অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র জনতার প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে আসা নাহিদ ইসলাম সাড়ে ছয় মাসের মাথায় সেই দায়িত্ব ছাড়লেন ‘ছাত্র-জনতার কাতারে’ ফিরে যাওয়ার জন্য। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা নাহিদ মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) বেলা ২টায় রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে, দেশে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সরকারে থাকার চেয়ে রাজপথে থাকলে বেশি ভূমিকা রাখা যাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
ছাত্র রাজনীতি থেকে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা এই তরুণ নেতা বলেন, “একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের জন্য আমার রাজপথে থাকা প্রয়োজন; ছাত্রজনতার কাতারে থাকা প্রয়োজন। আমরা যে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শক্তিকে সংহত করতে আমি মনে করেছি যে, সরকারের চেয়ে রাজপথে ভূমিকা বেশি হবে। বাইরে যে সহযোদ্ধারা রয়েছে, তারাও একই চিন্তা করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আজকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি।”
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে যে তিনজনকে ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে এনেছেন, নাহিদ তাদের একজন। আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম। তখন তিনি ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। গতবছর ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে উপদেষ্টা পরিষদে প্রথমে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান নাহিদ ইসলাম। এরপর তাকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শেষ দিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত একটি কমিটির দায়িত্বেও এসেছিলেন তিনি।
সেই কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “গত ছয় মাসে আমি আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করেছি কাজ করে যাওয়ার। দুটি মন্ত্রণালয়ের বাইরেও অনেক অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোতে আমি কিছু কাজ করেছি। ছয় মাস খুবই কম সময়, তারপরও আমি চেষ্টা করেছি। সেই কাজের ফলাফল হয়ত জনগণ পাবে। আজকে থেকে আমি সরকারের দায়িত্বে নেই।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে যে নতুন রাজনৈতিক দল আসতে যাচ্ছে, তাতে যোগ দিচ্ছেন নাহিদ ইসলাম। শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) এ দলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হবে, আর আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদের নামই শোনা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, “নতুন রাজনৈতিক শক্তি ও দল গঠন হচ্ছে, আমার সেখানে অংশ নেওয়ার অভিপ্রায় আছে। জনগণের সাথে মিশে আবারও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং গণঅভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি বাস্তাবায়নে মাঠে থেকে কাজ করার লক্ষ্যে আমি পদত্যাগ করেছি।”
ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে আসা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলমও একই পথ অনুসরণ করবেন কি না, সেই প্রশ্নে নাহিদ বলেন, “আমি মনে করেছি আমার বাইরে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এখনও গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা তো বাস্তবায়িত হয়নি। বিচার এবং সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই সরকার গঠন হয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে দুইজন রয়েছে। তারা মনে করেছে তাদের সরকারে থেকে জনগণকে সার্ভ করা উচিত। তারা যদি রাজনীতি করার প্রয়োজন বোধ করে তখন হয়তো সরকার ছেড়ে দেবে।”
দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা আছে কিনা– এমন প্রশ্নে এই তরুণ নেতা বলেন, “আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। সেই সীমাবদ্ধতা কাটানোর চেষ্টা করেছি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল। আমরা এসে পুলিশকে পেয়েছি তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। জুলাইয়ের গণহত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের বিষয়টি রয়েছে। জনপ্রশাসন কমিটির একটা দায়িত্বে দুই সপ্তাহের মত ছিলাম। এই সময়ে যারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে ডিসি ছিল এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের সরানোর দায়িত্ব নিয়েছি।”
নাহিদ বলেন, “আমি আশা করব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা, গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রবমূল্য নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখাতে পারবে।”
পদত্যাগপত্রে যা লিখেছেন নাহিদ
পদত্যাগপত্রের শুরুতেই নাহিদ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত সহযোদ্ধাদের কথা ‘শ্রদ্ধাভরে’ স্মরণ করছেন। রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের পরে ছাত্র-জনতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘পরিবর্তিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের’ দায়িত্ব নেওয়ায় নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
নাহিদ লিখেছেন, “বৈষম্যহীন, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়তে আপনার নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদে আমাকে সুযোগ দানের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি ।”
“গত ০৮ই অগাস্ট ২০২৪ খ্রি. তারিখে শপথ নেওয়া উপদেষ্টা পরিষদে আমি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাই। নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আপনার নেতৃত্বে দায়িত্ব পালনে সদা সচেষ্ট থেকেছি।”
এরপর নিজের পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে নাহিদ লিখেছেন, “বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমার ছাত্র-জনতার কাতারে উপস্থিত থাকা উচিত মর্মে আমি মনে করি। ফলে আমি আমার দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়া সমীচীন মনে করছি।”
আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা জুলাই অভ্যুত্থানের মূল নেতাদের সম্মুখ সারিতে রেখে ২৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হবে। নাহিদকে সেই দলের আহ্বায়কের দায়িত্বে দেখা যেতে পারে। ৩৬ দিনের যে আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন, তার অগ্রভাবে ছিলেন নাহিদ ইসলাম। তখন তিনি ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। দাবি আদায়ের কর্মসূচি ঘোষণা থেকে শুরু করে বিক্ষোভের ময়দানে দিনের পর দিন সোচ্চার নেতৃত্বে দেখা গেছে ২৬ বছরের এই তরুণকে। সেজন্য তাকে যেতে হয়েছে ‘আয়নাঘরেও’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা নাহিদের ডাক নাম ফাহিম। তার বাড়ি ঢাকার খিলগাঁও দক্ষিণ বনশ্রীতে। দুই বছর আগে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক আখতার হোসেনেরে নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব ছিলেন নাহিদ। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রু আন্দোলনে এই সংগঠনের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।