­
­
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ খ্রীষ্টাব্দ | ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
রাখাইনের জন্য করিডর বাংলাদেশের জন্য কী ঝুঁকি তৈরি করতে পারে?  » «   ইউরোপ ৪ দেশ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন!  » «   ডলারের বিপরীতে টাকার মান বৃদ্ধি  » «   বিশ্বে সামরিক ব্যয় রেকর্ড বেড়ে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার  » «   নতুন এক লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ  » «   ৬০ টন পণ্য নিয়ে সিলেট থেকে উড়ল প্রথম কার্গো ফ্লাইট  » «   রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার  » «   শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানান মোদি  » «   ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতার কবি দাউদ হায়দার আর নেই  » «   গুজরাটে ১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি আটক  » «   ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কোন দিকে মোড় নিতে পারে?  » «   পাকিস্তানের আছে ১৫০টি পরমাণু বোমা, ভারতের কত?  » «   কাশ্মীর নিয়ে ভারত আর পাকিস্তানের লড়াইয়ের কারণ কী?  » «   আট মাসে দেশে ২৬টি রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্ম, উদ্দেশ্য কী?  » «   ঢাকায় হামজার অভিষেকে ছাড়া হবে ১৮ হাজার টিকিট  » «  

মোস্তফা সেলিম : অনাত্মীয় শহরের বন্ধু



সেলিমের সাথে আমার বন্ধুত্বটা ছিলো অনেকটা শরতের বৃষ্টির মতো। আমরা কখনোই দীর্ঘক্ষণ একত্রে কাটাইনি। কলেজে দেখা হতো, কথা হতো। সেলিম ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলো, তাই তার ব্যস্ততা আমার চেয়ে অনেক ছিল বেশি। তাছাড়া সে তখন কলেজ হোস্টেলের ‘ছাত্রাধিনায়ক’। হোস্টেল ছাত্রাধিনায়কের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে, সেগুলো নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। কলেজ বন্ধের দিনে কখনো-সখনো আমি যেতাম কলেজ হোস্টেলে ছাত্রাধিনায়কের কক্ষে। কখনো নায়ককে পেতাম, কখনো বন্ধ দরোজা। যখন দেখা হতো, কথা হতো কেবল লেখালেখি নিয়ে। আমরা কখনোই সহপাঠী হিসেবে পাঠ্য বিষয় নিয়ে কিংবা পরীক্ষার বিষয়ে আলাপ করেছি বলে মনে পড়ে না। আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যে কথা হতো কম, কিন্তু আমরা একে অপরকে অনুভব করতাম বেশি।

স্কুলজীবন শেষ করে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার এক অজপাড়া গাঁ থেকে সিলেট শহরে এসে আমি ছিলাম বন্ধুহীন বিপন্ন সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ এক তরুণ। আমার গ্রামের জীবনের জন্য প্রায়শই মনের ভেতর একটা হাহাকার জেগে ওঠতো। বই পড়ে আর  কবিতা লিখে লিখে আমি সেই হাহাকার ঠেকাতাম।

ছবি: লন্ডনে শিল্প,সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন পলল আয়োজিত ‘সিলেটি নাগরীলিপি চর্চা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শীর্ষক অনুষ্ঠান  ২০১৮ 

তখন আমি পাঠ্যবই ছেড়ে খুব বেশি গল্প-উপন্যাস বিশেষ করে রহস্য উপন্যাস পড়তাম। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, বিভূতির পথের ‘পাঁচালী’, সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা কাহিনী শেষ করে রানা সিরিজে গিয়ে আটকে গিয়েছিলাম। তারপর ক্রমশ ঝুঁকে পড়লাম কবিতা নামক ললিতলবঙ্গলতার দিকে। রফিক আজাদ, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, সুনীল, ফয়েজ যার লেখাই পড়ি, মনে হয় এ যেন এক রহস্যময় জগত, চির রহস্য উৎসারক। কবিতা পড়তে পড়তে কখনো পৃথিবীর সকল বিষাদ আমার মনে জড়ো হতো, আবার কখনো হয়ে উঠতাম চাঁদনী রাতের মতো চনমনে, কখনো ভিজে যাওয়া মুড়ির মতো মিনমিনে। এভাবে সদা রহস্য-ধারক কবিতার প্রেমে আমি ক্রমশ হয়ে ওঠি কবিযশোপ্রার্থী। কবিতা লেখা শুরু করি দু’হাত দিয়ে। স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো আমার কবিতা। দিনগুলো কাটে উল্কা ট্রেনের গতিতে। জীবন ছুটে চলেছে ঘোরের মধ্যে। ঠিক সে সময়েই মুখে সতত হাসি নিয়ে সহপাঠী মোস্তফা সেলিমের আবির্ভাব আমার বন্ধু হয়ে। আমার সদ্য পরিচিত এই বন্ধুটির স্বর্গীয় হাসিমাখা মুখের দিকে তাকালে আমার দিনটা ভালো কাটতো। প্রথম দেখাতেই সেলিমকে আমি অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কষ্টসহিষ্ণু ও কর্মঠ হিসেবে জানতে পেরেছি। তার ভেতরে যে অদম্য মনোভাব দেখেছি সেটি আমকে আকর্ষণ করেছে। তাকে দেখে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ হয়ে জেগে ওঠতো। তখন দু’জনেই বিকম প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

