পুরো নাম এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্তো। ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষিত এই ছেলেই বিশ্ব ফুটবলকে মাতিয়ে রেখেছিলেন পেলে নামে। ব্রাজিলের আরেক কিংবদন্তি রোমারিও একবার বলেছিলেন- খেলাটির নামই ফুটবল না হয়ে পেলে হওয়া উচিত।
পৃথিবীর বুকে শাসন আর কলোনি বানিয়ে রাখা বৃটিশরা তাদের মনোরঞ্জনের জন্য অসংখ্য খেলাধুলা এবং বিনোদনের যে পন্থা আবিষ্কার করেছিল, তন্মধ্যে ফুটবল একটি। এই ফুটবল খেলতে গিয়েই দেখা দেয় বিপত্তি।বিভিন্ন পজিশনে প্লেয়ার সংকট হলে গ্রামের মাঠে যেমন আমরা দু-একজন কে খেলায় তুলে বলে দেই তুমি শুধু দাড়িয়ে থাকলেই হবে, তেমনি বৃটিশরা ব্রাজিলের কালো চামড়ার দু-একজন কে খেলায় তুলে কৌটা পূরণ করতো আর বলে দিতো- তাদের কারো গায়ে যেন না লাগে, না ঘষে।
এই বর্ণ বৈষম্যের মাঝেও ব্রাজিলিয়ানরা আনন্দ খুজঁতে লাগলো । বৃটিশদের শরীরে যেহেতু স্পর্শ করা যাবে না সেজন্য তারা আবিষ্কার করলো আরো মারাত্মক এক কৌশল, যেটি পরবর্তীতে রুপান্তরিত হয়ে রুপ নিলো- সাম্বাতে।
শুরু হলো ফুটবল নিয়ে কারিকুরি ড্রিবলিং এবং অবিশ্বাস্য সব কসরত। প্রতিপক্ষের ছোঁয়া ছাড়া বল নিয়ে ম্যাজিকের সেই যে যাত্রা শুরু; যা পরবর্তীতে পুরো ল্যাটিন অঞ্চলের একটি আর্ট এ রুপ নেয়। ফুটবলীয় আর্ট; ল্যাটিন ফুটবল।
ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন রক্তের নেশায় উম্মাদ হয়ে যায় তেমনি অভুক্ত এবং জীবন সংগ্রামে প্রায় নিরানন্দ ব্রাজিলীয় বাচ্চাদের জীবনের মাঝে ফুটবল নিয়ে আসলো প্রাণের স্পন্দন।
অন্যরা খেলে বিনোদনের জন্যে। কিন্তু ব্রাজিলীয়রা খেলে জীবনের জন্য; বেচেঁ থাকার জন্য।
পৃথিবীব্যাপী তখন বর্ণ বৈষম্যের চূড়ান্ত রুপ ল্যাটিন এর ফুটবলে বিমোহিত স্পোর্টস এরিনা। এরই মাঝে কালো মানিক পেলের আগমন -মঞ্চারোহন এবং বিশ্বজয়। পেলেকে অস্বীকার করার লোক ছিলো কিন্তু ইগনোর করার উপায় ছিলো না। ব্রাজিল দল এতোই ভালো ছিলো- তারা পেলেকে ছাড়াই বিশ্বকাপ জিতেছিলো । কিন্তু তারপরও পেলেকে ইগনোর করা সম্ভব হয়নি । কারণ ঐ ব্রাজিলীয় সাম্বা- ল্যাটিন ট্যাক্টিস কিংবা অবিশ্বাস্য স্কিলের যে পসরা দেখতে মানুষ দল বেধেঁ মাঠে যেতো তার সবগুলিই ফিলাপ করে দিতেন ফুটবল এর রাজা।
একজন প্লেয়ার এর খেলা দেখার জন্য মানুষ যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা দেয় ব্যাপারখানা আপনি একবার কল্পনা করুন আপনার গ্রামের কিংবা মহল্লার কথা চিন্তা করে। কি এক মায়াবী বিভ্রম এর নাম ছিলো ফুটবল এবং সেটার পোস্টার বয় পেলে।
