বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
- আপডেট সময় : ০২:১১:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫
- / 254

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগ নিয়ে হতাশা ছিলই, তবে তা এখন পৌঁছে গেছে উদ্বেগজনক স্তরে। দেশে বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে। বিষয়টির উপর আলোকপাত করেছেন অর্থনীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবদুর রহিম হারমাছি।
সামনে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা এখনও আঁচ করার অবস্থায় না থাকায় বিনিয়োগে খরা কাটবে বলে আশাবাদী হতে পারছেন না অর্থনীতিবিদরা। ফলে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ কাটছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে আগামী ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদনের) আকার দাঁড়িয়েছে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে এই অঙ্ক ৫০ লাখ ৫২ লাখ ৭৫৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জিডিপির ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে দেশে। এই বিনিয়োগ গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। সেই সঙ্গে ১০ বছর পর জিডিপির সাপেক্ষে বিনিয়োগ ৩০ শতাংশের নিচে নেমেছে।
২০১৫-১৬ অর্থ বছরে জিডিপির ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল। এর পর ১০ বছরে এত কম বিনিয়োগ আর কখনই হয় দেশে। এমনকি কোভিড মহামারির সময়েও এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। জাতীয় বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ থেকে সাড়ে ৩২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জিডিপির ৩২ দশমিক ২১ শতাংশ অর্থ দেশে বিনিয়োগ হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ।
মহামারির ধাক্কায় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থ বছরে তা কমে যথাক্রমে ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ ও ৩১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশে নেমে আসে।
২০২০-২১ অর্থ বছরে তা বেড়ে ফের ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে ৩২ দশমিক শূন্য দুই শতাংশে দাঁড়ায়।
মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়। তিন বছর পার হলেও সেই যুদ্ধের জের এখনও টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জিডিপির ৩০ দশমিক ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছিল দেশে। তার আগের অর্থ বছরে (২০২২-২৩) এই হার ছিল ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে ঘিরে দেশে বিনিয়োগের একটি আবহ তৈরি হয়েছিল। সে কারণেই ওই সময় দেশে বিনিয়োগ বেড়েছিল বলে মনে করেন ২০০৭-০৮ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন এক সরকার ক্ষমতায় থাকার ধারাবাহিকতার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলেও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব একটা ছিল না। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি ছিল, আস্থা ছিল। মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের একটা অনুকুল পরিবেশ ছিল দেশে। সে কারণেই বিনিয়োগ খানিকটা বেড়েছিল।
“কিন্তু এখন দেশের পরিস্থিতি আমরা সবাই জানি। কোনও কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে না। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। এ অবস্থার মধ্যে বিনিয়োগ কম হবে, এটাই স্বাভাবিক।”
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জিডিপির যে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে, তার মধ্যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয় জিডিপির ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ।
এই অর্থ বছরে সরকারি বিনিয়োগ গত অর্থ বছরের (৬.৭৪ শতাংশ) চেয়ে সামান্য বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে।
১০ বছর আগে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেসরকারি ছিল ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ; সরকারি ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
৩২ দশমিক ২১ শতাংশ রেকর্ড বিনিয়োগের বছরে (২০১৮-১৯) বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
বেসরকারি বিনিয়োগে খরা নিয়ে বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা, কোথাও স্বস্তি নেই। এ অবস্থায় বিনিয়োগ করবে কে? বিনিয়োগ বাড়বে কীভাবে?”
মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সঙ্কট বাড়িয়ে তুলেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিসহ সব কিছু আমদানিই কমে গেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
“অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ব্যবসা খাতে আস্থা আরও কমিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ও সেগুলোর ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।”
২০২৪-২৫ অর্থ বছরের নয় মাস অর্থাৎ গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গত ২৭ মে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বিনিয়োগসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।
অর্থ বছরের দুই বার মাথাপিছু আয়, বিনিয়োগসহ জিডিপি তথ্য প্রকাশ করে থাকে। নয় মাস (জুলাই-মার্চ) বা আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) হিসাব কষে মে মাসে একবার সাময়িক হিসাব প্রকাশ করে। পরে অর্থ বছর শেষ হলে (১২ মাস, জুলাই-জুন) আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করে।
সাময়িক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। তবে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২০ ডলার।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের সাময়িক হিসাবে দেশে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। চূড়ান্ত হিসাবে অবশ্য তা কমে ৪ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসে।
চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থ বছর শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৩৮ ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ডলারের হিসাবে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে এই অঙ্ক ৫০ লাখ ৫২ লাখ ৭৫৩ কোটি টাকা।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের চূড়ান্ত হিসাবে ডলারের হিসাবে জিডিপির আকার ছিল ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে ছিল ৫০ লাখ ২ লাখ ৬৫৪ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশ উত্তাল হতে শুরু করে। রক্তাক্ত এক অধ্যায় পেরিয়ে তা রূপ নেয় অভ্যুত্থানে, তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নজিরবিহীন এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি দেখা দেয় দেশে। তিন দিন পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এখনও বেগ পেতে হচ্ছে এই সরকারকে।
সঙ্কটে থাকা অর্থনীতিকে আরও গাড্ডায় ফেলে দেয় এমন পরিস্থিতি। আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলার রেশ রেখেই ২০২৪-২৫ অর্থ বছর শেষ হতে যাচেছ।
এ অবস্থায় বিনিয়োগ কমবে, অর্থনীতি চাপে থাকবে, এটা স্বাভাবিকই, মন্তব্য করেন মির্জ্জা আজিজ।


















