মানুষের শরীর ও মন-দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শরীরের অসুখ দেখা গেলেও মনের অসুখ দৃশ্যমান নয় । যে কারণে মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি সমাজে এখনও গুরুত্বহীন। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর মানুষ এখনও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে খুব একটা সচেতন নয়। যে কারণে নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষকে সচেতন করতে সংশ্লিষ্ট ভাষার গণমাধ্যমগুলোর বিশেষ ভূমিকা পালন জরুরি ।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের পাবলিক হেলথ বিভাগের উদ্যোগে এবং লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব ও চ্যারিটি সংস্থা সামারিটান্স-এর সহযোগিতায় ‘মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে গণমাধ্যমকর্মীদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় উপরোক্ত কথাগুলো বলেন প্রশিক্ষকগণ ।
গত ৮ আগস্ট মঙ্গলবার বিকেলে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল চেম্বারে অনুষ্ঠিত এই কর্মশালায় ক্লাবের প্রায় ৮০জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে সকল অংশগ্রহণকারীকে সনদ প্রদান করা হয়।
কর্মশালার মূল বার্তা ছিলো – আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর বিশেষ সতর্কতা জরুরি । এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয় । কারণ, সংবাদে আত্মহত্যার পদ্ধতির উল্লেখ ও বিস্তারিত বর্ণনা অন্য মানুষকে আত্মহত্যার কৌশল নিয়ে ওয়াকিবহাল করে তুলতে পারে। আবার আত্মহত্যার ঘটনাকে রোমাঞ্চকরভাবে উপস্থাপন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে পারে। ফলে আত্মহত্যাকে গৌরবান্বিত করে এমন শব্দ ও বাক্য অত্যন্ত সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতে হবে। প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে দেখানো হয় বিভিন্ন সেলিব্রেটির আত্মহত্যার খবর কীভাবে অন্যদেরকেও আত্মহত্যায় প্ররোচনা জুগিয়েছে।
এতে সার্টিফিকেট বিতরণী পর্বে বক্তব্য রাখেন এবং সনদপত্র তুলে দেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র মাইয়ুম মিয়া তালুকদার ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কেবিনেট মেম্বার কাউন্সিলার গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী। পুরো আয়োজনটির সমন্বয় করেন টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়রের স্ট্রাটিজিক এডভাইজার মোহাম্মদ জুবায়ের।
কর্মশালার শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এমরান আহমদ।
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নানা সেবা ও উদ্যোগের পাশাপাশি টাওয়ার হ্যামলেটসের জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা উপাত্ত তুলে ধরেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা এঞ্জেলা বার্ণস।
মানসিক কষ্টে ভোগা লোকদের জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপির বিভিন্ন সেবা ও কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন থেরাপিষ্ট ম্যারিয়েলা ক্যানটোনি ও ফোটিনি ব্রিনিয়া। আর মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন ‘সামারিটান্স মিডিয়া এডভাইজরি সার্ভিস’র প্রধান মোনিকা হোলি।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা এঞ্জেলা বার্ণস বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি সাধারণ ঘটনা। তবে জাতীয় গড়ের তুলনায় এখানকার বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তুলনামূলক কম।
তিনি বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসে মানসিক কষ্টে থাকা মানুষদের বেশির ভাগই ডিপ্রেশন (হতাশা) ও এংজাইটিতে (চরম বিষন্নতা) ভূগছেন। অনেকের বাইপোলার ও সিজোপ্রিনিয়ার মত গুরুতর মানসিক অসুস্থতাও রয়েছে। এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর শূণ্য দশমিক ২ শতাংশ গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত। যাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
কাউন্সিলের গণস্বাস্থ্য-বিষয়ক এই কর্মকর্তা জানান, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে গত ১০ বছরে প্রায় ২০০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২১ সালে ঘটে ২৫টি ঘটনা। যা এর আগের বছর অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে ছিলো ১৬টি।
তিনি বলেন, বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার হিসেবে দেখে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। এ নিয়ে এনএইচএস, জিপি, টকিং থেরাপি ও দাতব্য সংস্থাসহ বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে কাজ করছে কাউন্সিল। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, এ সংক্রান্ত সেবাগুলোর প্রচার এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার জন্য কাউন্সিল বাংলা গণমাধ্যমগুলোকে অংশীদার হিসেবে চায়।
টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপির বিভিন্ন সেবা ও কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন থেরাপিষ্ট ম্যারিয়েলা ক্যানটোনি ও ফোটিনি ব্রিনিয়া। তাঁরা বলেন, কেউ যদি মনে করেন কোনো কারণে মানসিক কষ্টে আছেন কিংবা হতাশাগ্রস্থ, তারা চাইলে নিজেরাই টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপির সাহায্য নিতে পারেন। অনলাইনে কিংবা টেলিফোনে নিজেরা যোগাযোগ করতে পারেন। অথবা জিপি কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমেও টকিং থেরাপিতে রেফারেল (সুপারিশ) পাঠানো যাবে। টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপি কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মানসিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে । পাশাপাশি যাদের মানসিক চিকিৎসা অথবা বাড়তি সহায়তার প্রয়োজন- তাদেরকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে রেফার করে টাওয়ার হ্যামলেটস টকিং থেরাপি।
‘সামারিটান্স মিডিয়া এডভাইজরি সার্ভিস’র প্রধান মোনিকা হোলি বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং আত্মহত্যার সঙ্গে যোগসূত্রের উপাত্ত তুলে ধরেন । তিনি বলেন, বিভিন্ন আত্মহত্যার ঘটনায় দেখা গেছে-গণমাধ্যমের খবরের ধরণের কারণে আত্মহত্যা উৎসাহিত হয়েছে। আত্মহত্যার কৌশল ও বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরার কারণে অন্যরাও একই কৌশল বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রাপ্ত বয়ষ্করাও নানাভাব আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়। তাই আত্মহত্যাকে রোমাঞ্চকর হিসেবে উপস্থাপন করে এমন সব শব্দ ও বাক্য এড়িয়ে চলতে হবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে আত্মহত্যা বিষয়ক খবর প্রচারের ক্ষেত্রে সার্বজনিন গ্রহণযোগ্য সম্পাদকীয় নীতি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকম-এর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এসব নীতি মেনে আত্মহত্যার খবর প্রচারে বিশেষ সতর্কতার গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।
ধন্যবাদ জ্ঞাপনমুলক বক্তব্যে ডেপুটি মেয়র মাইয়ুম মিয়া তালুকদার প্রশিক্ষণ কর্মশালার সকল অংশীজন ও অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করতে তিনি বাংলা গণমাধ্যমগুলোকে জোরালো ভূমিকা রাখার আহবান জানান।
একই আহবান জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কেবিনেট মেম্বার কাউন্সিলার গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বলেন, বাসিন্দাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনা বৃদ্ধি এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাউন্সিল সুনিদির্ষ্ট নীতি নিয়ে কাজ করছে ।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে বলেন, আত্মহত্যা সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশের কারণে তাদের সংবাপত্র কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছিলো।
তিনি বলেন, আত্মহত্যার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। কর্মশালার অংশীজন ও প্রশিক্ষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এই কর্মশালা লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার খবর প্রকাশের বিষয়ে অনেক নতুন কিছু শিখিয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ বলেন, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব প্রতি বছর সদস্যদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে। তবে মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার খবর প্রচার নিয়ে আয়োজিত এই প্রশিক্ষণটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ প্রশিক্ষণ থেকে ক্লাবের সদস্যরা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা শিক্ষার পাশাপাশি নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও উপকৃত হবেন।