ভঙ্গুর বিশ্বে নতুন পথ দেখাক এশিয়া : নিক্কেই সম্মেলনে ইউনূস
- আপডেট সময় : ১১:০৫:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
- / 271

নিক্কেই সম্মেলনে শান্তি, সংলাপ ও সামষ্টিক কল্যাণের পথে এশিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও এশিয়ার দেশগুলো একযোগে কাজ করলে শান্তি, অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের নতুন পথ দেখাতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে ২০২৫) জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ‘নিক্কেই ফোরাম: ৩০তম ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন বিশ্বজুড়ে শান্তি ভঙ্গুর, আস্থা ক্ষীণ, আর বৈশ্বিক সহযোগিতা অনিশ্চিত। এই পরিস্থিতিতে এশিয়াকে শান্তি, সংলাপ ও সামষ্টিক কল্যাণের পথে নেতৃত্ব দিতে হবে।”
টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলের ফুজি হলে আয়োজিত সম্মেলনে মুহাম্মদ ইউনূস জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক বিভাজনকে বর্তমান বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, “কোটি কোটি মানুষ যখন খাদ্য ও মৌলিক প্রয়োজন পূরণে হিমশিম খাচ্ছে, তখন আমরা যুদ্ধের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছি—এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভারত ও পাকিস্তানকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও সহাবস্থান বজায় থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “একটি ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এখন আমরা একটি স্বাধীন, ন্যায়ভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছি।”
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণের জন্য সুয়োশি হাসেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এত বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের সঙ্গে এখানে উপস্থিত হতে পারা আমার জন্য বিরাট সম্মান ও গর্বের। নিক্কেই ফোরাম দীর্ঘদিন ধরে এশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংলাপ, দৃষ্টিভঙ্গি ও সংকল্পের এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে। আমাকে এই মর্যাদাপূর্ণ ফোরামে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য হাসেবেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “এখানে দাঁড়িয়ে আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠছে ২০০৪ সালের কথা। যখন নিক্কেই আমাকে ‘এশিয়া প্রাইজ’ দিয়ে সম্মানিত করেছিল। এটি ছিল আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এরপর থেকে জাপানের সঙ্গে আমার এক গভীর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। আমি বহুবার জাপানে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেছি, তরুণদের সঙ্গে দেখা করেছি, ধারণা বিনিময় করেছি। আমি খুব আপ্লুত হয়েছি দেখে যে জাপানের মানুষ কী আন্তরিকভাবে আমার সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণের ধারণাকে গ্রহণ করেছে।”
সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলেন মুহাম্মদ ইউনূস। বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন সম্ভাবনা তৈরি করছে, তেমনি নতুন নৈতিক চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। বাণিজ্য বিধিনিষেধ বাড়ছে, যা মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সামাজিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে বৈষম্য বেড়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ, এমনকি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও আস্থা কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আমরা এই বিভাজন ও অস্থিরতার প্রকাশ দেখেছি, যা সরকার পরিবর্তনেরও কারণ হয়েছে”।
তিন শূন্যের দর্শন
বক্তৃতায় ইউনূস তার বহুল প্রচারিত ‘থ্রি জিরো’ বা তিন শূন্যের ধারণার কথা তুলে ধরেন—দারিদ্র্য শূন্য, বেকারত্ব শূন্য এবং কার্বন নিঃসরণ শূন্য। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মানুষ কষ্ট পাওয়ার জন্য জন্মায়নি, তাদের সম্ভাবনা অসীম। সঠিক সুযোগ দিলে সবাই বদলে দিতে পারে নিজেদের জীবন।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “এশিয়ার সামনে বড় সুযোগ আছে একটি নতুন ধরনের অর্থনীতি নির্মাণের—যেখানে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি করুণা, ভোগের পাশাপাশি যত্ন থাকবে। এটাই হবে সোশ্যাল বিজনেসের মূল জায়গা।”
সম্মেলনে এশিয়ার টেকসই উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে সাতটি প্রস্তাব দেন মুহাম্মদ ইউনূস। সেগুলো হলো- আন্তঃনির্ভরতা থেকে আন্তঃসহযোগিতায় রূপান্তর, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জোরদার, অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা, মানুষের ওপর বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সবুজ রূপান্তর, তৃণমূল নেতৃত্ব ও নৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ এবং তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান।
তিনি বলেন, “শুধু পুঁজি নয়, নৈতিক নেতৃত্বও চাই। শুধু উৎপাদন নয়, চাই সামাজিক দায়বদ্ধতা। আসুন, আমরা একটি অংশীদারত্বভিত্তিক এশিয়া গড়ে তুলি।”


