মিথ হলো একটি চালু রসিকতা কিংবা বিষয় সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস্য গালগল্প। যেমন ক্রিকেটার স্টিভ ওয়া নাকি হার্সেল গিবস কে ক্যাচ মিসের পরে বলেছিলেন -বাছা বিশ্বকাপটি হাত থেকে ফেলে দিলে। কিংবা শেন ওয়ার্ন নাকি বলেছিলেন -ঘুমে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি শচীন আমায় ব্যাট হাতে তাড়া করছে।দুটি বক্তব্যই তারা অস্বীকার করেছেন কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে বসে আছে।
তেমনি পেলেও নাকি একবার মাঝ মাঠ হতে গোলপোস্টে কিক করেন। বল বারে লাগলে তিনি বলেন পোস্ট এর মাপে গন্ডগোল আছে। পরবর্তীতে ম্যাজার্মেন্ট করে দেখা যায় গোলপোস্টের হাইট কম।
এই মিথের অন্তর্নিহিত বক্তব্য আসলে পেলের একুরেসি।
১২৮১ টি গোল করেছেন পেলে। আপনি একবার কল্পনা করুন গ্রামের মাঠে খেলে ও কিন্তু সেটা অসম্ভব এক ব্যাপার।
এই যে ছোট প্রতিপক্ষ আর বড় প্রতিপক্ষ এগুলি শুধুই তর্কের লড়াই। বাস্তবতা হলো- গোল করা সবসময়ই, সব যুগেই ,কঠিন ছিলো । আছে এবং থাকবে; যেমনটি ক্রিকেটে রান করা।
পেলের ক্ষেত্রে সবচাইতে অবিশ্বাস্য ব্যাপার ছিলো পুরো শরীরটাই সমান তালে ফুটবল খেলতো। ডান পা- বাম পা- হেড ওয়ার্ক ড্রিবলিং এবং এয়ারে বল কন্ট্রোলে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা পেলেকে আলাদা করে দিয়েছিলো অন্য অনেকের মতোই শুরুতে ।অন্যরা ধুমকেতুর ন্যায় ঝরে গেছেন কিন্তু ধ্রুবতারা হয়ে পুরো ক্যারিয়ারে পেলে একই মান ধরে রেখেছিলেন বলেই তিনি পেলে দ্যা গ্রেট হয়ে উঠেন।
যুগের সাথে অন্য যুগের তুলনা আসলে একটি ফ্যান্টাসি। এই ফ্যান্টাসিতে মানুষ আচ্ছন্ন হয় বলেই সেটা একটি রোমাঞ্চকর বিতর্কের সুযোগ করে দেয়। বর্তমান আর অতীতের এই তারতম্যের হিসাবও কিন্তু ভিন্ন। তবে ইতিহাসের পর্যালোচনা কিংবা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, তার সময়ের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সেরা ছিলো, সে ইতিহাসের প্রতিটি যুগের লড়াইয়ে নামলে ঐ সেরার কাতারেই থাকতো হয়তো; একের জায়গায় দুই কিংবা দুই এর জায়গায় এক। এটাই আসলে গ্রেট আর গ্রেটেস্ট এর তফাৎ এবং পেলে ফুটবল ইতিহাসের যেকোনো পরীক্ষাতেই এই গ্রেটেস্ট-ই থাকবেন অবলীলায়। সবুজ ক্যানভাস হতে বিদায়ের একবছর লিজেন্ড। আপনাকে এসিস্ট করার জন্য ফুটবল ইশ্বর ম্যারাডোনা তো বল পায়ে অপেক্ষমান আছেনই।
ফুজেল আহমদ: লেখক, ক্রীড়া বিশ্লেষক । টরেন্টো, কানাডা।
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩
আরও পড়ুন –