারবার বলেছি, এখানে কতগুলো উপাদান যুক্ত করা হয়, যেগুলো সামাজিক নিরাপত্তা বা সামাজিক সুরক্ষার অধীনে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ এটা একেবারেই অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সেখানে আছে ৩৫ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। কৃষি ভর্তুকি আছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এই দুটি মিলিয়ে ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়, সেটা বাদ দিয়ে রয়ে যায় ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো। সেটা অনেকখানি কমে আসে। এগুলো বাদ দিয়ে যে নেট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, সেটাকে দেখাতে হবে। সেটা দেখে তুলনা করা যেতে পারে যে আসলেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কী করা হলো,’ যোগ করেন তিনি।
ফাহমিদা বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে বলতে চাই, কিছু কিছু পদক্ষেপ ভালো নেওয়া হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু সামগ্রিক কাঠামোগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যে একই কাঠামোর মধ্যে এখানে একটু বেশি, ওখানে একটু কম—এ রকম করে নেওয়া হয়েছে। বাজেটের যে দর্শন, এখানে বৈষম্যহীন সমাজের কথা বলা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে যে বাস্তব পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সব ক্ষেত্রে সেটা সাযুজ্যপূর্ণ হয়নি।’


















