ইহকাল ত্যাগ করেছেন দুই হাজার এক সালের ৮ ডিসেম্বর। দুই দশক অপেক্ষা করার পর টাওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিল তাঁর নামে একটি ভবনের নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রায়ই হতাশাগ্রস্থ হয়ে ভাবতাম তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার দায়ভার কি কেউ নেবে না? কথা বলছি ব্রিটেন প্রবাসে বাঙালি কমিউনিটি গড়ার অন্যতম প্রধান স্থপতি, বাঙালি কমিউনিটির কিংবদন্তী নেতা, প্রথিতযশা সাংবাদিক, সফল ব্যবসায়ী, চিন্তাবিদ, মনীষী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির অন্যতম সংগঠক, বাঙালির পথ প্রদর্শক, বাঙালির বাতিঘর – প্রয়াত তাসাদ্দুক আহমেদ এমবিই কে নিয়ে।
তাসাদ্দুক ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে আমার প্রতিটি লেখায় টাওয়ার হ্যামলেটস্ এলাকায় তাঁর নামে কোনো কমিউনিটি হল, ভবন, রাস্তা এমনকি স্কুলের নামকরণ করার জন্য কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি বারবার। গতকাল (২৪ জানুয়ারি ) মেয়রের উপদেষ্টা, সাংবাদিক, অনুজ – প্রতিম সৈয়দ মনসুর উদ্দিন এর টেক্সট মেসেজ থেকে অবহিত হলাম যে, শেষ অবধি বাংলাদেশী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস্ এলাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে কাউন্সিল পাঁচ জন বাঙালির নামে পাঁচটি নতুন ভবনের নামকরণ করার ঘোষণা দিয়েছে। দেরিতে হলেও কাউন্সিলের এহেন সিদ্ধান্তে আনন্দে মনটা উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। হতাশার মেঘ কেটে যেনো আশার ঝকঝকে রোদ দেখতে পেলাম। সৌভাগ্যবান পাঁচ বাঙালির মধ্যে রয়েছেন তাসাদ্দুক আহমেদ এমবিই, কবি সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সাংবাদিক শাহাবউদ্দিন আহমেদ বেলাল এবং বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক শহীদ আলতাব আলী। অসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মেয়র জন বিগস, সৈয়দ মনসুর উদ্দিন এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে তাঁদেরকে আরো যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, অন্তরালে থাকা সে সব কর্মকর্তাদের প্রতি। কাউন্সিলের এ উপঢৌকন নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি তাসাদ্দুক ভাই এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। প্রথমে ব্রিকলেনের হ্যানবারি স্ট্রিটের জব সেন্টারে এবং পরে এথনিক কমিউনিটি সার্ভিস এর অফিসে। তাসাদ্দুক ভাইয়ের সাথে প্রয়াত আলী রেজা খান ভাইও ছিলেন। তাঁদের দুজনকেই ভাই বলে সম্মোধন করলেও তাঁদের কাছে আমি ছিলাম সন্তানতুল্য। দুজনই ছিলেন প্রবাসে আমার সুখ – দুঃখের পরম আশ্রয়স্থল। আমার চাকরি, পড়াশুনা, বিয়ে, প্রবাসে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা – সব কিছুতেই ছিল তাঁদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। তাঁরা আমাকে তাঁদের পরিবারের সদস্য হিসেবেই গণ্য করতেন। এখনো তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। আর সে কারণেই “প্রবাস পিতা” তাসাদ্দুক আহমদকে নিয়ে সুখবরটি আমাকে এতটাই আন্দোলিত করেছে যে মনে হয়েছে, আমার চারপাশের সব ফুলের গন্ধ আর সুরের ছন্দ যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে! মনে হয়েছে চন্দ্র – সূর্য কিছুক্ষনের জন্য ধরিত্রীতে নেমে এসেছে! একেবলই আরাধ্যের প্রতি ভক্তের টান ! আনন্দে দিশেহারা হয়ে মনসুরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছি।তাসাদ্দুক ভাইয়ের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি।আমার অতি প্রিয় শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংবাদিক, সমাজ কর্মী রেনু আপাকে (ডঃ রেনু লুৎফা) সুখবরটি জানিয়েছি। আমার মতো রেনু আপাও তাসাদ্দুক ভাইয়ের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। মনে পড়ে মৃত্যুর পূর্বে রমফোর্ড রোডের ওয়েস্ট গেইট নার্সিংহোমের দোতলার ছোট্ট একটি কামরার চার দেয়ালে যখন তাসাদ্দুক ভাই বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন, তখন রেনু আপা ও আমি নিয়মিতভাবে তাঁকে দেখতে যেতাম।
তাসাদ্দুক ভাই তাঁর জীবদ্দশায় ব্রিটেনের মূলধারায় বাঙালি কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার জন্য রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, বাংলা সংস্কৃতিসহ তাঁর সাধ্যমতো সবক্ষেত্রেই অবদান রেখে গেছেন। যা আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তাসাদ্দুক ভাইসহ পাঁচজনকে সম্মাননা প্রদর্শনের মাধ্যমে টাওয়ার হ্যামলেটস্ কাউন্সিল বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনে বাংলাদেশী অভিবাসীদের অবদানকেই দেরিতে হলেও স্বীকৃতি দিলো। আমি মনে করি তাসাদ্দুক ভাইকে নিয়ে এটা কেবলই শুরু। নার্সিংহোমে যাবার আগে তিনি দীর্ঘদিন পূর্ব লন্ডনে ১৬বি পারফেট স্ট্রিটে থাকতেন। কাউন্সিলের সমীপে অনুরোধ করবো রাস্তার নাম বদলে তাসাদ্দুক ভাইয়ের নামে নামকরণ করা যায় কিনা তা ভেবে দেখতে। তিনি বহুদিন এ বাড়িতে ছিলেন, তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য “তাসাদ্দুক আহমেদ নামফলক” বাড়ির গায়ে খোদাই করে রাখা যায় কিনা সে বিষয়েও পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি বিনীত আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রবাসে তরুণ ও নবীন সাংবাদিকদের অনেকেই হয়তো জানেন না যে, তাসাদ্দুক ভাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও ব্রিটেনে সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন। সাংবাদিকতার সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তিনি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ এ। তাছাড়া করাচি থেকে প্রকাশিত ইভনিং নিউজ পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন। লন্ডনে আসার পর তিনি “দেশের ডাক” নামে একটি পাক্ষিক বাংলা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকাটি প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে একমাত্র বাংলা পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হতো। ব্রিটেনে মেইন স্ট্রিম রাজনীতিতে পুরো এশিয়ান কমিউনিটির কণ্ঠস্বর রুপে তাসাদ্দুক ভাই প্রথম বের করেন ইংরেজি পাক্ষিক সংবাদ পত্র – “দি এশিয়ান “। বেশ কিছুকাল পত্রিকাটি চালু ছিলো। তাঁর হাত ধরেই লন্ডনে প্রথম বাংলা পত্রিকায় কম্পিউটার যুগের প্রবর্তন হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বহির্বিশ্বে জনমত গঠনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাসাদ্দুক ভাই ও তাঁর স্ত্রী রোজমেরী আহমেদ “বাংলাদেশ নিউজ লেটার” নামে ইংরেজি পত্রিকা বের করতেন।
আজ ব্রিটেনের অনেক প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয়েছিল তাসাদ্দুক ভাইয়ের কাছে। তাসাদ্দুক ভাইয়ের সান্নিধ্যে এসে অনেকের সাংবাদিকতার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে তা বলা বাহুল্য। আমি নিজেও সাংবাদিকতার বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে তালিম নিয়েছি। অথচ আমরা সাংবাদিকরাও তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কোনো ধরণের পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছি। অতীতে আমার বেশ কয়েকটি লেখায় প্রিন্টিং ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের কাজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ণের ভিত্তিতে “তাসাদ্দুক আহমেদ জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড” প্রবর্তনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এমনকি এ ব্যাপারে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের কর্তা ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছিলাম। তবে কোনো সাড়া পাইনি। শুনলাম আসন্ন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি এলায়েন্স নির্বাচনে বিজয়ী হলে “তাসাদ্দুক আহমেদ জার্নালিস্ট অ্যাওয়ার্ড” প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণাকে আমি স্বাগত জানাই। একইসাথে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারির কাছে তাসাদ্দুক আহমেদ এর ছবি স্থায়ীভাবে ক্লাবের দেয়ালে স্থাপনের আগাম অনুরোধ করছি।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী তাসাদ্দুক ভাই এর বাংলা ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি ছিলো প্রবল আগ্রহ। তিনি লন্ডনে “বাংলা একাডেমী” প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাক্শক্তি হারানোর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত প্রায়শই আমাদের মধ্যকার আলোচনায় “বাংলা একাডেমী” প্রতিষ্ঠার কথা প্রাধান্য পেতো। অগণ্য সংগঠনের জন্মদাতা তাসাদ্দুক ভাই “বাংলা একাডেমী” প্রসবের আগেই কর্মশক্তি আর চলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। স্বাপ্নিকের সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেলো। ব্রিটেনে যাঁরা বাংলা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের মাঝ থেকে কেউ কি এগিয়ে আসবেন তাসাদ্দুক ভাইয়ের শেষ ইচ্ছা পূরণে করতে? বাঙালি কমিউনিটি এখনও যে তাঁর কাছে বড়ো ঋণী হয়ে আছে।
আমি প্রায়ই মনে মনে ভাবি ব্রিকলেনের রাস্তায় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে তাসাদ্দুক ভাই ক্লান্তিহীনভাবে এক অফিসে থেকে আরেক অফিসে ছুটে চলেছেন। সভা – সমিতিতে বাঙালি কমিউনিটির অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। আমার কোনো কাজে ভুল দেখে জোরে ধমক দিয়ে বলছেন “তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না”। অতি কাছের মানুষ ছিলেন বলে তাসাদ্দুক ভাই যে কত বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন, তা আমাদের অনেকেই অনুধাবন করতে পারিনি। তাঁর অনুপস্থিতি এখন আমাদের তা টের পাইয়ে দিচ্ছে। তাসাদ্দুক আহমেদের মতো আরেকটি বটবৃক্ষ অদূর ভবিষ্যতে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে আদৌ দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
লেখক: শিক্ষাবিদ,সাংবাদিক ও কমিউনিটি কর্মী, এমবিই, এফআরএসএ, এফআরএএস ।
আরও পড়তে পারেন-