         ছবি:পূর্ব লন্ডনের ব্রার্ডি আর্ট সেন্টারে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব স্টলে সাংবাদিকদের সাথে

সহপাঠী হিসেবে মোস্তফা সেলিম ছিলো অত্যন্ত অমায়িক ও বন্ধুবৎসল। তাই সেলিম যখন কলেজ ছাত্র সংসদে ‘সাহিত্য ও বিতর্ক সম্পাদক’ পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করে তখন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আমাকে বলা হয় সেই পদে প্রতিদ্বন্ধিতার জন্য। আমি এক বাক্যে সেটা ফিরিয়ে দিয়েছি। প্রথমত আমি ছাত্র সংসদে যেতে চাইনি। আমি নিরিবিলি মানুষ, এসব আমার জন্য নয়। দ্বিতীয় কারণ, আমার বন্ধু মোস্তফা সেলিম এ পদের অন্যতম প্রতিদ্বন্ধী এবং আমি মনে-প্রাণে বন্ধুর বিজয় কামনা করি। সেলিম নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলো।

ছাত্রজীবনেই সেলিম কবিতা লিখতো, স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত তার লেখা প্রকাশিত হতো। কেন জানি না, সম্ভবত বন্ধু হিসেবে ভালোবাসার কারণে সে আমার কবিতার বেশ প্রশংসা করতো। তখন সারাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উদ্দাম সময়। আমার তখনকার কবিতা ছিলো স্বৈরাচারবিরোধীতায় উচ্চকন্ঠ। সেলিম সেগুলোর খুব প্রশংসা করতো। সে সময় কলেজের  সাহিত্য-সংস্কৃতিক সপ্তাহ উপলক্ষে ‘ঈষিকা’ নামে একটি প্রকাশনা হয়েছিলো। সেখানে প্রকাশের জন্য সেলিম আমাকে কবিতা দিতে বলে। ম্যাগাজিন প্রকাশের পর দেখি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একমাত্র আমার কবিতা ছাপা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ জমা দিয়েছিলাম প্রতিযোগিতার জন্য এবং কবিতা ও গল্পে প্রথম এবং প্রবন্ধে তৃতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলাম। আমার সুস্পষ্ট মনে পড়ে, সেলিমই প্রথম আমাকে অভিনন্দিত করেছিল। অন্যকে উজ্জীবিত করতে সেলিমের কোন জুড়ি ছিলো না। অন্তত আমি সেলিমের কথায় আর আচরণে অসংখ্যবার উজ্জীবিত বোধ করেছি। সেলিম ছিলো আমার মতো যারা সৃষ্টিশীল উন্মাদনায় মত্ত, তাদের নেতা। তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি ছিলো প্রবল।

     ছবি: সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য আয়োজিত বই মেলা ২০১৯

তারপর কলেজের পাঠ চুকিয়ে আমরা কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেলিম তখন বড়লেখায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। দীর্ঘ বিরতির পর হঠাৎ হঠাৎ দেখা হতো। সে সময় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তার একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ হয়। তারপর একসময় শিক্ষকতা ছেড়ে প্রকাশনা জগতে পদার্পন করলো। প্রখর প্রতিভাদীপ্ত মোস্তফা সেলিম যে পেশাতেই যুক্ত হয়েছে, সেখানেই সাফল্য পেয়েছে। তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘উৎস প্রকাশন’ এখন বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। সিলেটি নাগরীলিপি ও সাহিত্যের নবজাগরণে তার উদ্যোগ তো রীতিমত ঝড় তোলেছে। সেলিমের মতো আত্মবিশ্বাসী না হলে কেউ এরকম সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। এটা এক ধরনের আগুন নিয়ে খেলা, এই খেলায় মোস্তফা সেলিমকেই মানায়। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে অনেক প্রতিষ্ঠানের ভরাডুবি হওয়ার অবকাশ থাকে। সেলিম সেই অবকাশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সিলেটি নাগরীলিপির পূনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। মোস্তফা সেলিমের যতো প্রকাশনা, লেখক হিসেবে যতো পরিচিতি, সাংগঠনিক পরিচিতি- সবকিছুকেই ছাপিয়ে সিলেটি নাগরীলিপির পূনর্জাগরণ প্রয়াস এবং এর সফলতাই সেলিমকে অমরত্ব দান করবে, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মোস্তফা সেলিমের মতো একজন বন্ধু আছে, এ আমার গৌরবের।

জয় হোক মোস্তফা সেলিমের।

জয় হোক অদম্য সাহসিকতার।

শেরাম নিরঞ্জন : কবি

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

"এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব " -সম্পাদক

সাবস্ক্রাইব করুন
পেইজে লাইক দিন